No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ইতুপুজো – ইতিহাস ও লোকাচার

    ইতুপুজো – ইতিহাস ও লোকাচার

    Story image

    উলু--লু--লু! আর শঙ্খধ্বনির জোর ধামাকা। রোববার বলে কথা! ছুটির দিন। সাপ্তাহিক ছোটাছুটির সাময়িক বিরতি। হেমন্তের আকাশ থেকে নিম্নচাপের চাদরটা সরে যেতেই জাঁকিয়ে শীতের আমেজ। ঝিরঝিরে হাওয়া। ঘুম তো জমে উঠবেই। কিন্তু ঐ যে অঘ্রানের ভোরবেলায় বউঝিদের নদী বা দিঘি থেকে ইতুপুজোর ঘট আনার চোটে ঘু্মোয় কার সাধ্যি!

    ইতু ঠাকরুনের আজ স্পেশাল পুজো। কাকভোরে বাড়ির উঠোন নিকিয়ে চুকিয়ে তকতকে। রাঙামাটির গোলা দিয়ে মেড়ুলির সজ্জা। চারপাশে দুধসাদা বাহারি আলপনা। শঙ্খলতা খুন্তিলতা চালতেলতার চিত্তির। লক্ষ্মীর প্যাঁজ। আর ফুলকারি নক্সা। শিশিরভেজা তুলসিতলা। ওখানেই পাতা হয়েছে ইতুর আটন। একটা  মাটির সরা বা মালসায় একতাল মাটি।  তাতে ধান কচু মান বা হলুদগাছ। পাঁচ কলাই ছড়ানো অংকুর। কোথাও বা খাড়া কঞ্চির উপরে ঝুলছে ধানের শিস। একখান পিদিম জ্বলছে। কিম্বা মোমবাতির নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে। ইতুর ঘটে সিঁদুর দিয়ে পুতুল আঁকা। ঘটের কানায় জড়ানো কলমি আর শুশুনির দল-দাম। বাড়ির  গিন্নিরা সকালেই চান করে ছালের কাপড় পরে রেডি। ইতুর পুজো নিয়ে যাবে বামুনবাড়ি। পুজোর শেষে গোল হয়ে শুনতে বসবে ব্রতকথা। চাল কলা আর সিধে নিয়ে বামুনগিন্নী সুর করে বলবে ইতুব্রতকথা।

    অষ্টচাল অষ্টদূর্বা কলসপত্র ধরে ।
    ইতুকথা একমনে  শুন প্রাণ ভরে।।

    কে এই ইতু? ইতু দেব না দেবী? ইনি কি বৈদিক না পৌরাণিক? নাকি শুধু ব্রতের দেবতা?

    মিত্র। মানে সূর্যপুজো। মেয়েলি লৌকিক সূর্য-উপাসনা। সূর্যের অপর নাম মিত্র। মিত্র>মিতু>ইতু। ইনি মূলত বৈদিক দেবতা। অগ্রহায়ণ মাসে সূর্যের নাম মিত্র বা রবি। এই কারণে অগ্রহায়ণ মাসে রবিবারে ইতুর পুজো হয়। প্রাচীন পারস্যদেশে একসময় মিথু পুজো হতো। মিথু>মিতু>ইতু। প্রাচীনকালে কুমারী মেয়ের পতিলাভ আর সাংসারিক কল্যাণ কামনায় সূর্যের পুজো মহিলামহলে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। মহাভারতে কুন্তীর সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন সূর্যদেব। তারফলেই কানীনপুত্র কর্ণের জন্ম হয়েছিল। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য মনে করেন সূর্যের অপর নাম আদিত্য। এই আদিত্য থেক ইতু শব্দটি এসেছে। শাক্তধর্মের প্রভাবে ইতু ক্রমশ দেবীতে পরিণত হয়েছেন। সূর্যদেবতা থেকে ইতু শষ্যদেবী লক্ষ্মীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। এইকারণে তিনি ইতুলক্ষ্মী নামে রাঢ়বাংলায় পূজিত।

    আচার্য সুকুমার সেন একেবারে বিপরীত দৃষ্টিকোণ থেকে বলেছেন - ইতু হলেন প্রাচীন ইন্দ্রপুজোর দৃষ্টান্ত। তাঁর মতে ঋকবেদীয় সূক্তগুলির নাম ছিল ইন্দ্রস্তূত। তার থেকে কালক্রমে ইন্দথথু> ইতু। ইন্দ্র বৈদিকযুগের প্রধান দেবতা। আবার বিয়ের দেবতাও ছিলেন তিনি। মেয়েদের ব্রত আচার কৃত্যে ইন্দ্র ক্রমশ স্থান লাভ করেন। ইন্দ্রের মত বরের কামনায় আজও ইন্দ্রদাদ্বশীর দিন মেয়েরা ইন্দ্রপুজো করে। অগ্রহায়ণ মাসে নতুন বছর শুরু হতো। এই সময়ে রবিশস্য বিশেষ করে গম যব সরিষা ইত্যাদি ফসল লাগানো হতো। কৃষির সঙ্গে প্রজনন সমার্থক। সুতরাং বোঝাই যায় ইতু আসলে সেই রবিশস্যের অঙ্কুরোদ্গমের কৃষি উৎসব।

    কার্তিকসংক্রান্তির দিন ইতু-উৎসবের সূচনা। সমাপ্ত হয় অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে। প্রতি রবিবারে মেয়েরা ইতুর ঘট এনে পুজো করে। ইতু পুজোয় লাগে চাল-কলাইয়ের নৈবেদ্য। আর ভোগে লাগে ভাজাপোড়া অর্থাৎ চাল-কলাই ভাজা। সংক্রান্তির দিনে ইতুলক্ষ্মীর বিশেষ ভোগে থাকে সরুচাকলির পদ। সেদিন পুজোর ফুল বলতে হলুদ সরিষার ফুল। পুজোর পর ইতুকে নদীতে বা পুকুরে বিসর্জন দেওয়ার রীতি।

    ইতুর জনপ্রিয় ব্রতকথাটি লিখিত ও মৌখিক দুই রূপেই মেলে। অধিকাংশ ব্রত-গল্পের মতো এই গল্পেরও অন্যতম প্রধান চরিত্র দরিদ্র ব্রাহ্মণ। উমনো ঝুমনো দুই মেয়ে। ব্রাহ্মণ ভিক্ষা করে চাল-ঘি যোগাড় করেছে আসকেবড়া খাওয়ার জন্য। কিন্তু বামনিকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে - উমনো ঝুমনোকে যেন একটাও না দেওয়া হয়। তবু স্ত্রীকে বিশ্বাস নেই। বার ঘরে বসে তাওয়ায় ছ্যাঁক করে আওয়াজ হয় আর গুনে রাখার জন্য দড়িতে গিঁট দেয় বামুন। এদিকে সুযোগ বুঝে উমনো ঝুমনোকে দুটো বড়া খাওয়ায় মা। সেই অপরাধে তাদের বনবাসে দেয় নিষ্ঠুর বাবা। এখানেই তারা ইতুপুজো করে রাজা ও মন্ত্রীকে বিয়ে করলে কী হবে, উমনো আর ইতুপুজো করে না। আবার কষ্ট নেমে আসে। অবশেষে ঝুমনোর তৎপরতায় ফিরে পায় সব কিছু।

    ব্রতগল্পটি থেকে প্রাচীন ইতিহাসের অনেক বিলুপ্তপ্রায় প্রথার সন্ধান মেলে। যেমন দড়িতে গিঁট মেরে মনে রাখার প্রথা প্রাচীন গ্রন্থিলিপিকে স্মরণ করায়। পেরু পলেনেশিয়া এমনকি প্রাচীন চীনেও এই লিপির প্রচলন ছিল। এর নাম কুইপান বা কুইপু লিপি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্রতগল্পটিতে ইন্দো-ইউরোপীয় লোকগল্পের মোটিফগুলিও সুস্পষ্ট রূপে ধরা পড়েছে। যেমন - মেয়েদের বনবাসে পাঠানো, দুর্ভাগ্য জয় করে বাড়িতে পুনপ্রায় ফিরে আসা, বৃক্ষের অভ্যন্তরে আশ্রয় লাভ ইত্যাদি।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @