ইসা খাঁর হাতে নাস্তানাবুদ হয়েছিলেন আকবরের সেনাপতি মান সিংহ

সাধারণ এক জায়গিরদারের ছেলে থেকে দিল্লির সম্রাট হয়ে উঠেছিলেন শের শাহ। তাঁর বীরত্বের গল্প আমরা সবাই জানি। শের শাহ মারা গেলে তাঁর ছেলে ইসলাম শাহ যখন সম্রাট হলেন, সেই একচ্ছত্র বাদশাহর সঙ্গে টক্কর দিতে গিয়েছিলেন বাংলার এক জায়গিরদার সুলাইমান খাঁ। ইসলাম শাহকে তিনি সম্রাট হিসেবে মানলেনই না। বিদ্রোহ করে বসলেন। আর বিদ্রোহের পরিণতি হল মৃত্যু। সুলাইমান খাঁ-এর তরুণ দুই ছেলে ইসা খাঁ আর ইসমাইল খাঁ-কে বিক্রি করে দেওয়া হল এক তুরানি বণিকের কাছে। সেটা ১৫৪৮ সাল। তারপর বেশ কিছু বছর দুই ভাই ক্রীতদাসের জীবন কাটালেন। এইভাবে খুব অল্প বয়স থেকেই ইশা খাঁ বিরুদ্ধ পরিবেশের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে টিকে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের কাকা অনেক কাটখড় পুড়িয়ে শেষপর্যন্ত দুই ভাইয়ের খোঁজ পান এবং অর্থের বিনিময়ে তাঁদের ফিরিয়ে নিয়ে আসেন ১৫৬৩ সালে।
বাংলার সুলতান তাজ খাঁ কররানি ইসা খাঁকে তাঁর বাবার জায়গিরদারি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। প্রশাসক হিসেবে ইসা খাঁ ছিলেন খুবই দক্ষ। বিক্রমপুরের রাজা চাঁদ রায়ের মেয়ে স্বর্ণময়ীকে তিনি বিয়ে করেন। স্বর্ণময়ী পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে ইশা খাঁ তাঁর নাম পাল্টে রাখেন সোনা বিবি। স্ত্রীর নামে ইশা খাঁ নিজের রাজধানীর নাম দেন সোনারগাঁও। ১৫৭১ সালের মধ্যে তিনি এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন, যে মুঘল সম্রাট আকবরের সভাপণ্ডিত আবুল ফজল তাঁর ‘আকবরনামা’ বইতে ইশা খাঁকে ভাটির শাসক বলে উল্লেখ করেছেন। এখনকার বাংলাদেশে সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া – এই সাতটি জেলার চল্লিশটি উপজেলা জুড়ে আছে ভাটি অঞ্চল। এখানে ছ’মাস জল থাকে, আর ছ’মাস যায় শুকনো।
এদিকে দিল্লিতে তখন শের শাহের বংশধরদের তাড়িয়ে আবার মুঘলরা জাঁকিয়ে বসেছে। ১৫৭৫ সালে বাংলার সুবাহদার মুনিম খাঁর মৃত্যু হলে আফগান নেতা দায়ুদ খাঁ কররানি নিজেকে বাংলার সুলতান বলে ঘোষণা করলেন। দায়ুদ খাঁ চাইতেন শের শাহের মতোই দিল্লি দখল করে সম্রাট হতে। যার ফলে দিল্লির বাদশাহ আকবরের সঙ্গে তাঁর শত্রুতা তৈরি হল। বাংলায় তখন বারো জন জমিদারের খুব প্রতিপত্তি। এঁদেরকে একসঙ্গে বলা হত বারো ভুঁইয়া। এই বারো ভুঁইয়াদের মধ্যে সবথেকে শক্তিশালী ছিলেন ইশা খাঁ। মুঘল নৌবাহিনী বাংলা আক্রমণ করলে দায়ুদ খাঁর সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইসা খাঁ সেই নৌবহরকে পরাস্ত করেন। সুলতান দায়ুদ খাঁ তখন খুশি হয়ে ইসা খাঁকে ‘মসনদ-ই-আলা’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
দায়ুদ খাঁর সঙ্গে বাংলার বারো ভুঁইয়ারাও মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সোনারগাঁওয়ের বিচক্ষণ ও দূরদর্শী শাসক ইসা খাঁ তখন হয়ে উঠেছিলেন বারো ভুঁইয়ার নেতা। মুঘল সাম্রাজ্যের নাগপাশ থেকে বেরিয়ে তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন বাংলার জমিদাররা। মুঘল সম্রাট আকবরের প্রধান সেনাপতি ভারতখ্যাত বীর রাজা মানসিংহ কোনোদিন ইসা খাঁকে যুদ্ধে হারাতে পারেননি। ১৫৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বিক্রমপুর থেকে ১২ মাইল দূরে ইসা খাঁ এবং মাসুম খাঁ কাবুলির সংযুক্ত বাহিনীর সঙ্গে মুঘল সৈন্যদলের এক প্রবল যুদ্ধ হয়। মান সিংহের ছেলে দুর্জন সিংহ মারা যান সেই যুদ্ধে। আর মান সিংহের সঙ্গে ইসা খাঁর তলোয়ারের লড়াইতে মান সিংহের তলোয়ার ভেঙে যায়। ইসা খাঁ অবশ্য মান সিংহকে হত্যা করেননি। মুঘল সৈন্যদল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। বন্দি হয় প্রচুর মুঘল সৈন্য।
বিচক্ষণ ইসা খাঁ বুঝতে পেরেছিলেন, এইভাবে বছরের পর বছর মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই শেষ পর্যন্ত তিনি বন্দিদের মুক্ত করে দেন এবং মান সিংহের সঙ্গে আকবরের দরবারে গিয়ে সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করে নেন। ১৫৯৯ সালে বক্তারপুর দুর্গে অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছিলেন ইসা খাঁ। তাঁর ছেলে মুসা খাঁ এরপর হয়ে ওঠেন বারো ভুঁইয়ার নেতা।
তথ্যসূত্র – দৈনিক ডেল্টাটাইমস, নিউজ ইনসাইড টুয়েন্টি ফোর।