No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ভিড়ে ঠাসা বইমেলা: পিডিএফ, অডিও-বুকের যুগে ছাপাবই আদৌ পড়ছে নতুন প্রজন্ম?

    ভিড়ে ঠাসা বইমেলা: পিডিএফ, অডিও-বুকের যুগে ছাপাবই আদৌ পড়ছে নতুন প্রজন্ম?

    Story image

    ৯৭১ সাল। জুলাই মাস। রাত নেমেছে মার্কিন দেশের আর্বানা শহরে। বছর চব্বিশের মাইকেল হার্ট যাচ্ছিলেন ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ল্যাবে। হাতে খুব একটা সময় নেই, অনেকটা কাজ জমে আছে। কী খাবেন, কী পাবেন এসব ভাবতে ভাবতেই সামনের ফুড স্টল থেকে খাবার কিনে নিলেন কিছু। কাগজ জড়ানো খাবারটা কোনরকমে ব্যাগে ঢুকিয়েই দে দৌড়। পেপারে কী লেখা আছে সেসব দেখার আর সময় কোথায়!

    খানিকটা সময় কেটে যাওয়ার পর বেশ খিদে পেল। হাত পড়ল ব্যাগে। চটজলদি খেতে গিয়ে মাইকেলের চোখ কিন্তু এবার আটকে গেল খাবারের দাগ লেগে যাওয়া বাতিল পেপারটাতেই। আরেব্বাস!

    রাতে কাজের ক্লান্তি, ঝিমঝিমেভাবটা ততক্ষণে এক ঝটকায় হাওয়া! ঘোর কাটিয়ে তাঁর মগজ বলছে কিছুতেই বিনবক্সে ফেলে দেওয়া যাবে না কাগজটা। কিন্তু রাখাও যে মুশকিল। শেষ পর্যন্ত মাইকেল ঠিক করলেন তিনি লিখে রাখবেন এই কাগজের প্রতিটা অক্ষর।

    বসে গেলেন কম্পিউটারে টাইপ করতে। এই কাগজ যে এক ইতিহাসের দলিল!

    আমেরিকার স্বাধীনতার দ্বিশতবর্ষ উপলক্ষে খাবারের দোকানদার ক্রেতাদের হাতে হাতে বিনামূল্যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বিলি করছিলেন সেদিন। সেভাবেই একখানা কাগজ এসে পড়ে মাইকেল হার্টের হাতেও।

    তাঁর সেদিন মনে হচ্ছিল এই ঘোষণাপত্রকে কম্পিউটারে ধরে রাখতে হবে। যাতে বহু বছর পরেও বহু মানুষ পড়ার সুযোগ পায়।

    তখনও ইন্টারনেট দূরস্ত। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ল্যাবে কম্পিউটার মেশিনটি আরও একশোটি কম্পিউটারের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। হার্টের টাইপ করা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সেদিন সত্যি সত্যি কিছু মানুষ ডাউনলোড করে পড়েছিল। আজকের ই-বুকের (E-Book) সূচনা হয়েছিল সেভাবেই।

    মাইকেল এইচ এস-এর হাতেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল সেই বিখ্যাত গুটেনবার্গ প্রকল্প, যা পৃথিবীর প্রাচীনতম ডিজিটাল গ্রন্থাগার হিসেবে বিশ্বের কাছে চিহ্নিত। গুটেনবার্গের ছাপাখানা বদলে দিয়েছিল মানুষের জীবন। কোনও সীমান্তরেখা আটকাতে পারেনি সেই বদল। মাইকেল হার্টও তেমন বদলই এনেছিলেন। বই ডিজিটালাইজেশনের প্রথম ঋত্বিক তিনি। তাঁর ভাবনার ফসল আজ আমার আপনার হাতে হাতে ঘুরছে।

    ভিড় ভরা বাস, বাস স্টপের চিলতে কোণ, হুটপাটের দরকারী রেফারেন্স কিংবা হারিয়ে যাওয়া বই মুহুর্তের মধ্যে খুঁজে পেতে একটাই ‘অপশন’ ই-বুক ডাউনলোড। পিডিএফ জমে জমে লাইব্রেরির বহরও কম নয়। কিন্তু এই বই সামলাতে বড়ো বাড়ি, বিশাল মাপের লাইব্রেরি ঘরের দরকার হয় না। চোট্ট চিপেই ধরে যায় সারা বিশ্বের বইপত্তর। ধূলো-পোকা এমনকি বইচুরির ভয়ও নেই। এক্ষেত্রে সবসময় পয়সা খরচ করতে হয় না বইয়ের জন্য। ফ্রি-তেই পাওয়া যায়। একটা সিঙ্গেল ক্লিকে শুধু পাঠকের অপেক্ষায়।

    ই-বুকের কদর বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। অনেক রকম ভার্সান তার। ই-বুকের দুনিয়ায় ঝড় এসেছিল ২০১৯ আর পরবর্তী অতিমারী আক্রান্ত বছরগুলোয়। বিশ্ব তখন ঘরবন্দী। ভাইরাসের থাবা থেকে পরিত্রাণ পেতে মুক্তির অপেক্ষায় দিন গুনছে। স্কুল কলেজ লাইব্রেরি সব বন্ধ। কবে সব ঠিক হবে কোনও ঠিকানা নেই। পাড়ার লাইব্রেরি তো দূরের কথা পাশের বাড়ি থেকে বই চেয়ে আনার উপায়ও নেই শেষ পর্যন্ত বন্ধু হয়ে উঠেছিল ই-বুক। দোর বন্ধ জীবনে ডিভাইসে ডিভাইসে যেমন ব্যক্তিগত লাইব্রেরি গড়ে উঠেছিল তেমনি বহু বিশ্ববিখ্যাত লাইব্রেরিও ই-মাধ্যমে দরজা খুলে দিয়েছিল পাঠকের জন্য। তবে, এ বই (Book) পড়া গেলেও ছোঁয়া যায় না। পাতার মধ্যে পালক বা গোপন চিরকুটের পেজমার্ক রাখা যায় না। প্রতিদিনের ব্যস্ততার সঙ্গী কিন্তু বইয়ের আগে যে ‘ই’ বসে আছে, হৃদয়ের বন্ধু হবে কি?

    প্রশ্ন গিয়েছিল সদ্য কলেজ পার করা স্নিগ্ধার কাছে। এক কথায় উত্তর, ‘’পিডিএফ (PDF) ভাল, ওই ব্যাপারটা নেই”

    ওই ব্যাপারটা কী?

    পাঠককে বলে দিতে হয় না ‘ওই ব্যাপারটা’ আসলে শব্দ-স্পর্শ-গন্ধ। ধবধবে পাতার খুদে খুদে কালো অক্ষরগুলো যখন তাকিয়ে থাকে তখন মগজে-মনে যে অনুরণন চলে তার ঢেউ অধরা থেকে যায় ই-বুক অপশনে।

    সেই একই কথার রেশ শোনা যায় সুরজ সিনহার গলাতেও। পেশায় ডিজিটাল কন্টেন্ট-রাইটার সুরজের কথায় “অনেক ভিড়ের মধ্যে আলাদা হয়ে যাওয়ার ইচ্ছেতে বড়ো ভরসা কিন্তু বই, ই-বুক নয়। ঠিক ভাল লাগে না। পড়ার সেই এনার্জিটাই থাকে না। মন বসে না ঠিক।”

    এই প্রজন্মের বাংলা কবিতাক্ষেত্রে অন্যতম পরিচিত কবিমুখ অরিত্র সান্যাল। বাংলা এবং বিদেশি ভাষায় তাঁর ই-বুক সংগ্রহ বেশ চমকে দেওয়ার মতো। কিন্তু ই-বুক না হার্ডকপি বই প্রশ্নে এক কথায় উত্তর চাইলে খানিক দ্বিধা থরথর মনে হয় লাজুক কবিকে। তবে তাঁর বই সংগ্রহ আর বইয়ের খিদে বলে দেয় অবধারিতভাবে পাল্লা ভারি ‘হার্ডকপি’র দিকেই।  

    এই পর্যন্ত পড়ে পাঠক যদি ভাবেন ভিন্ন মত নেই তাহলে নিশানা ভুল জায়গায় লাগল। অন্যরকম কথা শোনালেন ‘ছাপাখানা’ সংস্থার কর্ণধার দীপায়ন ধর। বয়সে নবীন হলেও নিয়মিত নতুন বইয়ের প্রকাশক তিনি। দীপায়নবাবুর কথায়, “ব্যক্তিগতভাবে আমি বই হাতে নিয়ে পড়তে ভালবাসি, কিন্তু পরিবেশের কথা ভাবলে পিডিএফ অনেক ভাল”

    তাঁর মতে “তাহলে অনেক গাছ বেঁচে যায়”। কিন্তু তিনি এটাও জানেন এই ভাবনা বহুতে ছড়াতে অনেকটা সময় বাকি।

    কী ভাবছে বাইরের দুনিয়া?

    ই-বুক নিয়ে কী ভাবছে পৃথিবীর পাঠক? এই প্রশ্ন গিয়েছিল মালায়ালাম ভাষার কবি রাজেশ চিদিরার কাছে। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার রাজেশ আদতে কেরালার মানুষ হলেও বহুদিন পেশার দাবিতে দুবাইবাসী। লেখা আর বই, দুইই তাঁর নেশা। লিখতে গেলে ডিভাইস নয় আজও ভালোবাসেন কাগজ-কলম। আর পড়তে ভালোবাসেন বই ছুঁয়ে। কিন্ডল আছে কিন্তু পছন্দ হার্ডকপি। ই-বুক তাঁর লাগে শুধুমাত্র রিভিউয়ের দরকারে। তবে তাঁর চেনা লেখক কমিউনিটিতে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে অডিয়ো বুক (Audio Book)। তার একটা বড়ো কারণ ‘মাল্টি টাস্কিং’।

    হৈহৈ করে চলছে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা। লোকে লোকারণ্য। এদিক-ওদিক সাহিত্য মেলা থেকে নাকি লক্ষ লক্ষ টাকার বই বিক্রি হচ্ছে। এর থেকে ইতিবাচক খবর কী হতে পারে! তবে, তার সঙ্গে এটাও চাপা থাকছে না যে, নিত্য নতুন ডিভাইসে বদলে যাচ্ছে পড়ার মাধ্যম। জেন-ওয়াই, জেন-এক্স আলোর গতিতে বন্ধুত্বও করে নিচ্ছে তাদের সঙ্গে। কিন্তু আবেগ হোক বা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি, স্পর্শের বিষয়টাই আলাদা। বই ছুঁয়ে পড়লে মনের অন্তর্জগতে পাঠকের সঙ্গে যে নিবিষ্ট প্রেমের সম্বন্ধ তৈরি হয়, তা কখনই ই-বুক বা অডিও বুকের সঙ্গে গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। এগুলি ছাপা বইয়ের পরিপূরক হতে পারে না, স্রেফ বিকল্প একটা মাধ্যম, যা কিছুটা সুবিধে বৈ আর কিছুই দিতে পারে না।   

      

    মনে পড়ে যায় সিরিয়ার সেই মাটির তলার লাইব্রেরিটার কথা। যুদ্ধে ছারখার দেশ। ভাঙা বাড়ি, আলো নেই, জল নেই, বাতাসে কান পাতলেই হাহাকার আর কান্না। তবু মাটির তলায় আছে আলোর হদিশ। ভাঙা দেশের মাটির তলায় বুকের পাঁজর দিয়ে গ্রন্থাগার গড়েছে মানুষ। চুপিসাড়ে চলে পাঠ। অন্তর্জালের সাধ্য নেই সেখানে পৌঁছায়, কিন্তু বইয়ের দুয়ার খোলা... সেখানে গুলি-বোমা-গ্রেনেডের আওয়াজে মিশে যায় পড়ুয়ার গুনগুন... মৃদু শোনা যায় কারা যেন বলছে,

    আমাদের বাঁচার হাতিয়ার হোক শুধু বই...    

    যেকোনও মাধ্যমে।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @