ডায়াবেটিস, সুগারে চিনির বিকল্প হিসেবে প্রতিদিন যে মধু খাচ্ছেন, তা খাঁটি তো?

শোনা যায়, মংপুতে থাকাকালীন রবীন্দ্ৰনাথ ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় মধু বিষয়ক একটি কবিতা লিখেছিলেন। এই কবিতা প্রকাশের কিছুদিন পরে মংপুতে রবীন্দ্ৰনাথের কাছে একটি পার্সেল আসে। কবি পার্সেল খুলে দেখেন তাতে এক বোতল মধু! পাঠিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের এক অচেনা ভক্ত। মধুর বোতল উপহার পেয়ে খুশি হয়ে রবীন্দ্ৰনাথ লেখিকা মৈত্ৰেয়ী দেবীকে বলেন, ‘দ্যাখো, মধু নিয়ে কবিতা লিখেছি বলে মধু উপহার পেলাম।’
ঘর ভর্তি লোকের সামনে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ তখন মজা করে বলেন, ‘বাবামশাই, আপনি যদি চাল, ডাল, তেল নিয়ে কবিতা লিখতেন তবে বেশ হত। ঘরে চাল, ডাল, তেল আসত। তাহলে সংসার খরচ কিছুটা কমত।’ বাবা-ছেলের এই রসিকতার রেস টেনেই বলা যায়, মধু নিয়ে কবিতা লিখে না হোক, এপিকালচার বা জীবনের ঝুঁকি সরাসরি বন থেকে মধু সংগ্রহ করে সংসারের চাল, ডাল, তেলের খরচ জোগাচ্ছেন বাংলার মধুচাষি বা মৌলিরা।
এ রাজ্যে যে প্রাকৃতিক মধু পাওয়া যায়, তার বেশির ভাগ আসে সুন্দরবন থেকেই। স্বাদ ও রঙে তা উৎকৃষ্ট মানের। প্রাচীন কাল থেকে আমরা মধু ব্যবহার করি। ঋকবেদেও বলা আছে তার গুণাগুণ। তবে কয়েক বছর আগে সারা ভারতে মধু বেচা-কেনায় বিপর্যয় দেখা গেছিল। সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বা সিএসই জানিয়েছিল, এদেশে বিক্রি হওয়া বেশ কিছু নামি ব্র্যান্ডের মধুতে চিনির সিরাপ বা বিভিন্ন কৃত্রিম সুইটনার দেওয়া হয় ভেজাল হিসেবে। সম্প্রতি একটি জনৈক ইংরেজি সংবাদপত্র এই ভেজালের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং এর কারণে যেধরনের স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা রয়েছে, তা তুলে ধরেছে একটি প্রতিবেদনে। ডায়াবেটিস বা সুগারে যাঁরা মিষ্টির বিকল্প হিসেবে মধু ব্যবহার করেন, তাঁদের জন্য খুব একটা সুখকর খবর নয় এটা। তাহলে, খাঁটি মধু কি বাজারে একেবারেই অমিল?
না। বাজারে খুঁজলে খাঁটি মধু পাওয়াই যায়। তার জন্য আপনাকে জহুরী হতে হবে, বিচক্ষণ হয়ে তবেই মধু কিনতে হবে। বাংলার বহু ছোটো স্বাধীন সংস্থা বা ব্যক্তিগত উদ্যোগ মানুষের কাছে সুন্দরবন বা বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের খাঁটি মধু পৌঁছে দিয়ে ভরসা জিতে নিচ্ছে। ‘এপিকালচার’ বা মৌ-পালন আবারো বাড়ছে ধীরে ধীরে।
ভেজালহীন, ১০০% খাঁটি খাদ্যদ্রব্য বিক্রির জন্য অনেকদিন ধরেই নির্ভরযোগ্য অবস্থান ধরে রেখেছে ‘দ্য বেঙ্গল স্টোর’ নামে একটি ছোটো বানিজ্যিক সংস্থা। বিজ্ঞাপনের চটক নয়, এই সংস্থার ইউএসপি হল ‘খাঁটি খাবার’। তাঁরা মনে করেন, খাবার জিনিস খাঁটি হলে এমনিতেই চাহিদা তৈরি হয়, দেখনদারির প্রয়োজন পড়ে না। আর সেকারণেই এই বিপণির মধু বেশ জনপ্রিয়। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ‘বঙ্গদর্শন’-কে স্টোর-এর পক্ষ থেকে রোহিত সেন বলেন, “যে মধু আমরা ক্রেতাদের পৌঁছে দিই, তা সরাসরি সুন্দরবনের মৌলিদের থেকে সংগ্রহ করা। তাঁরা মৌচাক থেকে মধু বের করে পাত্রে ভরে আমাদের সরাসরি দেন। গরম করেন না, কোনো কিছু যোগও করেন না। আমরা সেগুলিকে কাচের বোতলে ভরে সরাসরি কাস্টমারের হাতে তুলে দিই। আমাদের মধু তাই ভেজালহীন, সবথেকে খাঁটিও বলা চলে।” আইআইটি খড়গপুর (এএফটি ল্যাব)-এ পরীক্ষিত এবং প্রত্যায়িত সার্টিফিকেট দেখিয়েছেন রোহিত। সেখানে প্রত্যেক উপাদানের পরিমান উল্লেখ করা আছে শতাংশের হিসেবে।
এইচএমএফ রয়েছে ২৬.৪৯, যা মধুর গুণগত মান বোঝায়। অর্থাৎ এই মধু খাঁটি, গরম করা হয়নি এবং বেশিদিন মজুদ করাও হয়নি। আইআইটি-র সার্টিফিকেট থেকে জানা যায়, ‘দ্য বেঙ্গল স্টোর’-এর মধুতে জল এবং চিনি নেই। বরং অন্যান্য জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের থেকে বেশি মাত্রায় নানা উপকারি খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ।
সুন্দরবনের মধু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই রফতানি করা হয়। যদিও লকডাউনের কারণে বহুদিন মধু রফতানি করা যায়নি। ফলে ব্যাপক ভাবে সমস্যায় পড়েছিলেন মৌলিরা। সুন্দরবনের একজন প্রাক্তন মৌলি তন্ময় মণ্ডল, যিনি এখন তাঁর উপজাতির অন্যান্য সদস্যদের মধু সংগ্রহে সাহায্য করেন এবং নিজে মধু বিক্রি করেন, তাঁর কথায়, “আমি প্রায় চার বছর ধরে দ্য বেঙ্গল স্টোর-এ মধুর যোগান দিয়ে আসছি। ন্যায্য দামও পাই। কখনও কোনও সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি, এমনকি লকডাউনের সময়ও ওঁদের থেকে সহযোগীতা পেয়েছি। আমরা যাতে অসুবিধায় না পড়ি ওঁরা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে মধু সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন শহরে।”
‘দ্য বেঙ্গল স্টোর’-এর মধু সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে ও কিনতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
প্রসঙ্গত, গোটা রাজ্যে প্রায় একলক্ষ মধুচাষির বাস। উৎকৃষ্ট মধু উৎপাদনের পরেও ফড়েদের কবলে পড়ে প্রাপ্য দাম পান না তারা। মধুচাষি বা মউলিদের আর্থিক দুরাবস্থা কমাতেই দেগঙ্গায় তৈরি হয়েছে মধু হাব। বিশ্বের দরবারে ভারী কদর সুন্দরবনের বনফুলের মধুর। এছাড়াও, সর্ষে, পদ্মের ফুল, আম, লিচু, কমলার মধুও বিখ্যাত। অসংখ্য মৌমাছি পালক বা মৌলিদের জীবন-জীবিকা নির্ধারিত হয় মধু সংগ্রহ ঘিরে। চাক-ভাঙা মধু জোগাড় করতে প্রাণ হাতে নিয়ে বনে ঢোকেন সুন্দরবনের মৌলিরা। আবার, দেগঙ্গা ও তার আশেপাশের গ্রামেও রয়েছেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার মৌমাছি পালক। এরা মৌমাছি প্রতিপালন করেন। বছরে প্রায় ১৬ হাজার মেট্রিক টনের বেশি মধু উৎপন্ন হয় এই রাজ্যে। অথচ, এই মধুর অধিকাংশই সামান্য টাকার বিনিময়ে ফড়েদের হাত ঘুরে চলে যায় ভিন রাজ্যে। মধুর দেশের মৌলিদের আর্থিক দুর্দশা কমে না। তবু এখন কিছুটা আশার আলো দেখছেন তাঁরা। মধু নিয়ে গবেষণা, সচেতনতার পরিসর বাড়ছে, বাড়ছে চাহিদা। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘সুন্দরবন মধু হাব’-এর মতো উদ্যোগ রীতিমত ফলপ্রসূ হয়েছে। মধু বিক্রির টাকা থেকে সংগৃহীত অর্থ সুন্দরবনের মধু সংগ্রহকারীদের সাহায্যে ব্যবহার করে রাজ্যের বন দফতর। গত বছরের শেষ দিকে জি আই ট্যাগের জন্য আবেদনও জানিয়েছে রাজ্য সরকার। মধুর প্রাপ্য দাম এবং সরকারি নজরদারিতে রপ্তানি—এই দুই সমাধানে নতুন আশায় বুক বাঁধছেন মৌলিরা।