No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    মানুষ আর নদীর সম্পর্কের মধ্যে শুধুই ফাটল?

    মানুষ আর নদীর সম্পর্কের মধ্যে শুধুই ফাটল?

    Story image

    দী মানে অবিরল আর নির্মল জলের ধারা। নদীর জল তরঙ্গ ছুঁইয়ে থাকে জীবনের নানা মুহূর্ত। এমন ভাবেই মানুষ নদীকে দেখেছে যুগ যুগ ধরে। এই দেখার মধ্যে দিয়ে মানুষ আর নদীর মধ্যে যে সম্পর্কের নির্মাণ হয়েছিল, তা নদীর মতো করেই বয়ে গিয়েছিল পরম্পরায়। পূর্ববর্তী প্রজন্মের মানুষেরা উত্তর প্রজন্মকে শিখিয়ে দিয়ে যেত নানা কথা। কেমন ভাবে তার একটা ছোটো উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।

    ছোটো-বড়ো নদী বাংলার ইতিহাস রচনাতে যে বিপুল ভূমিকা পালন করে, সেকথা আমাদের জানিয়েছিলেন ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়। এমন নদী-জপমালার ধৃত পান্তরে কত ‘উগ্র নদী’ তার স্রোতের ক্ষিপ্রতা হারিয়ে সবুজ ক্ষেত্রর মাঝে চাষের জমি হয়ে হারিয়ে যায়। সময়ের সঙ্গে নামটাও হারিয়ে যায় মানুষের মন থেকে।

    মুর্শিদাবাদ বা বর্ধমানের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরলে গ্রামের প্রবীন কৃষকদের মুখ থেকে শোনা যায় একটা ছড়া। “এপারে নদী ওপারে নদী মধ্যি খানে চর/ তারই মাঝে থাকবে বেঁচে মাঝের চর”। এর মানে হল নদীর ঠিক মাঝখানে যে চর জেগে উঠবে, সেই খানেই লাগাতে হবে মাঝের চর ধান। নদীতে জল বাড়লে মাঝের চর ধান খুব তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে ওঠে। জলের ভেতরে এই ধান বহুদিন বাঁচতে পারে। নদীর সঙ্গে পরম্পরা লব্ধ ভাবে এই যে বাঁচার কৌশল, এটা মানুষ আজ সত্যি ভুলতে বসেছে।

    যত দিন যাচ্ছে মানুষ আর নদীর সম্পর্ক-এর মধ্যে ফাটল এতটা প্রকট হয়ে গেল, তা আমাদের খুব খারাপভাবে নজরে পড়ল। এই রকম তো হওয়ার কথা ছিল না। কেন এমন হল? আমাদের যাপনের সঙ্গে যতদিন ওতোপ্রোত ভাবে নদী জড়িয়ে ছিল, ততদিন নদীর প্রতি আমাদের ভালোবাসা ছিল বেশ প্রবল। সভ্যতা যত আধুনিকতার নামে নদীর থেকে মুখ ফেরালো, তত মানুষ নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সে কথা প্রাজ্ঞ নদী বিজ্ঞানী ইংলিশ সাহেবের লেখাতেও ধরা পড়েছে।

    আমাদের বাংলা নদীর তীর্থ ক্ষেত্র। নদীরা এখানে দেবতার মতন পুজো পায়। যেমন গঙ্গা দেবী হিসেবে পূজিতা হন। অম্বুবাচীতে আত্রেয়ী নদীর জলকে পবিত্র জল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মঙ্গল কাব্যের বর্ণনাতে সতী লক্ষ্মী বেহুলার ভেলা যে সব নদীর পথ ধরে ভেসে গেছে, তাদের জলকে পবিত্র হিসেবে মানুষেরা বিশ্বাস করে। যেমন বেহুলা নদী। গঙ্গা নদীর ছেড়ে যাওয়া পথগুলো বুড়ি গঙ্গা, কাটি গঙ্গা, ছাড়ি গঙ্গা কিংবা আদি গঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে। গঙ্গার সমতুল্য পবিত্র হিসেবেই ধরা হয় নদীগুলোকে।

    নদীদের সঙ্গেই আবার জুড়ে থাকে নানা ধর্মীয় কথা বা উপকথা। আমাদের যাপনের কথাগুলোই আসলে জুড়ে আছে উপকথার সঙ্গে। তাই তো উপকথাগুলোর বিশ্লেষণে খুঁজে পাওয়া যায় স্থানীয় ইতিহাস ও ভূগোলের অনেক উপাদান। ছোটো-বড়ো নদী বাংলার ইতিহাস রচনাতে যে বিপুল ভূমিকা পালন করে, সেকথা আমাদের জানিয়েছিলেন ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়। এমন নদী-জপমালার ধৃত পান্তরে কত ‘উগ্র নদী’ তার স্রোতের ক্ষিপ্রতা হারিয়ে সবুজ ক্ষেত্রর মাঝে চাষের জমি হয়ে হারিয়ে যায়। সময়ের সঙ্গে নামটাও হারিয়ে যায় মানুষের মন থেকে। যেমন মুর্শিদাবাদের বিংদহ, বালুরঘাটের ভাঙাডিহিডাংরা নদী। এদের খুঁজে পাওয়া যায় কেবল মাত্র মানচিত্রে। বাস্তবে তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। বাংলার নদী-রা যে আজ খুব অসুস্থ। অসুখের বীজ অনেক গভীরে। বাংলার ছোটো নদীরা যতটা না প্রাকৃতিক কারণে অবলুপ্ত হয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি ‘মনুষ্যসৃষ্ট’ কারণেই হারিয়ে গেছে কিংবা হারিয়ে যেতে বসেছে।

    যত দিন যাচ্ছে মানুষ আর নদীর সম্পর্ক-এর মধ্যে ফাটল এতটা প্রকট হয়ে গেল, তা আমাদের খুব খারাপভাবে নজরে পড়ল। এই রকম তো হওয়ার কথা ছিল না। কেন এমন হল? আমাদের যাপনের সঙ্গে যতদিন ওতোপ্রোত ভাবে নদী জড়িয়ে ছিল, ততদিন নদীর প্রতি আমাদের ভালোবাসা ছিল বেশ প্রবল।

    এই রকমই এক হারিয়ে যাওয়া নদী ইন্দ্রাণী। এখন যদিও নদীটার কোনো অস্তিত্ব নেই, তাতে কী! এক সময় তো ছিল। কবি বিপ্রদাসের মনসামঙ্গল কাব্যে আমরা এই নদীর উল্লেখ পাচ্ছি। সেখানে লেখা হচ্ছে –“ইন্দ্রাণী বাহিয়স নদীয়ায় উপনীত।/ অম্বুয়া বাহিয়া গিয়া চাপাএ বুহিত।।” অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে ইন্দ্রাণী নদী পথে চাঁদ সদাগর নবদ্বীপে পৌঁছালেন। যদিও ইন্দ্রাণী নদীর অস্তিত্ব নিয়েই অনেকের প্রশ্ন রয়েছে। অনেকে বলেন এই নদী বলতে একটি নগরকেই মঙ্গল কাব্যের কবি বোঝাচ্ছেন। কিন্তু কিটচিন সাহাবের তৈরি মানচিত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি একটি নদীর ধারা এসে নবদ্বীপের কাছে গঙ্গাতে মিশছে। এই ধারাটি বর্তমানে অজয় নদী। অনেক ঐতিহাসিকের মতে ইন্দ্রাণী নদীর তীরে ইন্দ্রশ্বর ঘাট ছিল বিকিহাটের কাছে। তবে উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাব ভাগীরথীর একটি ধারা ব্রাহ্মণী নদীর সঙ্গে এসে মিশেছিল। এই ধারাটি আসলে হারিয়ে যাওয়া নদী ইন্দ্রাণী।

    আরো এক হারিয়ে যাওয়া নদী সিঙ্গটিয়া। এই নদীটির নাম প্রথম আমরা জানতে পারি বল্লাল সেনের নৈহাটি তাম্র শাসনে। এছাড়াও বিপ্রদাস পিপলাইয়ের মনসামঙ্গল কাব্যেও এই নদীর কথা আমরা খুঁজে পাই। সিঙ্গটিয়া নদীর পাড়ে ছিল এক প্রাচীন গ্রাম। বর্তমান নাম বালুটে। বালুটে গ্রামের প্রাচীন নাম ছিল বাল্লহিট্টা। ইতিহাস থেকে জানা যায় এই গ্রামটিকে দান করা হয়েছিল ওবাসুদেব শর্মনকে। কেন জানেন? রাজমাতা বিলাসদেবী ‘হেমাশ্ববাদ’ যজ্ঞ করেন। আর সেই যজ্ঞে পৌরহিত্য করেছিলেন ওবাসুদেব শর্মন। তাই রাজমাতা ওবাসুদেবকে দান করেছিলেন এই গ্রাম। এই নদীটার আজ আর কোনো অস্তিত্ব নেই। শুধু আছে তার সম্পর্কে ইতিহাসটুকু।

    এমন ভাবেই নদী হারিয়ে গেলে হারিয়ে যায় ইতিহাস ও জীবনের কথা। তাই নিজেরা বাঁচতে ও সভ্যতাকে বাঁচাতে ছোটো নদীদের বাঁচিয়ে রাখা খুব প্রয়োজন।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @