No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ভারতীয় হয়ে উঠেছিলেন যে আইরিশ সৈনিক

    ভারতীয় হয়ে উঠেছিলেন যে আইরিশ সৈনিক

    Story image

    আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগেকার কথা। পলাশীর যুদ্ধের পরে বাংলার নব্যশক্তি রূপে উদয় হয়েছে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৭৫৭ সাল থেকে ১৮৫৮ সাল অবধি চলবে কোম্পানির শাসন। তারপর ইতিহাসের পালা বদল, কোম্পানির শাসনের অবসান, খোদ ইংল্যান্ডেশ্বরীর শাসন ভার গ্রহণ-- সে এক অন্য গল্প।

    সেই কোম্পানির শাসনের যুগে ধীরে ধীরে বৃহৎ সংখ্যায় সেনা নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। গোরা সিপাইদের সঙ্গে অসংখ্য ভারতীয় সেপাইকেও নিয়োগ করা হয়। অবস্থা এমন দাঁড়ায়, একসময় ব্রিটিশ আর্মির দ্বিগুণ সেনা ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির।

    সেই সময় কলকাতাবাসীরা একটি প্রায় অসম্ভব এবং চমকপ্রদ দৃশ্যের সাক্ষী ছিল। প্রতিদিন সকালে এক নগ্নপদ সুপুরুষ ইউরোপিয়ান সাহেবকে ধুতি, পাঞ্জাবি, উত্তরীয় শোভিত হয়ে, কপালে রক্তচন্দনের টিকা লাগিয়ে গঙ্গা স্নানে যেতে দেখা যেত। সাহেবের সঙ্গে থাকত এক চমৎকার কৃষ্ণ বিগ্রহ।

    ভারতীয়রা অবাক বিস্ময়ে দেখত গঙ্গায় দাঁড়িয়ে সাহেব অতি যত্নে গোপালের অঙ্গ মার্জনা করছেন। গঙ্গার ঘাট পাহারা দিচ্ছে ফিরিঙ্গি সেনা, ভারতীয়রা দূর থেকে দাঁড়িয়ে সাহেব ও তাঁর গোপালের স্নানদৃশ্য দেখছে। কিন্তু আস্তে আস্তে তামাশা বদলে গেল ঔৎসুক্যে। কী অসম্ভব যত্ন করে সাহেব প্রতিদিন গোপালের সেবা করেন, স্নান করান, গা মোছান। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। আরো আশ্চর্য, ঘাটের ফিরিঙ্গি সেনাগুলো আবার এই সাহেবকে সেলাম ঠুকছে। তাহলে এই সাহেব তো কোনো এলেবেলে লোক নয়!

    আজ সেই আশ্চর্য সাহেবের গল্প শোনাচ্ছি। চার্লস স্টুয়ার্ট-- জন্মসূত্রে আইরিশ(১৭৫৮ – ৩১ মার্চ, ১৮২৮)। পিতা পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ টমাস স্মিথ, মাতার নাম এলিজাবেথ। মাত্র ১৯ বছর বয়সে(১৭৭৭) সেই যে সেনাবাহিনীর চাকরি নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন, তারপর প্রায় আমৃত্যু এই দেশকে ভালবেসে এখানেই থেকে যান এবং আমাদের কলকাতাতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কেবলমাত্র ২৭ জুন ১৮০৪ থেকে ৬ ডিসেম্বর ১৮০৯ অবধি তিনি সেনাবাহিনীর কাজে বাংলার বাইরে ছিলেন। মৃত্যুর সময় তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল।

    যখন নব্য ভারতীয়রা ইউরোপকে অনুসরণ করছে, অনেকেই খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করছে, তখন কীসের জন্য এই সাহেব দেশীয় আদব কায়দা, চালচলন গ্রহণ করে ভারতীয়দের থেকেও বেশি ভারতীয় হবার চেষ্টা করছেন? বড়ই আশ্চর্য, না?

    শুধু কি তাই, তিনি ভারতীয় সিপাইদের উৎসাহ দিতেন, খাঁটি ভারতীয় সাজে সজ্জিত হবার জন্য। তাদের গালে গালপাট্টা ও রাজপুত রাজপুরুষদের মতন গোঁফ রাখতে বলতেন। উপদেশ দিতেন ভৃত্য সদৃশ না হয়ে থাকতে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উচ্চপদস্থ সেনা অফিসার হয়েও তিনি সেনাবাহিনীর মধ্যে ভারতীয় সিপাই এবং গোরা সিপাইদের মধ্যে বৈষম্যের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন।

    এই সমস্ত কারণে একবার কোম্পানি তাঁকে চাকরি থেকে সাসপেন্ড করে। কিন্তু ভারতীয় সিপাইদের মধ্যে তাঁর অসম্ভব জনপ্রিয়তার কারণে, পরে এই সাসপেনশন তুলতে বাধ্য হয়, শুধু তাই নয়, তাঁকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়।

    রবিঠাকুরের গোরার সঙ্গে প্রচুর মিল আছে এই বাস্তবের গোরা চার্লস স্টুয়ার্ট এর। যদিও গোরার প্রকাশকাল ১৯১০ সালে। গোরার শরীরে বইছিল আইরিশ সৈনিকের রক্ত আর স্টুয়ার্ট নিজেই তো আইরিশ সৈনিক। গোরার ক্ষেত্রে তার ভারতীয় জাতীয়তাবাদের কারণ সে হিন্দু পালক পিতা মাতার ঘরে মানুষ। কিন্তু স্টুয়ার্ট কী কারণে সেই সময় এক হতমান, পশ্চাদগামী, অন্ধকারাচ্ছন্ন জাতির পাশে সগৌরবে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, সে সত্যি এক বিস্ময়! গোরা যেমন উপন্যাসের আদি ও মধ্যে প্রবল হিন্দু, হিন্দু না হয়েও স্টুয়ার্ট আদি, মধ্য এবং অন্তেও ঠিক তাই। সেজন্য ভারতীয়দের কাছে তাঁর নামই হয়ে গেছিল হিন্দু স্টুয়ার্ট। ইউরোপিয়ানদের কাছেও তিনি এই নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। একই মানুষের দুই সত্তা- জন্মসূত্রে আইরিশ, ভারতে এসে হয়ে উঠলেন প্রায় হিন্দু এবং প্রবলভাবে ভারতীয়।

    তিনি নিয়মিত লিখতেন The Telegraph-এ। সেখানে মেয়েদের প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য পোশাক নিয়ে তাঁর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ভারতীয় শাড়ি নিয়ে তিনি মন্তব্য করেছেন- "elegant, simple, sensible, and sensual".

    এবার আমরা দেখব ইউরোপিয়ান মিশনারিদের সম্মন্ধে তিনি কী বলেছেন- "Hinduism little needs the meliorating hand of Christianity to render its votaries a sufficiently correct and moral people for all the useful purposes of a civilised society."

    এখানেই শেষ নয়। আরো এগিয়ে গিয়ে তিনি বলছেন- "Whereever I look around me, in the vast ocean of Hindu mythology, I discover Piety....Morality.....And as far as I can rely on my judgement, it appears the most complete and ample system of Moral Allegory that the World has ever produced." [ Vindication of the Hindoos (1808)]

    এই কৃষ্ণভক্ত সাহেব, তাঁর প্রিয় গোপাল কে সঙ্গে নিয়েই চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন তাঁর প্রিয় শহর কলকাতার South Park Street Cemeter তে। 

    কিন্তু চমক আছে এইখানেও। আপনারা কি কেউ উনার কবরস্থান দর্শন করেছেন? ধন্দে পড়ে যাবেন- এটি কবর, না কোনো মন্দির? এই সুন্দর কবরটি নিয়ে কিছু বলার লোভ সামলাতে পারছি না।  প্রথম দর্শনেই এটিকে একটি ছোট পঞ্চরত্ন মন্দির বলে মনে হবে। সামনের দিকে বাসল্ট পাথরের চমৎকার অলংকৃত আর্চ। আর্চের কেন্দ্রে একটি অতীব চমৎকার ফোটা পদ্মফুল। কেন্দ্রীয় ডোমকে ঘিরে চারকোনায় আটটি ক্ষুদ্র উড়িষ্যা রেখা দেউল। সব অর্থেই এই অনিন্দ্যসুন্দর ভারতীয় শিল্পকলা সমৃদ্ধ কবরটি এক গর্বিত ভারতাত্মার উপযুক্ত করে তৈরি। এবং এর প্রস্তর ফলকে সংস্কারকারক হিসাবে নাম লেখা আছে শ্রী ও শ্রীমতি ডব্লিউ পি কুপার এবং শ্রী জো উইলসন।

    স্টুয়ার্ট সাহেবের প্রত্নতাত্বিক সংগ্রহগুলি বর্তমানে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা আছে Bridge Collection নামে। শ্রীযুক্ত সোহম চন্দ্রের লেখা থেকে জানতে পারলাম যে স্টুয়ার্ট সাহেব তাঁর জীবদ্দশায় নিজের Wood Street-এর বাড়িতে অসংখ্য প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন নিয়ে একটি চমৎকার মিউজিয়াম গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু সেই জাতপাতের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনগুলিতে এইসমস্ত জিনিস সংগ্রহ করা, বিশেষ করে এক খ্রিষ্টান বিদেশির পক্ষে কী অসম্ভব ব্যাপার ছিল, আজকের দিনে বসে তা কল্পনাও করা যাবে না। কী না গঞ্জনা তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে! চোর অপবাদ তো শুনতে হয়েইছিল, জীবন সংশয় ও হতে পারত। কিন্তু কোনো কিছুই তাঁকে দমাতে পারেনি।

    মৃত্যুর পরে তাঁর উইল মোতাবেক এর অনেকগুলিকে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে এগুলি নিলামে কিনে নেন জনৈক J Bridge। তিনি আবার এগুলি দান করেন ব্রিটিশ মিউজিয়াম-কে। তাই চার্লস বা হিন্দু স্টুয়ার্ট এর সারা জীবনের সংগ্রহ আজ ব্রিটিশ মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হচ্ছে - Bridge Collection নামে।

    অথচ ভারতবর্ষ বাদ দিন, তাঁর সাধের কলকাতা শহরও চার্লস স্টুয়ার্ট-কে ভুলে গেছে।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @