No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ‘বাবা চাইতেন, আমি যেন ভবিষ্যতে কুস্তিগির হই’

    ‘বাবা চাইতেন, আমি যেন ভবিষ্যতে কুস্তিগির হই’

    Story image

    কুস্তি আর বাঁশির মধ্যে কোনই সম্পর্ক নেই, কিন্তু গল্পটা তাই। হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার হয়ে ওঠার গল্প। প্রথম প্রশ্নটা হিন্দিতে করলাম। উত্তর এল বাংলায়। তারপর এই মহান শিল্পীর সঙ্গে সাদামাটা কথাবার্তা হল এইরকম-

    কুস্তির আখড়া থেকে বাঁশির সুরে বুঁদ হলেন কীভাবে?

    জন্মেছিলাম ইলাহাবাদে। আমার যখন ছ’বছর বয়স তখন মা চলে গেলেন। আমার বাবা ছিলেন কুস্তিগির, তিনি চাইতেন আমি যেন ভবিষ্যতে মস্ত বড় কুস্তিগির হই। তিনি নিজেই আমাকে প্রশিক্ষণ দিতেন। ধীরে ধীরে আমি তাঁর শিক্ষায় বেশ দক্ষ কুস্তিগির হয়েও উঠেছিলাম এবং বেশ কয়েকটি কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সফলও হয়েছিলাম। কিন্তু কুস্তি আমার কোনোদিনই ভাল লাগতো না। আমাকে টানতো সুর-তাল-লয় মানে সঙ্গীত। প্রতিবেশী এক ভদ্রলোক নাম পণ্ডিত ভোলানাথ বাঁশি বাজাতেন। লুকিয়ে তাঁর বাড়িতে পৌঁছে যেতাম। তাঁর বাঁশি শুনে শুনে নিজেই বাজাতাম। একদিন তিনি বললেন, বাঃ তুমি তো বেশ সুরেই বাজাও। এরপর তাঁর কাছে তালিম শুরু হল, আমি বাঁশিতেই বুঁদ হয়ে গেলাম।

    আপনার বাবা কি গান-বাজনা একেবারেই পছন্দ করতেন না?

    তখন গান-বাজনার কোনো ভবিষ্যত ছিল না। বলতেন, পড়াশুনা করে একটা চাকরির চেষ্টা কর। বাবার পরামর্শে আমি টাইপও শিখতাম। আর মন দিয়ে বাঁশি বাজাতাম। ম্যট্রিকুলেশনের পর টাইপিস্ট হিসাবে মাসে ৮৫ টাকা বেতনের একটা চাকরিও জুটিয়েছিলাম। দিনে চাকরি রাত জেগে বাঁশি—চলতে থাকল। এইভাবে চলতে চলতে একদিন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে মিঊজিশিয়ানের চাকরি পেলাম।

    আপনার বাবা অবাক হলেন না?

    ভীষণ। জিজ্ঞাসা করাতে বাবাকে সব খুলে বললাম। সব শুনে বাবা কত বেতন জানতে চাইলেন। টাইপিস্টের চেয়ে দ্বিগুণ শুনে খুব অবাক হয়ে গেলেন।

    শুনেছি বাঁশি বাজানোর জন্য আপনি বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন?

    হ্যাঁ, আমার টাইপিস্টের চাকরিটা ছিল উড়িষ্যায়। চলে গিয়েছিলাম মন দিয়ে বাঁশি বাজাব বলেই। ফিরেছিলাম বাবা মারা যাবার পর।

    আলাঊদ্দিন খাঁ সাহেবের সঙ্গে আপনার দেখা হওয়ার কথা যদি বলেন...

    তাঁকে আমি চিনতাম জানতাম না। আমার এক বন্ধু বলেছিল তিনি মস্ত কলাকার। তখনও হাফপ্যান্ট ছাড়িনি, তো গেলাম একদিন তাঁর কাছে। তিনি কাছে ডাকলেন, গিয়ে প্রণাম করলাম, বললেন কিছু খাবে, না বললাম। তিনি বললেন, তাহলে একটু বস আমি সিগারেট টেনে আসি। ফিরে এসে বললেন, বাজাও, আমি তো খুব লজ্জা পাচ্ছি। তিনি আবার বললেন, যা পারো বাজাও। আমি একটু ইমন বাজালাম, তিনি এরপর বেহালা বাজিয়ে শোনালেন। অমন বাজনা আর শুনিনি। তিনি বললেন, শিখতে চাইলে আমার মেয়ের কাছে যেও।

    এরপরই কি মুম্বাই চলে গেলেন?

    আমি মুম্বাই যাই ১৯৬০ সালে, একটা হিন্দি ছবিতে ওড়িশি নাচের সঙ্গে বাঁশি সঙ্গত করতে হয়েছিল। এরপর একটি ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে বাজাই। সবাই খুব পছন্দ করেছিল, সেই সুবাদে খানিকটা পরিচিতি পেলাম। রেডিওতে তখন বাঁশি শিল্পীর একক হতই না বলা যায়। কিন্তু আমি মুম্বাইতে সেই সুযোগ পেয়েছিলাম। মুম্বাইতে মাস দুয়েক চাকরি করি তারপর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকে পড়ি। পরিচিতি পাওয়ার পর সিনেমা পরিচালকরা আমায় তখন ডাকাডাকিও করত। ওই সময়েই আমি ওস্তাদ আলাঊদ্দিন খাঁর মেয়ে সুরবাহারের কিংবদন্তি শিল্পী অন্নপূর্ণা দেবীর সান্নিধ্য লাভ করি। তিনিই আমার গুরুমা।

    অন্নপূর্ণা দেবীর যে ডিসিপ্লিন সেটা তো সরোদ বা সেতার বাদনের, আর কারও সান্নিধ্য বা তালিম নেননি?

    আমি পণ্ডিত রাজা রামের কাছে কণ্ঠসঙ্গীতের তালিম নিয়েছি। তিনি আমার প্রথম গুরু, উনি আমার কান তৈরি করে দিয়েছেন। আমি তো এখনো কণ্ঠসঙ্গীতের অনুশীলন করি আর সেটাই বাঁশিতে বাজিয়ে আপনাদের শোনাই। অন্নপূর্ণা দেবী আমাকে শিখিয়েছেন সুরের প্রক্ষেপন, সুরের আবেগ, সুরের কারুকাজ, সুরের ওঠানামা এবং অবশ্যই গায়কী বা সংগীত পরিবেশন রীতি, গৎকারি (সেতার বা সরোদ বাদনের শৃঙ্খলা)। আমি মনে করি একজন বাঁশিবাদক যন্ত্রবাদন-তাল-ছন্দ ইত্যাদি গভীরভাবে আয়ত্ত না করতে পারলে শিল্পী হয়ে উঠতে পারে না। এজন্য ধ্রুপদ স্টাইল শিখতেই হবে। খেয়াল করবেন আমার বাজনায় সুরের ধারায় আমি বিভিন্ন স্ট্রোক উপস্থাপন করি। গুরুমার কাছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি সুরের অবরোহণ, প্রক্ষেপণ শিখেছি।

     

    এখনো দিনে কতক্ষণ অনুশীলন করেন?

    কতক্ষণ কী বলছেন, আমি তো সারাক্ষণই অনুশীলনের মধ্যে আছি। এটাই তো আমার সাধনা। বাঁশি বাজানো তো একটা মেডিটেশন কিম্বা বলতে পারেন ধ্যান।

    বাঁশি বাজানোর সময়ে শ্রোতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন কীভাবে?

    আমি ঈশ্বরভক্ত মানুষ, আমি যেখানেই যাই না কেন সঙ্গে করে ছোট্ট একটা মন্দির নিয়ে যাই, মন্দিরটা আমার বাক্সর মধ্যেই থাকে। আমি ঈশ্বরের কাছে নিবেদন করি। তিনিই আমাকে সুর দেন। আমি বাঁশি বাজাই না প্রার্থনা করি। আমার প্রার্থনা যখন শ্রোতাদের হৃদয় ছুঁয়ে ফেলে তখন তাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ তৈরি হয় একটা সম্পর্কও তৈরি হয় যেটা আত্মিক সম্পর্ক।

    আপনার জীবনস্মৃতি লিখবেন না?

    >আমি একটা ছোট্ট এবং সাধারণ মানুষ কী এমন স্মৃতি আছে আমার জীবনে যে বলব বা লিখে জানাব। আপনি তো জানেন সুরজিৎ সিং woodwinds of change নামে আমার উপর একটা বই লিখেছিল, ২০০৮সালে সেটা বেড়িয়েছিল, তারপর Henry Tarnier নামে একজন Hariprasad chowrashisia and the art of improvisation এই নামে একটা বই লেখে। আরও লেখালেখি হয়েছে চলছেও... খুব দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না।

    আপনার জীবনে কোনো না পাওয়া কি আপনাকে কষ্ট দেয়?

    না আমার জীবনে অপ্রাপ্তি কিছু নেই। এই জীবন বহু মানুষের ভালবাসায় আর সম্মানে ধন্য। আমি বাঁশি বাজালে মানুষ শোনে, তারিফ করে। এরপরও কি বলতে পারি যে এই হলে ভাল হত, ওটা পেলাম না...

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @