“সাধারণ মানুষের প্রয়োজনেই বানিয়ে ফেলি নানান যন্ত্র”

প্রচারের বৃত্তে না এসে প্রত্যন্ত গ্রামেগঞ্জে কীভাবে বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাজে লাগানো যায়, সেই নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নিরলস গবেষণা করে চলেছেন ‘বিজ্ঞানকর্মী’ অনিরুদ্ধ দে। দেশীয় পদ্ধতিতে বানিয়ে ফেলেছেন রিক্সা-অ্যাম্বুলেন্স, সোলার গিজার, সোলার ড্রায়ার, নতুন ধরনের ওয়াটার পিউরিফায়ার এবং আরও অনেক বিচিত্র সব যন্ত্র। সেই আশ্চর্য মানুষটি এই প্রথম বার গণমাধ্যমে মুখ খুললেন ‘বঙ্গদর্শন’-এর প্রতিনিধি শ্রেয়ণের কাছে। আজ রইল তাঁর সাক্ষাৎকারের প্রথম অংশ।
• বিজ্ঞানের প্রতি আপনার ভালোবাসা কীভাবে তৈরি হল?
তখন আমার বয়স চার বছর। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার কাজে ১৯৬৭ সালে একটা বিজ্ঞান ক্লাব করেছিলেন গোবরডাঙার মানুষরা। ভারতবর্ষের বিজ্ঞান ক্লাব আন্দোলনের ইতিহাস যদি দেখা যায়, এই ক্লাবটাকে তার একটা পথিকৃত বলা যেতে পারে। এই ক্লাব তৈরির ক্ষেত্রে আমাদের পরিবার যুক্ত ছিল। ছোটোবেলা থেকেই যখন আমরা হাঁটতে শিখি, কিছু করতে শিখি, তখন থেকেই ওটাকে বানিয়ে দেওয়া হল আমাদের হবি সেন্টার। বাচ্চাদের যেমন খেলতে পাঠানো হয়, ছবি আঁকতে পাঠানো হয়, ঠিক সেই রকমই ওখানে আমাদের যেতেই হত। এভাবেই বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার কাজে আমার হাতেখড়ি।
• স্কুল জীবনে প্রবেশ করার পর বিজ্ঞানচর্চার কতটা সুযোগ পেলেন?
আমি যেই স্কুলে পড়েছি সেই স্কুলও বিজ্ঞান ক্লাবের কাছে ভীষণভাবে উপকৃত। যার ফলে আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, তখন ইস্টার্ন ইন্ডিয়া সায়েন্স ক্যাম্প, যেটা হত বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজিয়ামে, সেখানে মডেল নিয়ে আমার যাতায়াত ছিল। সেখান থেকে পুরস্কার পাওয়া, তারপর নেহরু চিলড্রেন্স মিউজিয়ামে রাজ্য স্তরের বিজ্ঞান প্রদর্শনে যোগ দেওয়া, পুরস্কার পাওয়া এবং সেখান থেকে দিল্লির জাতীয় বিজ্ঞান মেলাতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়ে গেল। রাজ্য স্তরে বিজ্ঞান প্রদর্শনে যারা পুরস্কার পায়, তারা দিল্লির মেলাতে যেতে পারে। এইভাবে নিজের গ্রাম থেকে জেলা, রাজ্য, পূর্ব ভারত এবং সর্বভারতীয় স্তরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। তাতে ভালো লেগেছে, বিজ্ঞানের প্রতি উৎসাহ বেড়ে গেছে আরও। অনেক বড়ো বড়ো যেসব বিজ্ঞানী তখন বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার কাজে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তাঁদের চিনেছি, কথা শুনেছি। ভালো লাগাটা চলে গেছে আরও গভীরে।
আরও পড়ুন
ভোটের আসর মাতাচ্ছেন যশোরের হরবোলা
• বিজ্ঞানকে মানুষের কাজে লাগানোর কথা কখন থেকে ভাবা শুরু করলেন?
আমি অ্যানথ্রোপলজি নিয়ে পড়াশোনা করেছি। বাংলায় যাকে বলা হয় মানববিজ্ঞান। এই বিষয়টাই এমন। মানুষকে জানতে হয়, বুঝতে হয়, নইলে ওই পড়াটার কোনো দাম থাকে না। যখন আমি মানুষকে জানছি, বুঝছি, তখন তাদের ট্র্যাডিশনাল নলেজ সিস্টেমে কী ভ্যালু অ্যাডিশন দরকার, এই নিয়ে বোধও আমার তৈরি হচ্ছে। তখন আমার মনে বারবার প্রশ্ন জেগেছে, মানুষকে আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি। এসব করতে করতেই চাকরির জীবনে আসা। ছোটোবেলায় আমার ঝোঁক ছিল বিজ্ঞানের নানা মডেল তৈরি। প্রজেক্ট তৈরি। চাকরি করতে এসে মনে হল, আসলে যে মানুষগুলোর সঙ্গে কাজ করছি, যে মানুষের জন্য কাজ করছি, সেখানে ওই অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স খুব উপযোগী। এখন সাধারণ মানুষের প্রয়োজনেই বানিয়ে ফেলি নানান যন্ত্র।
• অর্থাৎ আপনার পেশাই আপনাকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে এল?
আমি ছিলাম কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট কন্সালট্যান্ট। এক সময় চাকরি করতাম। চাকরি ছেড়ে দিয়েছি ২০০০ সালে। তারপর আমি অর্থ রোজগারের জন্য ফ্রিল্যান্স কন্সালট্যান্ট হিসেবে কাজ করতাম। তখন মনে হল, মানুষের জন্য কাজ করতে একটা প্ল্যাটফর্ম দরকার। সেই প্ল্যাটফর্ম আমাকে জোগান দিল ‘প্রিজম’। আমার কিছু বন্ধুবান্ধব, যাদের একই ধরনের মানসিকতা, তারা মিলে এই ‘প্রিজম’ নামের সংগঠন তৈরি করেছিল বিজ্ঞানকে সিলেবাসের বাইরে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে। ‘প্রিজম’-এর প্ল্যাটফর্মে আমি বিজ্ঞানকে মানুষের কাজে লাগানোর জন্য গবেষণাগুলো করতে পারি। তৃণমূল স্তরের যেসব গ্রামের মানুষরা রয়েছেন, তাদের প্রয়োজনগুলো আমি উপলব্ধি করতে পারি ‘প্রিজম’-এর মাধ্যমে। আবার ধরুন, উন্নত পানীয় জল সরবরাহের ওপর এখন এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের একটা প্রোজেক্ট চলছে পশ্চিমবঙ্গের তিনটে জেলায় – উত্তর ২৪ পরগনা, বাঁকুড়া আর পূর্ব মেদিনীপুর। আর্সেনিক, ক্লোরাইড, আয়রন, ব্যাকটেরিয়া মুক্ত পানীয় জল নিয়ে আমি কাজ করছি ৮০-র দশক থেকে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের এই প্রোজেক্টে আমি আবার পানীয় জল নিয়ে কাজ করার সুযোগ পেলাম। এই প্রোজেক্ট চলছে পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইরেক্টরেটের মাধ্যমে। গোটা কাজকে সুচারুভাবে পরিচালনা করতে ওরা একটা টিমকে দায়িত্ব দিয়েছে। কন্ট্রাকটাররা কাজ করবে, কিন্তু তাদের ডিজাইন ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা দেখা, সামাজিক বিষয়গুলো দেখা, পরিবেশগত দিকগুলো দেখা, সেটা ওই টিমের দায়িত্ব। সেখানে আমি সোশ্যাল, জেন্ডার এবং রিসেটলমেন্ট – এই তিনটে বিষয়ের বিশেষজ্ঞ হিসেবে এখন কাজ করছি।
(চলবে)
ছবি কৃতজ্ঞতা – অনিরুদ্ধ দে, স্বর্ণেন্দু সরকার।