No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    গল্পের ভিতরেও ফিজিক্সের অনিশ্চয়তা খুঁজে পায় আত্রেয়

    গল্পের ভিতরেও ফিজিক্সের অনিশ্চয়তা খুঁজে পায় আত্রেয়

    Story image

    কলকাতা থেকে সুদূর ইউরোপ। উচ্চতর পড়াশোনার ফাঁকেই চলছে লেখালিখি। বাংলা ভাষাতেই। তার কাছে আখ্যান বা ন্যারেটিভও অনেকটা এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্সের মতো। সেখানেও থাকে অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি, বাঁক। সাহিত্য আর বিজ্ঞান তাই মিলেমিশে যায় এই ছেলেটির ভাবনায়। বলা ভালো, সমাপতিত হয়। ছেলেটির নাম- আত্রেয় মজুমদার। প্রেসিডেন্সি থেকে স্নাতক-স্তরের পড়াশোনার পাট চুকিয়ে নেদারল্যান্ডসের গ্রনিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ি জমিয়েছে সে। উদ্দেশ্য, ‘টপ মাস্টার ইন ন্যানো সায়েন্স’ হওয়া। অনেক ভারতীয় ছাত্রই তো বিদেশ-বিভুঁইতে পড়তে যায়। কিন্তু আত্রেয়র ব্যাপারটা খানিক আলাদা। প্রতিবছর সারা পৃথিবী থেকে মাত্র ১৪ জনকে বেছে নেয় এই বিশ্ববিদ্যালয়। সেই ‘ছোট্ট’ মেধাতালিকাতেই জায়গা করে নিয়েছে কলকাতার আত্রেয়। গর্বের ব্যাপার নিঃসন্দেহে।

    ন্যানো সায়েন্স বা টেকনোলজির মতো এমন প্রায়োগিক একটা বিষয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়াশোনার সুযোগ খুব বেশি জায়গায় নেই। নেদারল্যান্ডসের এই বিশ্ববিদ্যালয় সে-দিক থেকে ব্যতিক্রম। তাছাড়া, এখানকার গবেষণার মানও খুব উন্নত। ২০১৬ সালে কেমিস্ট্রিতে নোবেল পুরস্কার-প্রাপক বেন ফেরিঙ্গাও এই বিশ্ববিদ্যালয়েই গবেষক।

    ভবিষ্যতে গবেষণা করতে চায় আত্রেয়ও। ন্যানো টেকনোলজি এর আগে ব্যবহৃত হয়েছে কম্পিউটার-সহ নানা প্রযুক্তিকেই আরও ছোট, আরও সহজে বহনক্ষম করে তোলার ক্ষেত্রে। তবে, আপাতত আত্রেয়র পড়াশোনার অন্যতম ক্ষেত্র-- মানুষের মস্তিষ্কের কাজকে ন্যানো-সায়েন্সের বিশ্লেষণের আওতায় এনে কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত করা যায়--- তার খোঁজ। এর পোশাকি নাম নিউরো-মরফিক কম্পিউটিং। মানে, মানুষের মস্তিষ্কের মতো করে কম্পিউটারের ভাষা ও অ্যাপ্লিকেশনকে ব্যবহার করা। ‘এই গোটা ফিল্ডটাই প্রাথমিক স্তরে আছে’—বলছিল আত্রেয়। আর, এখানেই এই বিষয়ে পড়াশোনা-গবেষণার চ্যালেঞ্জটাও লুকিয়ে।

    গ্রনিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়

    বিজ্ঞানের পাশাপাশি লেখালিখিও সমানভাবে আকর্ষণ করে তাকে। গল্প লিখতে ভালো লাগে। আর, আখ্যান বা ন্যারেটিভ লেখার ক্ষেত্রেও তার পছন্দ ‘এক্সপেরিমেন্ট’। গল্প লেখাও তো আসলে একধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষাই। কেউ জানে না কী অপেক্ষা করে আছে গন্তব্যের শেষে। আত্রেয়র ভাষায় ‘এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্সের মতো এক্সপেরিমেন্টাল ন্যারেটিভ’। নিজের লেখা ‘অণু গল্পে’ও এই অপ্রত্যাশিতকে বোনার চেষ্টা থাকেই। বিদেশে পড়তে গিয়ে বাংলা ভাষাকে নিয়ে একধরনের অভাববোধ ঘন হয়েছে। সেই অভাববোধই যেন আরো বেশি করে লিখিয়ে নিচ্ছে তাকে দিয়ে।

    বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে কল্পবিজ্ঞানের গল্পও ভালো লাগে আত্রেয়র। প্রফেসর শঙ্কু পড়ে বড়ো হয়ে ওঠা। কিন্তু তার মতে, অধিকাংশ কল্পবিজ্ঞানের গল্পই প্রকৃত-বিজ্ঞান থেকে বিচ্ছিন্ন। বেশিরভাগই খুব অপরিণত। বিজ্ঞানে যে ঘটনাগুলো ঘটে, সেগুলোকে হয় ভুল বুঝে, ভুল ব্যাখ্যা করে কিংবা খুব জোলো সরলীকরণ করে কল্পবিজ্ঞান লেখা হয়। ‘ইন্টারস্টেলার’ সিনেমাটা বানানোর সময় যেমন একজন নোবেল পাওয়া পদার্থবিদের গবেষণাকে ব্যবহার করেছিলেন ক্রিস্টোফার নোলান। আত্রেয়র মতে, এই সততার জায়গায় পৌঁছানো উচিত কল্পবিজ্ঞান লেখার আগে। তবে, এই জাতীয় গল্প লেখা যে বেশ কঠিন, তা মেনে নিচ্ছে সে। খাঁটি বিজ্ঞান, অথচ সবার বোধগম্য হবে। পড়েও ভালো লাগবে। সহজ নয় বলেই আপাতত কল্পবিজ্ঞানের গল্প-লেখায় হাত দিতে চায় না আত্রেয়। বিজ্ঞানের বাইরের জগৎ নিয়ে লেখালিখিতেই আপাতত স্বচ্ছন্দ তার কলম।

    বঙ্গদর্শনের জন্য নেদারল্যান্ডস থেকে তেমনই কয়েকটা লেখা পাঠিয়েছে আত্রেয়। তার ইউরোপ-বাসের নানা মুহূর্ত, ভাবনা, দৃশ্যর কোলাজ। মেজাজটা  ‘আত্মকথা’র, অথচ খণ্ড-আখ্যানেরও। এখানেও হঠাৎ হঠাৎ কাঙ্ক্ষিত পরিণতির থেকে ছিটকে যাওয়া টের পাবেন পাঠক। এই দীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকা স্মরণে থাকলে হয়তো বুঝতে পারবেন, লেখকের অবচেতনের বহমান চিন্তাস্রোত, লেখার দর্শন। যে স্রোত সাহিত্যের ন্যারেটিভে খুঁজে পায় ফিজিক্সের অনিশ্চয়তা, খোঁজ। বাকিটা বিচারের ভার পাঠকেরই হাতে। নিচে রইল আত্রেয়র লেখা।

    ইউরোপ-প্রবাসীর আত্মকথা 
    নতুন ডায়েরির প্রথম পাতা

    ১। ‘আমি তুমাকে ভালোবাসি।’

    কিংকর্তব্যবিমূঢ় শব্দটার মানে অনেক কাল আগেই জেনেছি। কিন্তু অনুভূতিটা কেমন হয় তা টের পেলাম আজ; যখন এক নেপালি ভদ্রলোক আমি কলকাতায় থাকি শুনে আমাকে প্রেম নিবেদন করে বসলেন। তাও নেদারল্যান্ডের গ্রনিঙ্গেন শহরে বসে।

    অচেনা অজানার কাছ থেকে প্রেমে নিবেদিত হওয়া এক অনন্য অনুভূতি। নতুন মহাদেশের নতুন বাড়ির রান্নাঘরে বসেও যখন সেখানকার মানুষগুলোর মধ্যে নিজের পাড়ার বা কলেজের বন্ধুদের খুঁজে পাই তখন অনেকটা মনে হয় যেন কোনও ইতালিয়ান রেস্টুরেন্টের উপাদেয় খাবারের মধ্যেও কলেজ ক্যান্টিনের আলুর দমের স্বাদ পাচ্ছি।

    গ্রনিঙ্গেনকে পেলাম এভাবেই। আমার সাত-তলার ১৩ স্কোয়ার মিটারের ঘর থেকে দূরে দেখা যায় অনেক দূর। আজকে আকাশ বেশ মেঘলা। মনটাও। আর সেই মেঘের ফাঁকে উঁকি দেয় অনেক ফ্ল্যাটবাড়ি মারটিনি টাওয়ার, প্রেসিডেন্সি আর হাওড়া ব্রিজ।

     

    ২। পাশবালিশ এবং বিদেশ যাত্রা।

    বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে মেয়েরা বিশ্বের যেখানেই যাক না কেন, দুটি জিনিসের সঙ্গে নিজেদের জড়াতে খুব ভালবাসে। এক হল রবীন্দ্রনাথ; আর অন্যটি-- পাশবালিশ।

    বিদেশে থাকার সমস্ত অসুবিধা, নিরাপত্তাহীনতার প্রতীক যেন হয়ে ওঠে শুধুমাত্র এই একটি সমস্যা: পাশবালিশের অভাব। ঠিক যেমন লুচি তরকারির অভাবটা বার্গার, স্মুদি দিয়ে ঠিক মেটেনা, সেরকমই বাঙালি পোলাপানদের বিবিধরকমের পাশবালিশের প্রতিস্থাপনের প্রচেষ্টাও বৃথা যায়। 

    তাই বিদেশ যাত্রার প্রাক্বালে সব বঙ্গবাসীদের দু'বার ভাবা উচিত এই সমস্যার কথা। এই সমস্যা নিয়ে যদি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করতে যাই আমরা, তাহলে দেখব এর জন্য মূলত দায়ী একটি কারণ। আমাদের ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার মধ্যে আমরা পরনির্ভরশীল এবং অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হই। কিন্তু সেগুলোর সম্মুখীন হওয়ার বদলে আমরা পাশবালিশ জড়িয়ে শান্তির ঘুম দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

    আর সেই সব-ভোলা ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন-ও দেখি পাশবালিশ জড়িয়ে গভীরতর ঘুমের। সেই ঘুমেও স্বপ্ন দেখি...

    বঙ্গজীবনে এই চমৎকার চোঙ inception-এর ভুলে যাওয়া আবিষ্কর্তাকে তাই জানাই প্রণাম এবং বিশ্বায়নের প্রভাবে নেদারল্যান্ডের বাজারেও এর আবির্ভাব শীঘ্র ঘটবে, এই আশাই রাখি।

    ৩। ঘুড়ি এবং রবীন্দ্রনাথ

    অবুঝ মন গ্রনিঙ্গেনের আকাশেও ঘুড়ি খুঁজে বেড়ায়। দূরের স্কাইলাইনে কিছু পথ-হারানো পাখি দেখতে পাই। হঠাৎ দেখে চমকে উঠেছিলাম ঘুড়ি ভেবে।

    গ্রনিঙ্গেন আমাকে প্রতিনিয়ত দিচ্ছে নতুন বন্ধু, নতুন পরিবার। পুরনো বন্ধু, বাড়ির মানুষগুলোর সঙ্গে মাঝে মাঝে কথা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে। সব কিছুর মাঝে একা লাগেনা। তবু বাংলার আকাশটার কথা খুব মনে পড়ে। শরতের সেই চেনা আকাশটা। যা নিয়ে ক্লাস টু-তে করা বাক্য রচনাটা আজও মনে পরে যায়। নীল আকাশে পেঁজা তুলর মতন সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। সেই আকাশ মাঝে মাঝে দেখা দেয় এখানেও-- কিন্তু তাতে ঘুড়ি নেই, নেই প্রাক-পুজোর সেই শিউলি মাখা গন্ধটা।

    তবু মাঝে মাঝে তার দেখা পাই রবি ঠাকুরের গানগুলো যখন ভেসে আসে ল্যাপটপ থেকে। তখন এই শীতের দেশেও শরৎ তার অরুণ আলোর অঞ্জলি বিছিয়ে দেয়। দেড়শো বছর আগে আট হাজার কিলোমিটার দূরে বসে লিখে যাওয়া গানটা আবারো মনে করিয়ে দেয়-- শরত সবসময় আমার প্রিয় ঋতু ছিল।

    গ্রনিঙ্গেন জুড়ে অনেক খাল। সেখানে প্রচুর নৌকো-জাহাজ এসে ভিড় করে। তাদের দিকে তাকিয়ে মনের নীল আকাশের বন্দরে ভিড় করে ছেলেবেলার দুর্গাপুজোর যত স্মৃতি।

    খাদ্যপ্রিয় এই বাঙালি ছেলে তাই অন্তত কলকাতার রসনা আহ্লাদ মিটিয়ে নিল এখানে বসেই। লুচি-আলুরদম, পোলাও-মাংসের আনন্দে কিছুটা তৃপ্ত হয় মন।

    অন্তত মনের কাশফুলগুলো আনন্দে আন্দোলিত হয়।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @