বেলঘরিয়ায় শিল্প স্থাপনের ইতিহাস

উনিশ ও বিশ শতকে, গঙ্গার দুই তীরে প্রচুর ভারী ও ক্ষুদ্র শিল্পের কারখানা গড়ে উঠেছিল। প্রধানত কাঁচামালের সরবরাহের সুবিধাই এর প্রধান কারণ। বেলঘরিয়া গঙ্গার তীরে অবস্থিত না হলেও, প্রথমদিকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও পরবর্তীকালে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে বেশ কিছু কারখানা প্রসার লাভ করে। অধিকাংশই অবশ্য টিকে থাকেনি বেশিদিন। তবে কারখানাগুলি স্থাপনের ফলে, বেলঘরিয়ার গুরুত্ব অনেকটাই বেড়ে যায়। স্থানীয় মানুষের পাশাপাশি, বাইরে থেকেও শ্রমিক’রা এসে বসবাস শুরু করে।
১৮৯২ সালে, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় নস্যি তৈরির জন্য ‘এমারেল্ড স্নাফ মিল’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আজও তাঁর বাড়ি ‘নস্যিবাড়ি’ নামেই পরিচিত এবং সংলগ্ন রাস্তার ‘স্নাফ মিল স্ট্রিট’ নাম পুরনো সেই স্মৃতিই বহন করে চলেছে। ১৯০৬ সালে বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় ও তারকনাথ মুখোপাধ্যায় ‘জুবিলি আয়রন ওয়ার্কস’ নামে একটি কারখানা খুলেছিলেন। পরবর্তীকালে সেটি ‘বেলঘরিয়া ফাউন্ড্রি ওয়ার্কস’ নামে পরিচিত হয়। ১৯০৮-এ ‘পাইনওয়ার নিব অ্যান্ড সিগারেট ওয়ার্কস’ নামে আরেকটি কারখানা খোলা হয়েছিল বেলঘরিয়ায়(পরবর্তীকালে হাতবদল হয়ে এর যন্ত্রপাতি ‘সিজারস্’ সিগারেট কম্পানির হাতে যায়)। এই কারখানায় উৎপন্ন সিগারেটের নাম ছিল ‘পিন হেড ব্র্যান্ড’। তত্ত্বাবধানের জন্য এক জার্মান ইঞ্জিনিয়ার দীর্ঘদিন বেলঘরিয়ায় বসবাস করেন। ১৯১৪ সালে এই জমিতেই ছিপের কারখানা স্থাপিত হয়। বর্তমান দেওয়ান দীঘি’র পশ্চিমদিকে জলকলের বিপরীতে ছিল এর অবস্থান। বার্মা থেকে বাঁশ এনে ছিপ প্রস্তুত এই ছিপ আমেরিকা ছাড়াও বিদেশের অনেক জায়গায় রপ্তানি করা হত। ১৯৩৬ খ্রীষ্টাব্দে হরিদাস মুখোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত ‘রেড ফ্রেন্ডস বেকারী’ বিস্কুট ও পাউরুটি তৈরির ক্ষেত্রে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৩৭-৩৮ সালে রাজবন্দিদের জন্য তৎকালীন বাংলা সরকার স্থাপন করে ‘আর্ট অ্যান্ড ইউনাইটেড পটারীজ’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বা তাঁর কিছু আগে বেলঘরিয়ায় বহু কলকারখানা গড়ে ওঠে। “The rural simplicity of the tiny village of Belghoria yielded to the opulence of a growing industrial town.” দু’একটি ছাড়া কোনোটাই প্রায় অবশিষ্ট নেই আজ আর। প্রসন্নকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গৌরাঙ্গ নার্সারি’তে প্রতিষ্ঠিত হয় মোহিনী মিল, ১৯৩৮ সালে। তাঁতজাত বস্ত্রাদি উৎপাদনের জন্যেই মূলত এই কারখানাটির সূচনা। রেললাইনের ধারেই, ওল্ড নিমতা রোডের ওপর বিশাল জায়গা নিয়ে তৈরি এই কারখানাটির প্রতিষ্ঠাতার নাম মোহিনীমোহন চক্রবর্তী। এটি ২নং মোহিনী মিল, ১ নং মোহিনী মিলের অবস্থান ছিল নদীয়া জেলার কুষ্টিয়ায়। অসংখ্য শ্রমিক কাজ করতেন বেলঘরিয়ার মোহিনী মিলে। শোনা যায়, দক্ষ জনৈক জার্মান ইঞ্জিনিয়ার কারিগরির দিকটি পরিচালনা করতেন, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ইংরেজ সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে।
মোহিনী মিল-কে কেন্দ্র করে তিরিশ ও চল্লিশের দশকে বেলঘরিয়ায় শ্রমিক আন্দোলন গড়ে ওঠে সুকুমার ঘোষ, বিশু দাস, পরেশ বসু, শৈলজাকান্ত চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের নেতৃত্বে। সারা বাংলায়, এমনকি বাংলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল মোহিনী মিলের খ্যাতি। ১৯৬৭-৬৮ সালে মূলত কাঁচামালের অভাব ও শ্রমিক অসন্তোষের ফলে মোহিনীমিল বন্ধ হয়ে যায়। তারপরে সরকারের উদ্যোগে দু’এক বছরের জন্য চালু হলেও, স্থায়ী হতে পারেনি সেটি। অসংখ্য বেকার শ্রমিক; কেউ কেউ আত্মহত্যা করেন, কেউ হকারি শুরু করেন, কেউ বা ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের সূচনা করেন নিজ উদ্যোগে। নন্দননগর এলাকায় ব্যাগ তৈরির ব্যাবসা শুরু এই কারণেই। জমি সংক্রান্ত বিবাদের নিস্পত্তি না হওয়ায়, এখনও মোহিনী মিলের জীর্ণ ধ্বংসাবশেষ কোনওক্রমে টিকে আছে রেললাইনের ধারে, উজ্জ্বল ইতিহাসের দীর্ঘশ্বাস নিয়ে।
১৯৪৩ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন, বিড়লাদের উদ্যোগে গড়ে ওঠে টেক্সম্যাকো কারখানা, মূলত রেল সংক্রান্ত জিনিসপত্র উৎপাদনের উদ্দেশ্যেই। যুগের হাওয়ায় সেখানেও শ্রমিক সংগঠন ও আন্দোলন প্রসার লাভ করে। আব্দুল মোমিন, নেপাল নাগ, পূর্ণেন্দু সেনগুপ্ত, ধীরেন দে, শান্তি সর্দার প্রমুখ ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা আন্দোলনের পথিকৃৎ। পুরোনোদিনের কারখানাগুলির মধ্যে, একমাত্র টেক্সম্যাকোই টিকে আছে আজও স্বমহিমায়।
এছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গড়ে ওঠা অন্যান্য কারখানাগুলির মধ্যে বেঙ্গল পোর্সিলিন, হিন্দুস্থান কটন মিল, ম্যালিয়েবল কাস্টিং ইত্যাদি অন্যতম। দেশপ্রিয়নগরের সোনার বাংলা পল্লীর পূর্বদিকে ‘সোনার বাংলা কটন মিলস লিমিটেড’এর পরিত্যক্ত শেড ছিল, শ্রীপল্লী মাঠে ছিল ‘আপার গ্যানজীজ সুগার মিলের হোর্ডিং ‘সাইট ফর সুগার মিল’। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় বাস্তবায়িত হতে পারেনি এই কারখানাগুলি। বর্তমান দেশপ্রিয় ব্যায়ামাগারের মাঠে বিড়লাদের প্রস্তাবিত ল্যাবরেটরি’র ভিত পর্যন্ত নির্মাণ হয়েছিল এবং ল্যাবরেটরি’টি নির্মাণের জন্য শহীদমহলের পশ্চিমে বিড়লা কম্পানির ইঁটভাটিও ছিল; কিন্তু বিড়লা গ্রুপের অন্তর্বিরোধের ফলে বাস্তবায়িত হয়নি এই প্রোজেক্ট। এখন যেখানে স্টেট ট্রান্সপোর্ট ডিপো, সেই ঘোষালদের ৭০ বিঘা চাষের জমিতে প্রাক্-স্বাধীনতা যুগে প্রখ্যাত শিল্পপতি মির্জা আহমদ ইসপাহানি চামড়ার রং প্রস্তুতের কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, কিন্তু গ্রামবাসীদের বিরোধিতার ফলে তার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
স্বাধীনতার পর আরও অনেক ক্ষুদ্র ও বৃহৎ শিল্প গড়ে ওঠে। বেশিরভাগই এখন মৃত বা মৃতপ্রায়, প্রধানত রক্ষণাবেক্ষণ এবং দক্ষতার অভাবে। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন কারখানাগুলির গুরুত্বও অনেক কমে গেছে। কিন্তু সার্বিকভাবে সব শিল্পোদ্যোগই বেলঘরিয়ার অর্থনৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ় করেছিল এবং জনপদটির গুরুত্ব অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছিল বহির্বিশ্বের কাছে, এ-কথা অনস্বীকার্য।
সূত্র – ‘বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে’
প্রকাশক – আরশিনগর-প্রাণভূমি
প্রকাশকাল - ২০১৬