No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বেলভিডিয়ার এস্টেট ও আলিপুরের ভূত

    বেলভিডিয়ার এস্টেট ও আলিপুরের ভূত

    Story image

    কলকাতার বুকে ভূতের রাজত্বি। তা সে আজকের কথা নয়। বহুদিন ধরেই লোকে তন্নতন্ন করে এখানে ভূতের সন্ধান করছে। একটু আলো-আঁধারি পেল কি পেল না, ভূতের গন্ধ চলে গেল সোজা নাকে। তারপর আর কী! ‘হন্টেড প্লেস’-এর রোমাঞ্চ পেতে ভিড় করল একগাদা লোক। ভূত কর্পূরের মতো হাওয়া! তবে গিজগিজে লোকের মধ্যেও কিছু ভূত বোধহয় আজও ‘বেঁচে’ আছেন এই মহানগরে। অন্তত আছেন বলে ভাবতে ভালো লাগে। গায়ে কাঁটা দেয় বেশ। কিছু তো রহস্য বেঁচে থাক এই ফোর জি-র দুনিয়ায়।

    যেমন একটি ভূত রয়ে গেছেন আলিপুরে বেলভিডিয়ার এস্টেটে। মানে আমাদের জাতীয় গ্রন্থাগারে। বহুকাল ধরেই সেখানে ভূতের আস্তানার কথা শোনা যায়। তবে ইদানিং ডিজিটালিস ব্যাপারস্যাপার এত বেড়েছে, যে সেই ভূতের অক্কা পাওয়ারই কথা। কিন্তু হঠাৎ সেদিন মেট্রোতে একদল কালেজীয় ছেলেমেয়ের কথা কানে এল- “পুতুলবাড়িতে ভূত নেই রে, ওখানে তো লোক থাকে। কিন্তু ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে আছে। কেউ যদি ওখানে বই এলোমেলো করে, তাহলে সে দেখতে পায়!” 

    কী সাঙ্ঘাতিক! পকেটে স্মার্টফোন নিয়ে ঘুরে-বেড়ানো  ছেলেপুলেও বলছে এসব? নাকি সত্যিই ‘বই-ঝাড়া মহাপাপ’- এই শিক্ষা দিতে ইচ্ছে করেই ভূতের গপ্প বানানো হয়েছে? আর নাকি, বিজ্ঞান তো সংকলিত জিনিসের ভিড় শুধু- এমনটাই মানতে হয়? 

    এইসব ভাবতে ভাবতে মেট্রো থেকে নামলাম। মাথার মধ্যে তখনো ‘ভূত’ জেগে আছে। আলিপুরের বেলভিডিয়ার এস্টেট। বেলভিডিয়ার রোডের ওপর। নামটি কিন্তু চমৎকার। বেলভিডিয়ার বলতে বোঝায়- 'a summer house or open-sided gallery, typically at rooftop level, commanding a fine view...'। বাংলায় যাকে বলে বুরুজ বা গ্রীষ্মাবাস। এবার প্রশ্ন হল, গনগনে কলকাতায় আলিপুর এমন কী মরূদ্যান হয়ে ছিল যে গ্রীষ্মাবাস বানাতে হল? অবশ্য আজ সেই উত্তর পাওয়া মুসকিল। সে-যুগের জল-হাওয়ার সঙ্গে একটা মস্ত তফাৎ হয়ে গেছে তো। হতে পারে, ইংরেজদের সাধের ট্যাঙ্কস্কোয়ারে মাথাচাড়া দেওয়া অসংখ্য হোটেল, অট্টালিকার থেকে খানিক দূরে এই স্থান এক প্রমোদবনের মতোই ছিল। 

    ছিল যে, তার প্রমাণ মেলে বিস্তর। দেশে যেমন সরকার বদল হলে ‘ভবন’গুলিরও আবাসিক বদল হয়। মানে রাজভবন, রাষ্ট্রপতিভবন, প্রধানমন্ত্রীভবনের ক্ষেত্রে যেমন হয় আর কী। এই বেলভিডিয়ার এস্টেটের বিশাল হাউজটিতেও তেমনি বহুবার আবাসিক বদল হয়েছে। হিসেব করে দেখলে  কলকাতা শহরের থেকে বয়সে খুব ছোটো নয় এই এস্টেটটি। কখনো ছোটোলাট আবার কখনো বড়োলাটেরা লাটত্ব ফলিয়েছেন এখানে বসে। ৭২ বিঘে ৮ কাঠা ৪ ছটাক জমির ওপর গড়ে উঠেছিল বেলভিডিয়ার এস্টেট। ১৭৬৯ সালে বাড়িটিতে থাকতেন গভর্নর ভেরেলস্ট। স্বয়ং লাটস্য লাট হেস্টিংস তাঁর সুখময় দিন গুজরান করেছেন এই শ্বেতপ্রাসাদে। তাঁর অত্যন্ত প্রিয় জায়গা ছিল এই ভবনটি। শুধু তাঁরই নয়। প্রিয়তমা পত্নী মেরিয়ানেরও প্রিয় ছিল বেলভিডিয়ার হাউজ। কেউ কেউ বলেন, মীরজাফর নাকি এই বাড়িটি নজরানা দিয়েছিলেন হেস্টিংসকে। 

    আবার কারো মতে, বৃদ্ধ অসুস্থ মীরজাফর নিজেও কিছুকাল নাকি কাটিয়েছিলেন হেথায়। যদিও তার তেমন প্রমাণ মেলে না।  সে যাই হোক, হেস্টিংসের যে বেশ ভালো পরিমাণ মায়া ছিল এই বাড়িকে ঘিরে, তা বোঝা যায়। আলিপুর অঞ্চলে হেস্টিংসের প্রচুর ভূসম্পত্তি ছিল। সেগুলো দেখাশোনার জন্যে তিনি আদিগঙ্গার ওপর নাকি সেতু তৈরির কথাও ভেবেছিলেন। হেস্টিংসের দুটি বাড়ি আলিপুরে। ‘হেস্টিংস হাউজে’ বসত করতেন নিজে আর অতিথি-অভ্যাগতরা এলে স্বাগত জানাতেন বেলভিডিয়ারে। কিন্তু ১৭৮৪-তে তিনি স্ত্রী মেরিয়ানকে চিঠি লিখে জানান, বেলভিডিয়ার তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন মেজর টলিকে। প্রথমে কিছু বছর লিজ দিয়েছিলেন। অবশেষে মালিকানা হস্তান্তর। আর তারপর থেকে এ-হাত থেকে ও-হাত-- আবাসিক-বদল চলতেই থাকে। ১৭৮৫-তে শোনা যায় জ্যাকসন কিনে নেন বাড়িটি। ১৮০২ সালে ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পত্রিকায় বাড়িটি বিক্রির বিজ্ঞাপন বের হয়। 

    ১৮৫৪ সাল থেকে বাড়িটি লেফটেনেন্ট গভর্নরদের স্থায়ী ঠিকানা।

    আবাসিক বদলের সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু বাড়িটিরও বদল ঘটতে থাকে। বাড়িটি এমনিতে ইতালিয় স্থাপত্যশৈলীর। উইলিয়াম গ্রে বাড়িটির উন্নয়নে নাকি বিশেষ নজর দিয়েছিলেন। ছোটোলাট রিচার্ড টেম্পলের সময় বাড়িটির আশেপাশে ছিল চমৎকার বাঁশবন। চওড়া সিঁড়ির দুইপাশে ছিল লতাপাতার সজ্জা। এছাড়া প্রাসাদটির উত্তরদিকের সিঁড়ি, মাঝের বলরুমের কাঠের মেঝে তৈরি হয় অ্যাশলে ইডেনের সময়। উত্তর-পূর্বের সুপার রুম তৈরি হয় বেইলির সময়ে। আর প্রথম ইলেক্ট্রিকের আলোয় আলোকিত হয় অ্যালেকজান্ডার ম্যাকেঞ্জির সময়ে। এইভাবে এই প্রাসাদ নিত্যদিন নতুন হয়েছে। 

    তা এতজনের ভালোবাসা পড়েছে যেখানে, তাদের তো কিছু মায়া রয়েই যায়। বেলভিডিয়ার হাউজে যে ভূতটিকে অনুভব করা যায়, সবার একবাক্যে স্বীকার, সেটি সাহেব ভূত। আরো বিশেষ করে বললে সেটি হেস্টিংসেরই ভূত। দোর্দণ্ডপ্রতাপ হেস্টিংস। নন্দকুমারকে ফাঁসিতে ঝোলানো-ইস্তক সেই যে অভিশাপ খেয়েছিল, আজও তাতে ভূত হয়ে এখানে পচছে। মুক্তি নেই। আরেকজন মেমভূতের কথাও কেউ কেউ বলে। ওই যে বইপত্র এলোমেলো করা... সেদিন এক ফচকে ছোকরা বলল, হেস্টিংসের বউ নাকি একদম ঘর নোংরা-করা পছন্দ করতেন না। উনিই হয়তো...

    কে জানে? তবে মনে হয়, যেভাবে কলকাতা বদলাচ্ছে, তার সংস্কৃতি বদলাচ্ছে, তাতে হয়তো এই গল্পগাছার মধ্যে দিয়েই ইতিহাস থেকে যাবে। অতীত নামের একটা ভূত কেবলি তাড়া করে ফিরবে আমাদের।

    তথ্যসূত্র: ‘কলকাতা’: শ্রীপান্থ, ‘বনেদি কলকাতার ঘরবাড়ি’: দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় 

    Tags:

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @