ইন্দিরা – শান্তিনিকেতনের আশ্রমবালিকা

ভারতের প্রথম এবং এখনও পর্যন্ত একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধি (Indira Gandhi)। তাঁর বাবা ভারতীয় রাজনীতির আরেক দিকপাল জওহরলাল নেহরু – বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। মা কমলা নেহরুও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। ইন্দিরার ছাত্রজীবন কেটেছে নানা জায়গায়। কিছুদিন দিল্লিতে পড়াশোনা করে তিনি চলে যান এলাহাবাদ। ছোটোবেলাতেই সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নেন। তারপর ভর্তি হলেন পুনের এক স্কুলে। বম্বে থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৩৪ সালে তাঁর বাবা-মা শান্তিনিকেতনে (Santiniketan) এসে রবীন্দ্রনাথকে (Rabindranath Tagore) জানান, মেয়েকে তাঁরা বিশ্বভারতীতে ভর্তি করতে ইচ্ছুক।
সেবছরই ৭ জুলাই মা কমলার হাত ধরে বিশ্বভারতীতে (Visvabharati) আইএ পড়তে এলেন ইন্দিরা। বয়স তখন ১৭। শ্রীসদনে বসবাস করতে শুরু করলেন। প্রতিদিন ভোর ৪টেয় ঘুম ভাঙত। মাথার ওপর ফ্যান ছিল না। ভোর ৬টায় খেতে হত পুরী আর ডাল। নন্দলাল বসু তাঁর ‘লোকাল গার্জেন’। ইন্দিরা চেয়েছিলেন, শান্তিনিকেতনে তাঁর থাকা-খাওয়ার আলাদা ব্যবস্থা হোক। জওহরলাল চিঠি লিখে বোঝান, তাহলে কোনো সহপাঠীই ইন্দিরার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে না। শিক্ষক-অধ্যাপকরাও অপমানিত বোধ করবেন। মেয়েকে যে কোনো পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার উপদেশ দেন তিনি।
ক্ষিতিমোহন সেন, নন্দলাল বসুর মতো মণীষীদের পেয়েছিলেন শিক্ষক হিসেবে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের কাছে বাংলা শিখতেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও ছিলেন তাঁর শিক্ষক।
ইন্দিরাও বাবার কথামতো সাধারণ শাড়ি পরে খালি পায়ে আশ্রমকে আপন করে নিলেন। বন্ধু হিসেবে পেলেন অশোকা সিংহ, জয়া আপ্পাস্বামী, সোমা যোশি, সুশীলা বাদকারের মতো সহপাঠিনীদের। অধ্যয়ন করলেন ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস। শিল্পকলা, নৃত্য, রবীন্দ্রসংগীতও শিখলেন। ক্ষিতিমোহন সেন, নন্দলাল বসুর মতো মণীষীদের পেয়েছিলেন শিক্ষক হিসেবে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের কাছে বাংলা শিখতেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও ছিলেন তাঁর শিক্ষক। তবে লাজুক ইন্দিরা কখনও নিজের ছোটোখাটো সমস্যা নিয়ে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে অভিযোগ জানাতে যাননি। কবিগুরু তাঁর নাম দেন ‘প্রিয়দর্শিনী”।
অন্য ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নিজের কাপড় কাচা, বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার – সবই করতেন ইন্দিরা। বনভোজন, পৌষ উৎসব, বসন্ত উৎসবে যোগ দিতেন মনের আনন্দে। সহপাঠীদের নিয়ে একবার ত্রিবেণী ঘুরতে গেলেন। এত ভালো লাগল, উচ্ছ্বসিত হয়ে চিঠি লিখলেন বাবাকে।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ইন্দিরা
এরই মধ্যে ইন্দিরার মা কমলা নেহরুকে ধরল গুরুতর রোগে। ইংল্যান্ডে গিয়ে চিকিৎসা করানো দরকার, কিন্তু জওহরলাল আলমোড়া জেলে বন্দি তখন। অগত্যা জওহরলাল চিঠি লিখলেন রবীন্দ্রনাথকে। ১৯৩৫ সালের মে মাসে শান্তিনিকেতনকে বিদায় জানিয়ে ইন্দিরা মায়ের কাছে চলে যান। যদিও আশ্রমের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল চিরকালীন। ১৯৩৭ সালে বাবার প্রতিনিধি হিসেবে আসেন বিশ্বভারতীর চিনা ভবন উদ্বোধন করতে। ১৯৩৯ সালে হিন্দি ভবনের দ্বারোদঘাটনে বাবার সঙ্গে হাজির ছিলেন ইন্দিরা। রবীন্দ্রনাথ তখনও জীবিত। পরবর্তীকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিশ্বভারতীর আচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন ইন্দিরা গান্ধি।
তথ্যঋণ – সৌম্যেন্দ্র ব্যানার্জি, বিশ্বজিৎ রায়।