No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    অতিমারির বদ্ধ জীবনে গল্পদিদা সুদেষ্ণা মৈত্রের দুটি নির্ভরযোগ্য শিশুপাঠ্য

    অতিমারির বদ্ধ জীবনে গল্পদিদা সুদেষ্ণা মৈত্রের দুটি নির্ভরযোগ্য শিশুপাঠ্য

    Story image

    বীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিশুসাহিত্য নিয়ে বলেছিলেন এক আশ্চর্য কথা— ‘ভালো করিয়া দেখিতে গেলে শিশুর মতো পুরাতন আর কিছুই নাই। দেশ কাল শিক্ষা প্রথা অনুসারে বয়স্ক মানুষের কত নূতন পরিবর্তন হইয়াছে। কিন্তু শিশু সহস্র বৎসর পূর্বে যেমন ছিল আজও তেমনি আছে।’  শিশু মনস্তত্ত্ব অনুভব করাও তাই বেশ কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজ অনায়াসে করে চলেছেন সুদেষ্ণা মৈত্র। গোখলে মেমোরিয়াল স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক এবং এখন ছোটোদের গল্পদিদা। বাংলা শিশু সাহিত্য নিয়ে তাঁর পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। বাংলা বানান নিয়ে নিজস্ব ভঙ্গিতে কাজ করেছেন। শিশু সাহিত্য সংসদ থেকে লিখেছেন ছোটোদের পাঠ্য পুস্তকও। আজকাল থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ছোটো গল্প সংকলন ‘জুতো যখন কথা বলে’। এইসব গল্প পড়তে হয় অন্য আমেজে। এইবার পক্ষীরাজ প্রকাশনী প্রকাশ করেছে তাঁর দুটি ছোটোগল্পের সংকলন— ‘বিন্তির গল্প’ আর ‘চলো যাই লঞ্জেসের দেশে’। ঝলমলে প্রচ্ছদ আর আকারে ছোটো এই দুটি বই ছোটোদের জন্য অমূল্য উপহার।

    ছুটির দুপুরে ছাদের ঘরে বসে একরাশ নস্টালজিয়া নিয়ে তৈরি করতে হয় কল্পনার ভুবন। সেই ভুবনে বিন্তি  রান্নাবাটি খেলে, পাউডার মাখে চুপিসারে, বিন্তির সরস্বতী পুজো আসে একরাশ প্রশ্ন নিয়ে, বিন্তির বন্ধুরা উঁচু মহল পার হয়ে পথের ধুলো মেখে এসে দাঁড়ায়। সেই কল্পনার পৃথিবীতে সূর্য, ফুল, কাঠের ঘোড়া নতুন মায়া ছড়ায়। বিন্তি ইঁট কাঠ পাথরের জঙ্গল থেকে একটু তফাতে এক মায়াবী জগৎ তৈরি করে। ‘বিন্তির গল্প’-এর ভূমিকায় গল্পদিদা লিখেছেন, ‘গল্পে গল্পে তৈরি হয় আমাদের কথা। গল্প শুনতে শুনতেই ছোটোরা বড়ো হয়। আমরা যে কোন যুগ থেকে গল্প শুনে আসছি, তার দিন তারিখ জানি না। বকবকের কথায় যে সুর আছে, যে তাল আছে তাতেই গড়ে উঠছে অনেক গল্প বা কাহিনি।’ এইভাবেই ছোট্ট মেয়ে বিন্তির কাজকারবার  নিয়ে তৈরি হল ‘বিন্তির গল্প’। বিন্তির দশটি গল্প দশরকম। যেন জীবনের দশ দিক। ‘রান্নাবাটি’ গল্পে ঘরের পরিচারিকা পারুমাসির দেশ থেকে মাটির রান্নাবাটি আসে। বিন্তির রান্না শুরু হয়। রান্নাই হয় তার প্রিয় খেলা। স্বপ্নে কথা বলে রান্নার সরঞ্জাম। ‘বিন্তির পাউডার’ তো সকলের নস্টালজিয়া। ঠাকুমার পাউডার চুরি করে হোমিওপ্যাথির পুরিয়া থেকে সাজগোজের জিনিস এবং দুধসাগর বানানোর প্রক্রিয়া তো অক্ষরে পা দিয়ে শৈশবে ফিরে যাওয়া। ‘বিন্তির অভিনয়’ স্কুলজীবনের মজাদার রিহার্সালের ছবি তৈরি করে। অল্প পার্ট পেয়েও সে আনন্দ কম হয় না। স্টেজে উঠে পার্ট ভুলে যাওয়া তো আলাদা মজা। স্মৃতির কৌটোয় নীল পাথর হয়ে ঝলমল করবে। ‘সরস্বতী পুজো’য় রিজিয়া আসে যেন সামাজিক এক বোধ জাগিয়ে তুলতে। রিজিয়া অপূর্ব আলপনা দেয়। কিন্তু মাসিঠাম্মা যখন বলে, ‘রিজিয়া যেন আমাদেরই মতো’ — তখন কোথায় যেন সংশয় তৈরি হয় বিন্তির মনে। এরপর সরস্বতী পুজো আসে। অন্যরকম ভঙ্গিতে, কোন এক আগুনের পরশমণির স্পর্শ নিয়ে। ‘বিন্তির জন্মদিনে’ নতুন নতুন বন্ধু আসে। আনন্দ চড়িয়ে যায় নিউ মার্কেট থেকে কলকাতার ফুটপাথে। সে এক নতুন কলরব। ‘বিন্তির বন্ধুরা’ আর পাঁচজনের মতো নয়। তারা পাখপাখালি, পশু পাখির দল। ‘সূর্যমামা, বিন্তি, ফুল’ গল্পে ফুল কুড়াতে যায় বিন্তি। এই ফাঁকে ফুলেদের সঙ্গে দিব্যি ভাব হয়ে যায় বিন্তির। বেজায় গরমকালে ফুলেদের ঝগড়ার সাক্ষী রইল বিন্তি। ‘চোর’ গল্পে গোয়েন্দা বিন্তি সঙ্গে রাখে মোটা ডাইরি, টর্চ, পেন, ম্যাগনিফাইং গ্লাস আর মানচিত্রের একটা বই। চোর ধরার জন্য রীতিমতো গোয়েন্দা বনে যায় সে। ‘কাঠের ঘোড়া’ গল্পে মোতিয়া, ছক্কা, বক্কা, হাঁসুখোকা এসে ভিড় জমায়। সওদাগরও আসে। ডাইনি বসে তামাক টানে। সবশেষে ‘নাটক’ গল্প। বিন্তি এক একলা বন্ধুর সাথী হয়। নাটকটা যে সমাজ ক্রমাগত করে চলেছে, তাও বোঝা যায়। বিন্তির গল্পগুলো শেষ হয়েও শেষ হয় না। মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে।

    ছোটোদের হাতে ছোটোদের বই

    পক্ষীরাজ প্রকাশনী থেকে একই সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে গল্পদিদার আরেকটি গল্প সংকলন, ‘চলো যাই লঞ্জেসের দেশে’। সেও এক দারুণ গল্পের ঝুলি। বলা ভালো লঞ্জেসের বাক্স। অসাধারণ এক আবহ, সুখ দুঃখ মেশানো অনুভূতি ছোটোদের মনে এক নতুন পৃথিবী তৈরি করতে পারে। ‘চলো যাই লঞ্জেসের দেশে’-র মূল  চরিত্রগুলি অনেকেই পশু পাখি। লেখক বইয়ের শুরুতেই তাদের কথা বেশ সুন্দর করে বলেছেন— ‘পশুপাখিরা প্রকৃতির সম্পদ শুধু নয়, তারা মানুষের খুব কাছের। গল্পদিদা গল্প বলতে থাকলে তারা কখনও লেজ নাড়িয়ে, কখনও শুঁড় দুলিয়ে অনেক কথা বলে। আমি ও আমার ছোটো বন্ধুরা শুনতে পাই।’ এই যে ‘না মানুষ’-দের কথা শুনতে পাওয়ার আবেগ, এ তো ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের কাজ। এই ইন্দ্রিয়টি যদি এখনকার শিশুদের মধ্যে জেগে ওঠে তবেই পৃথিবী আবার সুন্দর হবে। সেই কাজটি করার জন্য নিজের কলমের ম্যাজিকাল স্পর্শ দিয়ে চলেছেন লেখক। এই বইয়ের সূচিপত্রের নাম ‘লজেন্সের বাক্স’। মোট আটটি গল্প আছে। প্রতিটি গল্পেই লুকিয়ে রাখা শৈশবের জাদু। বইটি দৃশ্য তৈরি করেছে শব্দ দিয়ে। অবন ঠাকুর যেমন ছবি লিখতেন, ঠিক তেমন। সেই জন্যেই ‘স্কুলবাস’ গল্পে পাঠকের চোখের সামনে দিয়ে ভোঁ করে চলে যাবে পাখি বোঝাই স্কুল বাস। সেই বাসের জানালা দিয়ে ডানা মেলে দেবে স্কুল পালানো মাছরাঙা পাখি। ‘ছুটকি ও লম্বুসিং’ গল্প পড়তে বসে বোঝা যাবে বড়ো চেহারা হলেও হাতির নাম ছুটকি আর লম্বু সিং ওর বাঁদর বন্ধু। বুকভরা বন্ধুত্বের সুবাস নিয়ে গল্পের রথ চলবে গড়গড়িয়ে। ‘পিঁপড়ে-আড়শোলা-মাকড়সা’ ছোটোদের শিখিয়ে যাবে বেশ তত্ত্বকথা, কিন্তু নিজস্ব ধরনে। ভেসে আসবে গান— ‘আয়রে সবাই ঘরে যাই, চিনির দানা কিনে খাই।’ কত সহজিয়া সুর, কত গভীর ভাব! ‘স্কুলে এল নতুন বন্ধু’ গল্পের গরিলা স্যার আর টিয়া ম্যাডাম সকলের মন কেড়ে নেবেন। সজারু ছাত্রের কথা জানতে জানতে মন ভরে যাবে। ‘সাফাইওয়ালা’ গল্পটিতে বুধুয়ার অভিজ্ঞতা বেশ অবাক করা। কুকুর, কচ্ছপ, ব্যাঙ, মাছ আরও এমন কত কেউ গপ্পো জুড়বে বুধুয়ার সঙ্গে। তারপর বুধুয়ার কাজ শেষ হবে কীনা, সেইটেই গপ্পো। ‘হুড়হুড়ে’ গল্পটির নাম চরিত্র এক ডাকাত। সেই ডাকাত তাড়াতে পিকু পাগড়ি মাথায় মস্ত বড়ো  হাঁসের পিঠে উঠে পড়ে। যেন হাঁসঘোড়া। মেঘ, বৃষ্টি, ঝনঝনে তলোয়ার আর মেঘের দেশের ডাকাত হুড়হুড়ে। এই গল্প পড়লে মনটা কল্পনার পালতোলা নাও-এ চড়ে বসবেই। ভিন গ্রহের আজব প্রাণীদের সঙ্গে আড্ডা জমবে ‘চলো যাই লঞ্জেসের দেশে’ গল্পে। মৌমাছি, হনুমান, কাঠঠোকরা, কণি, টণি, মণি সকলের সঙ্গে কেমন করে যে ভাব হল নদের পরিবারের, ভাবলে তাজ্জব হতে হয়। সবশেষে আসে ‘উৎসব’। কুকুর বেড়ালদের পাড়া, খরগোশ পরিবার সকলে মিলে রকের বাড়ির বড়দিনের আয়োজন দেখে খুশি। মুরগি, কাকেশ্বর সকলে রককে কাজ ভুলিয়ে দেয়। তারপর ইচ্ছেমতো জিনিসপত্র রকের ব্যাগে ভরে দেয়। তারপর উৎসব কেমন হল? সেসব জানতে বইদুটি অবশ্যপাঠ্য। 

    ছোটোদের হাতে ছোটোদের বই

    গল্পদিদা সুদেষ্ণা মৈত্র এই অতিমারির বদ্ধ জীবনে শিশুদের কাছে অক্সিজেন। নিরলসভাবে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পের ফুল। সামাজিক মাধ্যমেই চলেছে তাঁর গল্পের কর্মশালা। দেশ-বিদেশের শিশুরা সাড়া দিয়েছে তাঁর ডাকে। দিব্যি চলেছে বাংলা ভাষার চর্চা। শিশুসাহিত্যিক হিসেবেও তিনি অত্যন্ত সফল। ছোটোদের রঙচঙে গল্প, সঙ্গে পাতায় পাতায় ছবি, সহজ ভাষা, গল্পের সংহত আকার, ছন্দে গাঁথা ভাব ভঙ্গি, পশু পাখি, খেলনা পুতুল আর শিশুদের হাসিমুখ! বাস্তব ও গল্প— এই দুই ভুবনেই তাঁর লক্ষ্য। দুটি গল্প সংকলন শিশুপাঠ্য ও ছেলেমানুষ আবেগে ভরপুর  হলেও গল্পের মধ্য দিয়ে নীতিবোধ জাগিয়ে তোলার কাজও করেছেন লেখক। এই প্রসঙ্গে  মনে পড়ে যেতে পারে সুখলতা রাও-এর উক্তি— ‘শিশুসাহিত্যের ভিতর দিয়া শিশুর সরল মনে যে ছবি, যে শিক্ষা, যে আদর্শ পৌঁছয় তাহা তাহার অজ্ঞাতসারে সেখানে নিজের ছাপ রাখিয়া যায় এবং ভবিষ্যতে তাহার শিক্ষাদীক্ষা এমন কি রুচির উপরে প্রভাব বিস্তার করে।’ পক্ষীরাজ প্রকাশনীর কাজটিও বেশ ঝলমলে সুন্দর। ছোটোদের বই এমনটাই হওয়া উচিত।

    ছোটোদের হাতে ছোটোদের বই

    লীলা মজুমদার উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর কথা প্রসঙ্গে বলেছলেন, ‘তিনি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন যে ছোটোদের বই হবে সবচেয়ে ভালো বিষয়ে লেখা, সবচেয়ে ভালো কাগজে ছাপা, সবচেয়ে সুন্দর ছবি ও অলঙ্করণ দিয়ে সাজানো এবং সবচেয়ে ভালো লেখা দিয়ে পুষ্ট।’ সুদেষ্ণা মৈত্রের বইদুটি এই সব শর্তকেই মান্যতা দিয়েছে। ১৮১৮ সালে স্কুল বুক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ‘নীতিশিক্ষা’ বইটিকে সর্বপ্রথম শিশুসাহিত্য সংকলনের প্রথাসিদ্ধ রূপ বলে ধরে নেওয়া হয়। শিশুসাহিত্যের এই যাত্রা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। বর্তমান সময়ে শিশুদের বইমুখী করে তোলার অন্যতম কাণ্ডারী গল্পদিদা সুদেষ্ণা মৈত্র। পক্ষীরাজ প্রকাশনী ছোটোদের নিয়ে খুব সহজ সুন্দরভাবে নতুন কাজ শুরু করেছে।

    ‘বিন্তির গল্প’ এবং ‘চলো যাই লঞ্জেসের দেশে’ এই প্রজন্মের শিশুদের কল্পনা-রাজ্যের দুটি নির্ভরযোগ্য ডানা হতে পারে। বইদুটি শুধু হাতে নেওয়ার অপেক্ষা। দুটি বই-ই পাওয়া যাচ্ছে কলেজস্ট্রিটের দে বুক স্টোরে।

    ছবিঃ সুদেষ্ণা মৈত্রের ফেসবুক

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @