শুরুতে বাংলা ‘ডিটেকটিভ’ গল্পের নায়ক হতেন ঘাঘু দারোগারাই

দীর্ঘদিন ধরে এক ব্যক্তি ভুয়ো আইএএস পরিচয় দিয়ে লোক ঠকানোর ব্যবসা করছিলেন শুধু তাই নয়, লোক ঠকাতে ঠকাতে সম্প্রতি তিনি নির্বিকারভাবে নকল ভ্যাকসিন দিয়ে, তাবড় তাবড় সরকারি কর্মকর্তা, পলিটিসিয়ানদের ঘোল খাইয়ে, গুছিয়ে লোক মারারও বন্দোবস্ত করেছিলেন। অতঃপর, এখন তিনি শ্রীঘরে।
গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত কিন্তু, কীভাবে ওই ব্যক্তি ঠগ হয়ে উঠলেন এবং দিনের পর দিন তলে তলে জালিয়াতির কাজকর্ম অব্যাহত রেখেছিলেন, সংবাদমাধ্যমে সেটাই এখন সবচেয়ে চর্চিত টপিক। হবে নাই বা কেন, চিরকালই পাঠক-দর্শকদের পছন্দের শীর্ষে থেকেছে ক্রাইম-রহস্য! শুধু রহস্য ঘনালো আর গল্প শেষ হয়ে গেল, সেরকমটা হওয়ার নিয়ম নেই। রহস্যের মধ্যে দিয়ে মানুষের কৌতূহলী মন চলে যায় সমাধানের দিকে। তখন রহস্যগল্পের সমাধান করতে মাঠে নেমে পড়েন গোয়েন্দা চরিত্ররা। যেমন-তেমন রহস্যগল্প নয়, খুন-জখম চুরি-ডাকাতি আছে, শঠ-কপট মানুষের আনাগোনা আছে, জটিল-কুটিল ঘটনার সমাবেশ আছে এবং সর্বোপরি আছে একজন ‘ডিটেকটিভ’, সেই কাহিনি ‘পপুলার’ না হয়ে উপায় আছে! খড়ের গাদা থেকে ছুঁচ বার করার মতো বুদ্ধির মারপ্যাঁচের কোনও বিকল্প নেই, তা পাশ্চাত্যের এডগ্যার অ্যালান পো, অস্টিন ফ্রিম্যান, আগাথা ত্রিস্টি, ডরোথি সেয়ার্স প্রমুখ বিখ্যাত সাহিত্যিকদের সঙ্গে সঙ্গে বুঝিয়েছেন বাংলার সাহিত্যিকরাও। তবে, গোয়েন্দাকাহিনি বাংলা সাহিত্যের মূলস্রোতে ঢুকে পড়ার আগে, একেবারে শুরুর দিকে কিন্তু বাংলার গোয়েন্দাকাহিনিগুলিতে নায়ক হতেন ঘাঘু দারোগারাই। আর গল্পগুলি লেখা হত সত্যি ঘটনাকে আধার করে।ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে, ১৮৯২ সালে গোয়েন্দাকাহিনি লেখা শুরু করেন সরকারি ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়। সিরিজের নাম ‘দারোগার দপ্তর’। প্রথম বই ‘বনমালী দাসের হত্যা’। সিরিজের সংখ্যা ২০৬। প্রিয়নাথবাবু ছিলেন সাদামাটা গল্পকার, একশো বছর আগে যে ধরনের ভাষা চলতি ছিল, তাই সম্বল করে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাগুলি লিখতেন।
প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘দারোগার দপ্তর’ যখন চলছে, ঠিক সেই সময়েই দক্ষ দারোগা বরকতউল্লার গল্প শুনিয়েছিলেন কালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়। সেকালে এদেশে ‘ঠগ’ নামক দস্যু সম্প্রদায়কে দমন করার জন্য কমিশনার শ্লীম্যান যে-জন দারোগাকে নিযুক্ত করেন, বরকতউল্লা তাঁদেরই একজন। ইনি ছিলেন ভদ্রবংশীয় এক বাঙালি যুবক। অসামান্য চাতুর্য্য এবং ধূর্ততার জন্য লোকের মুখে মুখে এঁর নামটি দাঁড়িয়ে যায় ‘বকাউল্লা’, পরে ‘বাঁকাউল্লা’। ঠগী কমিশনের রিপোর্ট থেকে বরকতউল্লার ‘আশকারা’ করা বারোটি কৌতূহলোদ্দীপক কাহিনি সংগ্রহ করে ১৮৯৬-এ ‘বাঁকাউল্লার দপ্তর’ নামে পাঠক-দরবারে হাজির করেছিলেন কালীপ্রসন্নবাবু। পুলিশী দক্ষতার আরো একটি বই ‘সেকালের দারোগা কাহিনি’ লিখেছিলেন গিরিশচন্দ্র বসু। লেখাটি বেরিয়েছিল অক্ষয় সরকারের ‘নবজীবন’ পত্রিকায় ১৮৯৩-৯৪ সালে।তখনকার প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত ১২৯৪ সালে ‘ভারতী’ সাহিত্য পত্রিকায় বৈশাখ সংখ্যায় লেখেন ‘চুরি না বাহাদুরি’ নামে একটি গোয়েন্দাকাহিনি। হরিসাধন মুখোপাধ্যায় ওই ‘ভারতী’তেই লিখেছিলেন ‘হত্যাকারী কে?’ এ ছাড়া তৎকালীন ‘সখা ও সাথী’-তে হরিসাধনবাবুর ‘আশ্চর্য হত্যাকাণ্ড’ প্রকাশিত হয়, গবেষক বিশেষের মতে সেটিই নাকি প্রথম বাংলা কিশোর থ্রিলার। মোটামুটি বিংশ শতাব্দির শুরুর দিক পর্যন্ত এভাবেই অভিজ্ঞতামূলক বাংলা গোয়েন্দা গল্পে একচেটিয়া ছড়ি ঘুরিয়েছেন দুঁদে দারোগারা।
তথ্য ও ছবি ঋণ:-
প্রবন্ধ সংগ্রহ, সিদ্ধার্থ ঘোষ। ছবিটি অদ্ভুত-হত্যাকাণ্ড কাহিনির হেডপিস ও উডকাট অলংকরণ।