‘তোমাকে চাই’ – ৩২ বছর আগে, জার্মানিতে কবীর সুমনের সঙ্গে চার দিন

রবীন্দ্রনাথ পেরিয়ে বাংলা গান ততদিনে অনেক উঁচু-নিচু পথ পেরিয়ে পৌঁছেছে নিউ থিয়েটার্স, হিমাংশু দত্ত, আইপিটিএ, হেমাঙ্গ বিশ্বাস কিংবা সলিল চৌধুরীতে। কিংবদন্তিদের গান গোগ্রাসে গেলার পর একদল গানপাগল মানুষ ভাবতে বসেছে, এবার তবে কী! বাংলা গানে কি তবে শ্যাওলা জমবে? এই বিশ শতক প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ফরাসি তাত্ত্বিক জাঁ বদ্রিলার বলেছিলেন, আমাদের চারপাশে যত তথ্য আছে, তত অর্থ নেই। আমার মতে, বহুকাল পর এই অর্থের পিছনে ছুটেছিলেন সুমন চট্টোপাধ্যায়, অধুনা কবীর সুমন।
কবীর সুমনের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল প্রায় ৩২ বছর আগে, জার্মানিতে। ১৯৮৭-র এক শীতের সকাল। ট্রেনে উঠেছিলাম প্যারিসের গার দু নোর স্টেশন থেকে। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার সেই ট্রেনযাত্রার গন্তব্য ছিল জার্মানির কোলোন। সুমনদা তখন ‘ভয়েস অফ জার্মানি’র বাংলা বিভাগে কাজ করছেন। ইউরোপ এবং আমেরিকায় সময় কাটানোর পর আমি ঠিক করেছিলাম, সুমনদার কাছে গিয়ে কয়েকটা দিন গান এবং আড্ডায় মেতে থাকব।
এর আগে সুমনদা তাঁর ‘নাগরিক’ গ্রুপের জন্য কয়েকটি গান কলকাতায় রেকর্ড করেছিলেন স্ব-উদ্যোগে। সেইসব ক্যাসেট একদল গানপাগল মানুষ সমমনস্ক বন্ধুদের বিনামূল্যে বিতরণ করত। এমনকি গড়িয়া বাস ডিপোয় গিয়ে ফাঁকা বাসের সিটে রেখে আসত। সুমনদা তখন দক্ষিণ কলকাতার বৈষ্ণবঘাটায় একটা স্টুডিও বানিয়েছিলেন। ইলেকট্রনিক কিবোর্ডে ফোর-ট্র্যাক রেকর্ডারে সেই গানগুলো তিনি রেকর্ড করেছিলেন। সেই আস্তানা ছিল আমার বড্ড প্রিয়। ইতিমধ্যে আমাদের গানের দল ‘নগর ফিলোমেল’-এর প্রথম অ্যালবাম ‘শহর সংগীত’ প্রকাশিত হয়েছে এইচএমভি থেকে।
এই শহরটাকে আমরা যেভাবে দেখেছি বা দেখতে চেয়েছি, সেই একরাশ গাঢ় কথা নিয়ে গৌতম নাগের লেখায় আর আমার সুরে তৈরি করেছিলাম ‘বিজনের চায়ের কেবিন’। ভাবতে ভালো লাগে, এই গান সুমনদার খুব পছন্দ হয়েছিল। সেই থেকে শুরু হয় আমাদের বন্ধুত্ব। আমাদের আড্ডার বিষয় তখন রাজনীতি, সমাজ, কবিতা, গান এবং আরও নানাবিধ বিষয়। আমার মতো একজন গানপাগল মানুষ মুগ্ধ হয়েছিল বাংলা গান নিয়ে সুমনদার চিন্তাভাবনার জন্য। সেই সময়কার বাংলা গান নিয়ে সুমনদার তারিফের কোনো শেষ ছিল না। একইসঙ্গে উপলব্ধি করেছিলেন, এই গান সমকালকে প্রতিনিধিত্ব করছে না। বুঝতে চেষ্টা করছিলেন, সমকালীন পরিস্থিতি নিয়ে বাংলা কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, চলচ্চিত্র যেভাবে সোচ্চার, গানের ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটছে না। নতুন রাস্তা চাই, চাই গানের কথা ও সুরকে পাল্টে ফেলার। সুমনদা তাই বারবার গানের বদ্ধ পরিবেশ থেকে মুক্তির ইঙ্গিত খুঁজতেন সবসময়।
জার্মানির কথায় ফিরে আসা যাক। কোলোনে আমার ট্রেন পৌঁছে গেল ঠিক সময়। একটা পাবলিক বুথে গিয়ে ফোন করে জানালাম, ‘সুমনদা, আমি স্টেশনে পৌঁছে গিয়েছি।’ ফোনের ওপাশ থেকে উত্তর এল, ‘ইন্দ্রজিৎ, আমাকে পনেরো মিনিট সময় দাও, আমি আসছি’।
আমার বয়স তখন ২৭ বছর। জার্মানি তখন সম্পূর্ণ অজানা একটা দেশ। শুধু অপেক্ষা, আমার প্রিয় সংগীত ব্যক্তিত্বের জন্য। মনের অবস্থাটিও ছিল সুমনদার ওই গানটার মতোই – “চেনা দুঃখ চেনা সুখ, চেনা চেনা হাসিমুখ”। ঠিক পনেরো মিনিটেই সুমনদা এলেন। একটা ট্যাক্সি নিলেন। গিয়ে বসলেন ড্রাইভারের পাশে। আর বললেন, এই দেশে শ্রমের মর্যাদাকে শ্রদ্ধা জানানোর এটাই রীতি।
তার পরের কয়েকটা দিন আমার যেভাবে কেটেছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা সত্যিই হয়তো সম্ভব নয়। সুমনদা তখন জার্মান মহিলা মারিয়ার সঙ্গে ছিলেন, পরে কলকাতায় ফিরে তাঁকে বিয়ে করেছিলেন। সেই চার দিনের সন্ধেগুলো মেতে উঠেছিল সুমনদার লেখা ও সুরের মূর্চ্ছনায়। বিদেশের মাটিতে বসে একজন শুধু বাংলা গানই গাইছেন না, বাংলা ভাষা নিয়ে তাঁর দরদ প্রকাশ করে চলেছেন। তাঁর গানের গল্প, চরিত্র, প্রেক্ষাপট সবকিছুর মধ্যেই ছিল একটা বাঁক বদলের ঝোঁক। শুধু শহর নয়, তাঁর গানে জায়গা করে নিয়েছিল, গ্রাম, মফস্সল। সুমনদা আমায় বোঝাচ্ছেন তাঁর নিজের গান। লক্ষ করতাম, গানের মধ্যে কত সূক্ষ্মতা রয়েছে। সমস্ত বেড়া টপকে তিনি চলেছেন নতুন কিছুর সন্ধানে।
কবীর সুমনের কিংবদন্তি গান 'তোমাকে চাই'
কোলোনের একটা ধূসর সন্ধে। রেস্তোরাঁর এক নিভৃত প্রান্তে বসে নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বলতে বলতে আমাকে জীবনের প্রথম বিফ স্টেক খাইয়েছিলেন সুমনদা। জার্মানিতে থাকলেও তাঁর মন পড়ে থাকত নাকতলার বাড়িতে। হয়তো ভাবতেন, কবে কলকাতা ফিরে নিজের গান গাইবেন। নতুন বাংলা গান বাঙালিকে শোনানোর চেয়ে আনন্দের আর কিছু নেই। সেই চার দিন উপলব্ধি করেছিলাম, আমার সঙ্গে কথা বলে, আমাকে গান শুনিয়ে সুমনদা ফিরে পেতেন চেনা কলকাতাকে।
সুমনদা শোনাচ্ছেন, ‘তোমাকে চাই’। পরবর্তীকালে এই গান ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। তবে তখন তাঁর মনে সন্দেহ ছিল, এই গান বাংলার সংগীতপ্রেমীরা আদৌ গ্রহণ করবেন কি? সুমনদার কণ্ঠে এই গান শোনার পর আমার কী প্রতিক্রিয়া ছিল, তা আজ আর মনে নেই। শুধু এটুকু মনে করতে পারি যে, বেশ খানিকক্ষণ ধরে পলকহীন আমি সুমনদার দিকে চেয়েছিলাম, আর বুঝতে পারছিলাম, বাংলা গানে একটা বড়োসড়ো ধাক্কা আসতে চলেছে সুমনদার হাত ধরে। গানগুলোর কয়েকটি তৈরি হয়েছিল কলকাতায় তাঁর স্টুডিও ‘Sing to Live’-এ, বাকিগুলো জার্মানিতে অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বাংলা থেকে প্রায় হাজার মাইল দূরে বসেও তিনি বেঁধে চলেছেন গান। বাংলা গান। গানকে ভেঙেচুরে সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলার স্বপ্ন দেখছেন।
আরও পড়ুন
একশোয় পড়লেন কফি হাউজের কবিয়াল
জার্মানির যে স্টেশন থেকে সুমনদা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেবারের মতো বিদায় জানালেন সেখান থেকেই। ১৯৮৭-র পর আর কখনও সুমনদার সঙ্গে দেখা হয়নি আমার। তার কিছু পরেই কলকাতায় ফিরলেন তিনি। ১৯৯২ সালে প্রকাশ পেল সুমনদার প্রথম অ্যালবাম ‘তোমাকে চাই’। অ্যালবাম প্রকাশ পাবার পরের গল্পটা তো সকলের জানা। আজও মনে পড়ে, জার্মানির চারতলার সেই অ্যাপার্টমেন্টে বসে সুমনদা গেয়ে চলেছেন একের পর এক গান। গাইতে গাইতে ভাবছেন, এই গান কলকাতা কি গ্রহণ করবে! অ্যালবাম প্রকাশ পাবার পর সুমনের গান শুনলেন লক্ষ লক্ষ শ্রোতা। গানের কথা-সুরে একদল গানপাগল মানুষের হৃদয় তোলপাড় হল। জার্মানিতে সুমনদার সঙ্গে গল্প করতে করতে তাঁরই গানের রেশ ধরে বলতে ইচ্ছা করত, সুমনদা, তোমাকেই চাই।
কবীর সুমন আজ ৭১ বছর পূর্ণ করলেন। গানে গানে তাঁকে বলি, আপনার ‘পাল্টে দেবার স্বপ্ন’ জারি থাকুক। আগামীদিনেও আবিষ্কার করুন সুরের দিগন্তকে, আর আমাদের প্রাণবন্ত করে তুলুন বারবার।