হালিম-কাবাব আর সম্মিলনের রূপকথা জাকারিয়া স্ট্রিটে

কলুটোলা থেকে বাঁদিকে বেঁকতেই পরিবেশটা বদলে গেল এক লহমায়। উৎসবের শহরে আপনাকে স্বাগত। জাকারিয়া স্ট্রিটে সন্ধে হতেই ঢল নেমেছে মানুষের। ইফতার। সারাদিন রোজার পর খাবার-পানীয় ছুঁয়ে দেখা। সম্প্রদায়ের বেড়া অবশ্য এই উৎসবে আবছা। ‘ভাইজান’ বলে ডেকে মেডিকেল কলেজের এক ছাত্রকে আফগানি মুর্গের প্লেট এগিয়ে দিলেন দিল্লি ৬-এর কর্মচারী। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সে এসেছে ইফতারের ভোজে সামিল হতে। চাঁদনি চক, ডালহৌসির অফিস পাড়া থেকেও এসেছেন অনেক চাকুরিজীবী। ধর্মীয় পরিচয়ে অনেকেই মুসলমান নন। তাতে আরো খোলতাই হয়েছে উৎসবের রং। তাশকিনের কর্ণধার বলছিলেন, এভাবে মিলেমিশে না খেতে বসলে আর ইফতারের মজা কী!
ইফতারের সময় কলকাতার তামাম খাদ্যরসিকদের ঠিকানা হয়ে ওঠে খিদিরপুর, পার্ক সার্কাস, মেটিয়াবুরুজ, রিপন স্ট্রিট চত্বর। কিন্তু নানা ধরণের কাবাব, ফিরনি, ফালুদা, ভোরের দুধে ভজিয়ে রাখা লাচ্ছা, হালিমের মতো রমজানি খাবারে কলকাতার অন্যতম সেরা ঠিকানা নিঃসন্দেহে নাখোদা মসজিদ সংলগ্ন জাকারিয়া স্ট্রিট। অনেকেই বলেন, খাবারের স্বাদে লখনৌয়ের সঙ্গেও পাল্লা দিতে পারে এই ছোটোখাটো ঘিঞ্জি মহল্লাটি।
জাকারিয়াতে পা রাখতেই চোখে পড়বে সারি সারি দোকানে পোশাকের পসরা। তার মাঝ দিয়েই মানুষ চলেছেন ইফতারে অংশ নেবেন বলে। পথের দু’পাশে দেদার বিকোচ্ছে হালিম, ডাল-গোস্ত, কাবাব, ফালুদা, ফলের রস, লস্যি, লাচ্ছা, শুকনো ও কাটা ফল। ইসলামিয়াতে জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল হালিম শেষ। ঘড়ির কাঁটা তখনো আটটা ছোঁয়নি।
তাশকিনের সামনে তো রীতিমতো লাইন পড়ে গেছে। ফালুদা শেষ এখানেও। নতুনভাবে তৈরি হয়ে আসতে আসতে ন’টা বাজবে। কুছ পরোয়া নেহি—তাতেই রাজি সোদপুর থেকে আসা কয়েকজন ছেলেমেয়ে। তারা লিস্ট করে এনেছে কী কী চাখবে। সেখানে তাশকিনের ফালুদা মাস্ট। সঙ্গে ‘মুর্গ চাঙ্গিসি’। অনেকটা তন্দুরি মুরগির আদলে তৈরি। ওজন মেপে কিনছেন সবাই। পাশেই দিল্লি ৬-এ বিকোচ্ছে আফগানি মুর্গ আর নানা কিসিমের কাবাব। দু’জায়গাতেই বিপণির সামনে পাতা চেয়ার-টেবিলে বসেই ইফতার সারছেন সবাই।
পাশেই পথের ওপর নানা রঙের কাবাব। প্রশ্ন করতে উত্তর এল, রঙের বাহারের আড়ালে কৃত্রিম কেমিকেল নেই। সবটাই হাতের গুণ। সুফিয়াতে হালিম না খেলে ইফতারের মজা অনেকটাই মাটি। উল্টোদিকে নাখোদা মসজিদ তখন এক মায়াবী আলোয় মাখামাখি হয়ে আছে। আর, ‘অ্যাডামস’-এর সুতলি কাবাবের জন্য হাঁকপাক করছে মনটা।
জাকারিয়াতে এলে নিজের রসনাকে শাসন করা বেজায় কঠিন। ইসলামিয়ার ফিরনি, হাজি আলাউদ্দিনের হালুয়া বা গোলাপজাম আপনাকে ডাক পাঠাবে বারবার। ইফতারেও মৎসমুখ না হলে চলে না বাঙালি মুসলমানদের। তাই দেদার বিকোচ্ছে মাছের নানা আইটেম। তাশকিনেই মিলবে ‘মাহি আকবরি’। পেল্লায় কাতলার পেটি নানা মশলায় মেখে তৈরি হয় এই পদ। খানিক এগোতেই ‘মুর্দাবাদি লাজিজ কাবাব’-এ মিলছে চিংড়িও। এই দোকানের কর্ণধার জানালেন, মাছের মিষ্টি স্বাদ ছাড়া অনেকেরই ইফতার জমে না।
তাশকিন, সুফিয়া, ইসলামিয়া, হাজি আলাউদ্দিন ছাড়াও চারপাশ ঘিরে আছে অসংখ্য ছোটো ছোটো দোকান। সেখানেও কাবাব, হালিম, ফালুদা, লস্যির বাহার। ভোরে সেহরির খাবারের আগে রমজানের মরশুমে প্রায় সারা রাতই সরগরম থাকে এই মহল্লা।
চারপাশে গজিয়ে উঠতে থাকা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের ভাষ্যগুলো যেন অনেকটাই হেরে যায় এই মহল্লায় এসে। এখানে অনায়াসে মুখুজ্যে বামুন সন্তানকে ‘ভাইজান’ বলে সম্বোধন করেন দোকানি, হালিম চেখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন সেন-মিত্র-মণ্ডল পদবির চাকুরে-ছাত্র-ছাত্রীরা। এই সম্মিলনই যেন আলাদা স্বাদের ম্যাজিক বোনে জাকারিয়ার কাবাব-হালিম-ফিরনিতে। একজন সরকারি চাকুরিজীবী তার স্ত্রীকে মজা করে বলছিলেন বলছিলেন, সেন্ট্রাল এভিনিউয়ের এইপারের মেজাজটা যেমন সম্মিলনের, রাস্তার ওইপারেই... যাই হোক, বিতর্ক বাড়িয়ে লাভ নেই।
শব্দের রং এসে গায়ে লাগে। স্বাদেরা ঘোর বাড়ায়। সম্মিলন কথাটাকেও কেমন কৃত্রিম এক চাপানো প্রোপাগান্ডা করে তুলেছি আমরা। অথচ, এই মিলে-মিশে এক হয়ে থাকাই তো এই ভূখণ্ডের ইতিহাস। এ যদি আমার দেশ না হয় তো কার দেশ বলো!