কোথায় বাঙাল-ঘটি বিভাজন—বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধেও সেদিন লড়েছিল মোহনবাগান

১৯১১ সালের ২৯ জুলাই। আইএফএ শিল্ড ফাইনাল শেষে বিজয় মিছিল চলেছে ফোর্ট উইলিয়ামের সামনে দিয়ে। বিজয় মিছিলের একদম সামনের সারিতে মোহনবাগানের অধিনায়ক শিবদাস ভাদুড়ী। হঠাৎই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন এসে তাঁর হাত জড়িয়ে ধরলেন। আবেগে কাঁপছেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন, “এরা কবে যাবে বলো তো?” এরা মানে ব্রিটিশরা। শিবদাস উত্তর দিলেন, “আমরা যেদিন ফের শিল্ড জিতব”। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, মোহনবাগানের দ্বিতীয় শিল্ড জয় ১৯৪৭ সালেই।
অনেকে বলেন, ভগিনী নিবেদিতাও নাকি শিবদাসকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “সবুজ-মেরুন পতাকা তো উড়ল, ব্রিটিশ পতাকা নামবে কবে?” শিবদাস নাকি একই উত্তর দিয়েছিলেন সেদিন। কেউ-কেউ বলেন এই তথ্য আদতে গল্প। তথ্য আর কিংবদন্তি মিলেমিশে যায়। এমন এক রূপকথার ম্যাচ ঘিরে এসব তো হবেই।
আরো পড়ুন
অতীতচারিতায় মোহনবাগান
নিছক একটা ফুটবল ম্যাচ অবশ্য ছিল না ১৯১১ সালের আইএফএ শিল্ড ফাইনাল। বিবেকানন্দ বলেছিলেন, “পদাঘাতের বিপরীতে পদাঘাত কেবলমাত্র ফুটবলেই সম্ভব”। ওই ম্যাচেও আসলে ইংরেজদের সঙ্গে সম্মুখ সমরেই নেমেছিলেন এগারো জন বঙ্গসন্তান। বঙ্গভঙ্গ নিয়ে তখন গোটা বাংলা ফুঁসছে। বাংলার কোণে কোণে শুরু হয়েছে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী কর্মকাণ্ড। ইংরেজদের দমননীতিও শুরু হয়েছে। তার বিরুদ্ধেও স্বদেশি আন্দোলনের ঢেউ উত্তাল হচ্ছে। এমন সময়েই তৎকালীন ভারতের সবচেয়ে বড়ো ফুটবল টুর্নামেন্ট আইএফএ শিল্ডের ফাইনালে উঠল মোহনবাগান। সেমিফাইনালে তারা হারিয়েছে ইংরেজ ক্লাব মিডলসেক্সকে। ফাইনালে প্রতিপক্ষ আরেক ইংরেজ ক্লাব ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্ট। এর আগে কোনো ভারতীয় ক্লাব আইএফএ শিল্ড জিততে পারেনি। এই ফাইনাল তখন আর নিছক ফাইনাল নয়, ইংরেজদের বিরুদ্ধে খেলার ময়দানেই একটা যুদ্ধ।
শুধু বাংলা নয়, গোটা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ল এই রোমাঞ্চের আগুন। ফাইনালের আগেই পিলপিল করে মানুষ ট্রেনে চেপে, নৌকোয়, পায়ে হেঁটে পৌঁছতে লাগলেন কলকাতায়। ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হল অতিরিক্ত ফেরি সার্ভিস আর ট্রেনের ব্যবস্থা করতে। ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, খুলনা, অসম, বিহার, উত্তরপ্রদেশ—সব জায়গা থেকে মানুষ এসেছেন। ইডেন গার্ডেন্স লোকে-লোকারণ্য। মাঠে ঢাক বাজছে, ঘুড়ি উড়ছে। ‘জয় মোহনবাগান’-এর চাইতেও বেশি শোনা যাচ্ছে ‘বন্দেমাতরম’ স্লোগান। আর মাঠে বুট পরা গোরাদের সঙ্গে খালিপায়েই দাপিয়ে খেলছেন এগারোজন বঙ্গসন্তান। না, এগারো জনই খালিপায়ে নয় অবশ্য। একমাত্র সুধীর চ্যাটার্জির পায়ে ছিল জুতো।
ম্যাচের আগে ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টের খেলোয়ারেরা ঠাট্টা-তামাশা করেছিলেন মোহনবাগান নিয়ে। মাঠে যোগ্য জবাব পেয়েছিলেন তারা। ম্যাচ শেষে গোটা ময়দান কেঁপে উঠেছিল স্লোগানে, উল্লাসে, ঢাকের আওয়াজে। বাংলার স্বদেশি আন্দোলনকে নতুন প্রাণ দিল এই জয়। করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় ‘মানসী’ পত্রিকায় লিখলেন—“গোল দিয়েছে গোরার গোলে বাঙালির আজ জিত/ আকাশ ছেয়ে উঠছে উধাও উন্মাদনার গীত।”
কত রূপকথার মতো গল্প এই ফাইনাল ঘিরে। গোলকিপার হীরালাল মুখার্জি কাজ করতেন ইটভাটায়। সংসার চলে না অভাবে। মা অসুস্থ। ওষুধ কেনার টাকা নেই। ফাইনাল খেলতে পারবেন কিনা জানতেন না হীরালাল। তিনবার ট্রেডস কাপ জেতার পর নাটোরের মহারাজ একটা সোনার মেডেল দিয়েছিলেন তাঁকে। হীরালাল সেটা বেচে ওষুধ কিনতে চাইছিলেন। শিবদাস জানতে পেরে তাঁকে বিরত করে নিয়ে আসেন ওষুধের দোকানে। তিনিই কিনে দেবেন ওষুধ। কিন্তু, চিনতে পেরে তাঁদের থেকে ওষুধের দামই নেননি দোকানি। মোহনবাগানের শিল্ডজয়ে সেই দোকানিরও কি ভূমিকা নেই? হীরালাল বলেছিলেন, ফাইনালে প্রয়োজনে জীবন দিয়ে দেবেন।
হাবুল-কানু-অভিলাষ-সুধীর-সুকুল ভোলা যাবে না কাউকেই। এঁরা তো নিছক খেলোয়ার নন, এঁরা যোদ্ধা। লক্ষ লক্ষ বাঙালির প্রতিবাদের, স্বপ্নের, প্রত্যাঘাতের মুখ। কোথায় বাঙাল আর ঘটির বিভাজন তখন? বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধেই তো একজোট সব বাঙালি। মোহনবাগান গোটা বাংলার ক্লাব। শিল্ডজয়ের সাড়ে চার মাসের মধ্যেই বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণাও এসে গেল। ব্রিটিশরা বুঝল, কলকাতা তাদের পক্ষে মোটেও নিরাপদ শহর নয়। রাজধানী স্থানান্তরিত হল দিল্লিতে। গোটা দেশের ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনকে নতুন আগুন দিল মোহনবাগানের শিল্ড জয়।