জেলখানায় নির্যাতনের বিরুদ্ধে অনশন করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম

বিশ শতকে বাংলা সাহিত্যের অগ্রণী কবি ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলাদেশের জাতীয় কবি তিনি। ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ ও চিন্তাবিদ হিসেবেও তিনি সমাদৃত। আমাদের জীবনে মননে চিরস্থায়ী হয়ে আছে অসংখ্য নজরুলগীতি। বাঙালির চিরায়ত বিদ্রোহী সমাজচেতনা কাজী নজরুল ইসলামের মাধ্যমে যেন মূর্ত রূপ পেয়েছিল। রোমান্টিক প্রেম, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, আধ্যাত্মিক ভক্তিরস – নানাকিছুই তিনি ধারণ করেছিলেন নিজের সাধনায়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রামে নজরুল যুক্ত হয়েছিলেন। তাই বেশ কয়েকবার তাঁকে কারাবরণ করতে হয়েছিল।
‘আনন্দময়ীর আগমন’ কবিতাটি লেখার অভিযোগে কাজী নজরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল কুমিল্লা থেকে। বিচারের পর তাঁকে আলিপুর জেলে সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। সেখান থেকে হুগলি জেলে স্থানান্তরিত করা হয় তাঁকে। সেই কারাগারে সুপার আর্সটন রাজবন্দিদের ওপর অমানবিক নির্যাতন করতেন। পায়ে দেওয়া হত ডান্ডাবেড়ি, ভাতের বদলে খাওয়ানো হত মাড়। অন্যান্য বন্দিদের সঙ্গেই আরও নানারকম অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন নজরুল।
এই নির্যাতনের প্রতিবাদে জেলের মধ্যে নজরুল অনশন শুরু করেন ১৯২৩ সালের ১৪ এপ্রিল। তাঁর সঙ্গে অনশনে যোগ দিলেন মৌলভী সিরাজউদ্দিন এবং গোপালচন্দ্র সেন। জেল কর্তৃপক্ষ তখন তাঁদের ওপর অত্যাচার আরও বাড়িয়ে দেন। কিন্তু তাঁরা পিছু হটেননি। ব্রিটিশ সরকার এরপর নজরুলের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করে। যাতে বলা হয়, নজরুল জেল কোড ভঙ্গ করেছেন।
এদিকে তাঁদের অনশন চারদিকে আলোড়ন ফেলে দেয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক টেলিগ্রাম পাঠান নজরুলকে। যেখানে লেখা ছিল, “Give up hunger strike, Our literature claims you”। তবে কারা কর্তৃপক্ষ সেই টেলিগ্রাম “Address is not found”, লিখে ফেরত পাঠিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের কাছে, নজরুলকে না পড়িয়েই। নজরুলের অনশনে সমর্থন জানিয়েছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং নজরুলের মা জাহেদা খাতুন আলাদা আলাদা সময়ে হুগলি জেলে গিয়েছিলেন নজরুলের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ তাঁদের বাধ্য করে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসতে।
এরই মধ্যে প্রবল জ্বর ও অনাহারে নজরুলের ওজন ১৩ কেজি কমে গিয়েছিল। অনশনের ৩৯ দিন পর শেষ পর্যন্ত শাশুড়ি বিরজাসুন্দরী দেবীর অনুরোধে তাঁর হাতে লেবুজল খেয়ে নজরুল অনশন ভঙ্গ করেন। ১৯২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে কবি নজরুল কারাগার থেকে মুক্তি পান।