রাজকুমার দেবনাথের গড়া বাঁশি-পুতুল : প্রাচীন লোকশিল্প ও প্রযুক্তির নমুনা

পোড়ামাটির পুতুল। কোনওটা ঘোড়া, কোনওটা হাতি, বাঘ আবার পাখিও রয়েছে। তবে, পুতুলগুলো দেখলেই টের পাওয়া যায়, গড়ন প্রচলিত নয় এমনকী একটা মজার ব্যবহারিক দিকও আছে। প্রত্যেকটি পুতুলে ফুঁ দিলেই বেজে উঠবে বাঁশি। যা এর মূল আকর্ষণ। হরপ্পা সভ্যতার খননকার্যে নাকি একধরনের বাঁশি পুতুল মিলেছিল, বলা বাহুল্য এই পুতুল-নির্মাণ ঘরানাটি বয়সে বেশ প্রাচীন।
পোড়ামাটির বাঁশি পুতুল
হরপ্পা সভ্যতার খননকার্যে নাকি একধরনের বাঁশি পুতুল মিলেছিল, বলা বাহুল্য এই পুতুল-নির্মাণ ঘরানাটি বয়সে বেশ প্রাচীন।
এই বাঁশি পুতুল তৈরি করেন হাওড়া সাঁতরাগাছির বাকসাড়াবাসী রাজকুমার দেবনাথ। বর্তমানে বাংলায় সম্ভবত তিনিই একমাত্র শিল্পী, এই পুতুল তৈরি করেন। আগে সখে বানালেও, নয়ের দশকে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে বাঁশি পুতুল তৈরি করেছিলেন রাজকুমারবাবু। দু-তিন বছর পর বাঁশি পুতুল বানানো একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। ফের ২০২০ সালে করোনা ও লকডাউনের সময় এই পুতুল তৈরিতে মন দেন।
কীভাবে বাঁশি পুতুল বানাতে শিখলেন? রাজকুমারবাবুর পূর্বপুরুষ পূর্ববঙ্গের ঢাকায় থাকতেন। সেখানে তাঁদের পরিচিত এক মহিলা এই বাঁশি পুতুল বানাতেন। বিক্রির জন্য নয়, তিনি এসব পুতুল গড়ে বাচ্চাদের খেলতে দিতেন। সেই মহিলার কাছেই ছোটোবেলায় বাঁশি পুতুল গড়ার কৌশল শেখেন রাজকুমারবাবু। আজও তা বানিয়ে চলেছেন। বঙ্গদর্শন.কম-কে রাজকুমার দেবনাথ জানান, “কাকিমা শুধু ঘোড়া বানাতেন। আমি ঘোড়া, হাতি, বাঘ, হরিণ, গণেশের মুখ, পাখি সহ প্রায় ১০-১২ রকমের বাঁশি পুতুল বানাই। মনে হয়েছিল শুধু ঘোড়া কেন, আরও কিছু হোক।”
রঙিন বাঁশি পুতুল
বাঁশি পুতুলকে লোকশিল্প ও প্রযুক্তির অন্যতম নমুনা বলা চলে। বিশেষ ধরনের এই পুতুল গড়ার পদ্ধতি নিয়ে তিনি জানালেন, “এই পুতুল গঙ্গামাটিতে সবচেয়ে ভালো হয়। কারণ এই মাটি খুবই আঠালো। সেই মাটি থেকে কাঁকড় বেছে, ভালো করে মেখে মাটি তৈরি করা। পুতুল গড়ার পর শুকিয়ে গেলে পোড়ানো হয়। এটা তো গ্রাম-বাংলার পুতুল, তাই খুবই সাধারণ পদ্ধতিতে তৈরি হয়। তবে, মূল হলো বাঁশি বাজার ব্যাপারটা। পুতুল কাঁচা অবস্থাতেই আমায় ফুঁ দিয়ে দেখে নিতে হয়। কারণ, কাঁচা অবস্থায় বাজলে তবেই পোড়ানোর পর বাজবে। একটু এদিক ওদিক হয়ে গেলে আর বাজবে না। যেখান দিয়ে হাওয়া ঢুকবে আর যেখান দিয়ে বেরোবে, মাপ অনুযায়ী ছিদ্র দু’টো একবারে ঠিক হতে হবে। কখনো কখনো পুতুলে দুটোর বদলে তিনটে বা চারটে ছিদ্র রাখি। একটা দিয়ে ফুঁ দিতে হবে, আর অন্য দুটো ছিদ্র আঙুলে চেপে রাখলে বাজবে। একেবারে ম্যাজিকের মতো।”
পুতুল পুরোটাই হাতে গড়েন রাজকুমারবাবু, কোনও ছাঁচের ব্যবহার নেই। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে কাঁচা অবস্থায় ফুটো করে নেন। পুতুলের গায়ে নকশা আঁকেন। পোড়ানোর পর কোনও কোনও পুতুল আবার রঙও করেন। পুতুলগুলোর দাম বিভিন্ন, একেবারে ছো্টো বাঁশি পুতুলের দাম একশো টাকা। দু’শো, তিনশো টাকার পুতুলও রয়েছে। বড়ো পুতুলের দাম হাজার, সেটাই সর্বোচ্চ। মেলা ছড়াও, রাজকুমারবাবুর বাড়ি থেকেও পুতুল সংগ্রহ করেন মানুষজন। বরাত পেলে কলকাতার মধ্যে তিনি নিজেই পৌঁছে দেন। এছাড়া ক্যুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠানোর বন্দোবস্ত রয়েছে। মুম্বই, বেঙ্গালুরুতেও গিয়েছে তাঁর হাতে গড়া বাঁশি পুতুল।
যেসব মাটির পুতুল ‘খেলনা’ পরিচিতি ছেড়ে হয়ে উঠেছে লোকসংস্কৃতির ঐতিহসিক দলিল, তার মধ্যে অন্যতম পোড়ামাটির বাঁশি পুতুল। বহু যত্নে এই বিশেষ পুতুল-নির্মাণ ঘরানাকে আগামীর জন্য বাঁচিয়ে রাখছেন রাজকুমার দেবনাথ।
পুতুলের চাহিদা নিয়ে বললেন, “মেলায় বসলেই চাহিদা। বাচ্চাদের এই পুতুলের প্রতি খুব টান। মেলায় জায়গার উপরেও বিক্রি নির্ভর করে। শো-পিস হিসাবেও অনেকে কেনেন। সাজসজ্জার লকেট হিসাবেও বানাই। গলায় মেয়েরা পরতে পারবে, ফুঁ দিলে বাজবে। এক দিদিমণি কিনেছিলেন, নিজের অভিজ্ঞতা বললেন। স্কুলে ক্লাস নিচ্ছেন, বাচ্চারা দুষ্টুমি করছে। মুখে না বলে বাঁশিতে ফুঁ দিয়েই তিনি বাচ্চাদের চুপ করতে বলেন। এরকম অনেকেই আছেন, মজার মজার ঘটনা বলেন।”
বাঁশি পুতুল ছাড়াও টেরাকোটার গহনা, পাঞ্জাবির বোতাম ইত্যাদি বানাতেন রাজকুমারবাবু। আদতে তিনি শিল্পপ্রেমী। বাড়িতে পুতুলের সংগ্রহ রয়েছে। ছবি আঁকতেন, পেন্টিং নিয়ে আইটিআই করেছেন। শিল্পকলার প্রতি এই অমোঘ ভালোবাসার তাগিদেই বাঁশি পুতুল বানিয়ে চলছেন। বীরভূম, বাঁকুড়া, শান্তিনিকেতনের শিল্পীরা তাঁকে নিয়মিত ডাকেন, বাঁশি পুতুল নির্মাণ শিখতে চান। বিভিন্ন মেলায় রাজকুমারবাবু অংশগ্রহণ করেন। কলকাতার প্রেস ক্লাব, গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন ইত্যাদি জায়গা থেকে তিনি আমন্ত্রণ পান। ফি বছর যানও। পুতুল গবেষকেরা তাঁর বাড়িতে আসনে। তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে যান।
বাঁশি পুতুলের কারিগর রাজকুমার দেবনাথ
বাবু পুতুল, দিওয়ালি পুতুল, দারোগা পুতুল, দুর্গা পুতুল...কত নাম করব! মাটির তৈরি নানান ধরনের পুতুলে বঙ্গের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ। যেসব মাটির পুতুল ‘খেলনা’ পরিচিতি ছেড়ে হয়ে উঠেছে লোকসংস্কৃতির ঐতিহসিক দলিল, তার মধ্যে অন্যতম পোড়ামাটির বাঁশি পুতুল। বহু যত্নে এই বিশেষ পুতুল-নির্মাণ ঘরানাকে আগামীর জন্য বাঁচিয়ে রাখছেন রাজকুমার দেবনাথ।