কীভাবে এল ‘বেলঘরিয়া’

প্রতিটি এলাকারই নামকরণের পিছনে নিজস্ব কারণ থাকে। নামের ইতিহাস খুঁজলে উঠে আসে জায়গাটির সম্পর্কে নানা অজানা তথ্য। একের সঙ্গে অপরের মতও মেলে না অনেকসময়। সেটাই স্বাভাবিক। প্রাচীনকাল থেকে লোকমুখে শুনে আসা নামের উৎস সন্ধান করতে হলে কিছুটা অনুমানের ওপর নির্ভর তো করতেই হয়। বেলঘরিয়াও তার ব্যাতিক্রম নয়। অন্তত তিন-চার রকমের ব্যাখ্যা পেয়েছি আমরা বেলঘরিয়ার নামকরণ প্রসঙ্গে। প্রথমে দেখে নেওয়া যাক সেগুলি কী কী –
● কমল চৌধুরী তাঁর বইয়ে লিখেছেন – “গড়িয়া অনার্য শব্দ। একসময় এখানে ছিল প্রচুর বেলগাছ। বেল গড়িয়া মিলে বেলঘরিয়া শব্দের সৃষ্টি। আবার কেউ কেউ বলেছেন বেলগাছ কেটে গর্তে ফেলা হত। ঐ গর্তগুলি ‘বেগড়ে’ নামে পরিচিত ছিল। সেই থেকে গোটা এলাকা হয় বেলগড়ে। লোকের মুখে মুখে ‘বেলগড়ে’ ‘বেলঘরিয়া’য় পরিবর্তিত হয়েছে”।
● ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় তাঁর মতামত আমাদের জানিয়েছিলেন – “সপ্তদশ শতাব্দীতে ঐ অঞ্চল ছিল পাট, মাছ ও তরি-তরকারির প্রধান পাইকারি বাজার। প্রবাদ আছে, আড়িয়াদহে নৌকা থেকে পাট ও অন্যান্য সামগ্রী লোডিং ও আনলোডিং করার কাজে মালবাহকদের ডাকার জন্য ওখানে একটা বড়ো ঘণ্টা লাগানো থাকত, যা থেকে অঞ্চলটার নাম হয়েছে ‘বেলঘর’, ‘বেলঘর’ থেকে ‘বেলঘরিয়া’।”
● ডঃ গোপাল মুখোপাধ্যায়ের মতে, প্রাচীনকালে এই এলাকায় প্রচুর বেলগাছ ছিল এবং সেই গাছগুলিতে জন্ম নেওয়া বেলের আয়তনও ছিল স্বাভাবিকের থেকে অনেক বড়। সেই কারণেই এ অঞ্চলের নাম হয় ‘বেলঘর’। গোপালবাবু আরেকটি ধারণার কথা বলেছেন – ইংরাজি ‘BAEL’ বা ‘BEL’ শব্দের অর্থ বেলগাছ। সেখান থেকেও ‘বেলঘর’ নামটি আসতে পারে।
আমার মনে হয়, কমল চৌধুরীর মতটি, অর্থাৎ ‘বেল গড়িয়া’ থেকে ‘বেলঘরিয়া’ – একেবারেই অসম্ভব। কারণ যতদূর জানা যায়, ‘বেলঘরিয়া’ শব্দটি এসেছে ইংরেজদের দৌলতে। সাহেব’রা ‘বেলঘর’এর উচ্চারণ করতো ‘বেলঘুরিয়া’। বেলঘরিয়া স্টেশনে গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক পর্যন্তও একটি মার্বেলের ফলকে যে বানান লেখা ছিল, সেটি ‘BELGHURRIAH’. পরে সেটি পরিবর্তিত হয়ে ‘BELGHARIA’ হয়। এখনও নীলকণ্ঠ চ্যাটার্জী স্ট্রিটে ১৯৪২ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি বাড়ির ফলকে লেখা আছে ‘BELGHURRIA’ বানান, এবং ওল্ড নিমতা রোডের একটি বাড়ির ফলকেও দেখা যায় ‘BELGHURRIAH’ বানানটি। কিন্তু ১৯০৯ সালের কামারহাটি পৌরসভার একটি নথিতে আবার লিখিত ‘BELGHORIA’. কাজেই এ বিষয়ে সংশয় অব্যাহত। পরিষ্কার কোনো ধারণায় আসা সম্ভব নয়, প্রকৃত বানান কী ছিল। বেলঘরিয়ার প্রবীণ নাগরিক সুনীথ মিত্র এ প্রসঙ্গে আমাদের জানিয়েছেন, অন্যান্য কাজে ‘BELGHARIA’ লেখার চল থাকলেও, পোস্ট অফিসের ক্ষেত্রে, ‘BELGHORIA’ লেখা হত এবং এখনও হয়, যেহেতু শান্তিপুরের কাছে একই নামের একটি গ্রাম বর্তমান, যার বানানও ‘BELGHARIA’.
আরও পড়ুন
বেলঘরিয়ার পুরনো দিনের দুর্গাপূজা
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের ধারণাটিকেও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। ইংরাজি ‘BELL’ মানে ঘণ্টা। সেখান থেকে ‘ঘণ্টাঘর’ অর্থে ‘বেলঘর’ হওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হয় যে, ইংরেজদের প্রভাব ভালোমতো ছড়ানোর পরেই, তাদের মুখের উচ্চারণে ‘BELLGHAR’ থেকে ‘বেলঘর’ হয়েছে।
তাহলে ডঃ গোপাল মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় মতটির সম্বন্ধেও একই কথা। ইংরেজদের প্রভাবে ‘BAELGHAR’ বা ‘BELGHAR’ থেকেই যদি ‘বেলঘর’ হয়, তাহলে এটা ধরে নিতে হয় যে, ইংরেজ আগমনের আগে ‘বেলঘর’ নামটির কোনো অস্তিত্বই ছিল না।
বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় সহ বেশিরভাগ লোকই সমর্থন করেন গোপালবাবুর প্রথম মতটি। অর্থাৎ বেলগাছের আধিক্যের কারণে এবং ফলনশীল বেলের আকৃতি অস্বাভাবিক বড়ো হওয়ার ফলেই স্থানটি ‘বেলঘর’ নামে পরিণত হয়। এই অঞ্চলের জমিদার গঙ্গোপাধ্যায়’দের বাগানে(ফিডার রোডের পাশে) বিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্তও প্রায় ১০-১২ কেজির বেল হতো বলে প্রবীণরা জানিয়েছেন। এতে কোনো সংশয়ই নেই যে, গ্রামটির আগেকার নাম ছিল ‘বেলঘর’। বিভিন্ন লেখকের রচনাতেও এই নামেরই উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত, বেলঘরের গঙ্গোপাধ্যায় জমিদার বংশের বর্তমান সদস্য স্বপন গঙ্গোপাধ্যায় বেলগাছের আধিক্যের যুক্তিটি ছাড়া দ্বিতীয় সম্ভাবনা হিসেবে ‘ঘন্টাঘর’এর তত্ত্বও বলেছেন। তাঁর বক্তব্য, সিরাজদৌল্লা যখন ১৭৫৬ সালে কলকাতা আক্রমণ করতে আসেন, ইংরেজ’রা এই অঞ্চলে একটি ‘বেল’ বা ‘ঘন্টা’ লাগিয়েছিল, তৎকালীন সাইরেন হিসেবে ব্যবহারের জন্য। তা থেকে ‘বেলঘর’ হওয়াও অস্বাভাবিক নয়, স্বপনবাবুর মতানুযায়ী।
তবে কমল চৌধুরীর ‘বেলগড়ে’ থেকে ‘বেলঘরিয়া’য় পরিবর্তনের মতটি অস্বাভাবিক। কেননা, তাহলে ‘বেলঘর’এর অস্তিত্বই লুপ্ত হয়ে যায়। আমিও ডঃ গোপাল মুখোপাধ্যায়ের মতটিকেই সম্ভাবনা তত্ত্বের একেবারে ওপরের দিকে রেখেছি এর যুক্তিগ্রাহ্যতার কারণেই।
আশ্চর্যের বিষয়, উইলিয়াম কেরী’র নথিতে(১৮১৭) বেলঘর গ্রামের যে বানানটি পাওয়া গেছে, সেটি ‘VELEGHURIA’ ছাড়া আর কিছুই নয়!
(ঋণ – বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে / তন্ময় ভট্টাচার্য)