গ্রামোফোনের সরস্বতী

বাঙালির শীতের সকাল, গঙ্গার ঘাট। তার একপাশে কুমোরটুলি। মাঘ মাসের চতুর্থী থেকে এ-তল্লাটের ব্যস্ততা অন্যরকম। কাল সকালে কোনও কোনও বাড়ির ঠাকুরের চোখদান করবেন পালমশাই। বাগদেবী চোখ মেলবেন। বাঙালি জীবনে বাগদেবীর মাহাত্ম্য অনেক। দোয়াত কলম, কাঁচা দুধের কালিতে বাগদেবীর নাম লিখন দিয়েই তো শুরু হয় বাঙালির বিদ্যাচর্চা। তারপর সেই চর্চা গড়াতে থাকে আপন ছন্দে। আমাদের দেবদেবীর ঠিকুজি-কুষ্ঠী চর্চা করতে গেলে ধান ভানতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। তাই স্বল্প কথায় কিছু তথ্য রাখা যাক মাত্র। দেবী দুর্গার নিজ বামে সরস্বতীর অবস্থান। কেউ বলেন দেবীর গাত্রবর্ণ ধারণ করে আছেন লক্ষ্মী আর শিবের গাত্রবর্ণ ধারণ করে আছেন সরস্বতী। আবার বাহনবাদীরা এও বলেন যে সরস্বতীর বাহন রাজহাঁস। যিনি দুধ থেকে জলকে পৃথক করতে পারেন। তাছাড়া দেবীর হাতে যে বীণা থাকে সে তো আসলে সাত সুরের সমন্বয়। সাত সুর সাত রঙের প্রতীকী তাৎপর্য বহন করে। সাত রঙ মিশে যেমন সাদা দেখায় ঠিক তেমনই সরস্বতীর গাত্র বর্ণ। এসব নিয়েই সরস্বতী চর্চা।

বিশ শতকের মধ্যপর্বে বাঙালির গানের তল্লাটেও সরস্বতী, আবার আয়ুর্বেদ শাস্ত্রীর কবিরাজি বিজ্ঞাপনেও সরস্বতী। এদেশে গ্রামোফোন চর্চা আসার পরে বাজারে একটা পোস্টার ছেয়ে যায়। যে পোস্টারের তলায় লেখা হত ‘গ্রামোফোনের সরস্বতী’। বীণার একপাশে চোঙ দেওয়া গ্রামোফোন। যা বাজাচ্ছেন স্বয়ং বাগদেবী। চারপাশে এক চমৎকার ল্যান্ডস্কেপ। আবার জানুয়ারি মাসের দিকে ১৯০৮-এ ক্রিক রো-তে প্রথম যে স্বদেশী কোম্পানি ইংরাজি নামের বদলে বাঙালি নাম রাখলেন, তা হল ‘বীণাপাণি’ রেকর্ড। এর সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঘরে গানের আসর, খিচুড়ি ভোগের আয়োজন, মেয়েদের প্রথম শাড়ি পরে বড় হওয়া কতকিছুই জড়িয়ে থাকে এই সরস্বতীতে। আবার সরস্বতীর ছবি এঁকে কী বিপদেই না পড়েছিলেন শিল্পী হুসেন। দেখতে দেখতে আবার এসে গেল পুজো। মনে হয় সবাই মিলে বসে আবার ‘হাতেখড়ি’ করি। তার আগে পর্যন্ত নারকেল কুল, টোপা কুল, বোম্বাই কুল নৈব নৈব চ।