বিয়ের তত্ত্ব সাজানোর মতো ঘরোয়া কাজে কীভাবে ঢুকে পড়ছে পেশাদারিত্ব?

বাড়িতে বিয়ে মানেই ডাক পড়ত রাঙা পিসি, ফুল মাসিদের। দিন দশ আগে থেকে কাকা, জ্যাঠা, মামা, মেসোদের আগমনে গমগম করত বাড়ি। পাড়া-প্রতিবেশীদের ঢল নামত। আনন্দনাড়ু পাকানো, তত্ত্ব সাজানো থেকে নানান শ্রীআচার, রীতি, রেওয়াজ সবাই মিলে পালন করতেন। এ দৃশ্য আজ বিরল! একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে সবাই ফ্ল্যাটে উঠে এসেছে। বিয়ে মানে এখন খুব জোর দিন তিনেকের অনুষ্ঠান। আত্মীয়-পাড়া-পড়শি সমাগম হয় এক-দুই দিনের জন্য। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা, ক্যাটারারেরাই এখন যাবতীয় আয়োজন করে। কোমরে গামছা বেঁধে, জামার হাতা গুটিয়ে, হাতে বালতি নিয়ে পাড়ার দাদা ও তুতো ভাইদের পরিবেশন করতে দেখা যায় না আর! খুঁটিনাটি বিয়ের যাবতীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে গড়ে উঠেছে বহু ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা।
বিয়ে তত্ত্ব, যা দু-বাড়ির মধ্যে বিলি করা হয়, একদা তা সাজাতেন পাড়ার দিদি, কাকিমা, পিসি, নিকট আত্মীয়রা। পাড়ার যে মেয়েটি ভালো আল্পনা দিতে পারে, পরিবারের যে কাকিমা ভালো পুজোর জিনিস গোছাতে জানেন, তাঁদেরই ডাক আসত বিয়ের তত্ত্ব সাজানোর জন্য। কুটুম বাড়িতে সম্মান রক্ষার বিষয়, ছেলেখেলা নয়, সুন্দর করে সাজাতে হবে। অধুনা তত্ত্ব সাজানোর জন্য পেশাদারদের ভাড়া করেন বিয়েবাড়ির কর্তারা। বিভিন্ন সংস্থা তৈরি হয়েছে। তত্ত্ব সাজানোকে অনেকেই পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছেন গত এক দশকে। কাকিমা-মাসিমা-দিদি-বৌদিদের হাতে থেকে কীভাবে তত্ত্ব সাজানোর ভার এসে পড়ল পেশাদারদের হাতে? এই প্রবণতার জন্ম হল কবে? বঙ্গদর্শন.কম কথা বলেছিল এমন কিছু মানুষের সঙ্গে যাঁরা পেশাগতভাবে তত্ত্ব সাজানোর কাজ করেন।
কুটুম বাড়িতে সম্মান রক্ষার বিষয়, ছেলেখেলা নয়, সুন্দর করে সাজাতে হবে। অধুনা তত্ত্ব সাজানোর জন্য পেশাদারদের ভাড়া করেন বিয়েবাড়ির কর্তারা। বিভিন্ন সংস্থা তৈরি হয়েছে। তত্ত্ব সাজানোকে অনেকেই পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছেন গত এক দশকে।
নবদ্বীপের দেবশ্রী মোদক প্রায় চার বছর ধরে তত্ত্ব সাজান। দেবশ্রীর কথায়, “তত্ত্ব সাজানোর কাজের চাহিদা আছে। দিন দিন তা বৃদ্ধি পাচ্ছে।” তিনি বলছিলেন, “আমি দু’ভাবে কাজটা করি। আমার বাড়ি দিয়ে গেলে সাজিয়ে দিই আবার গ্রাহকদের অসুবিধা থাকলে তাঁদের বাড়ি গিয়ে সাজিয়ে দিই। আমার সঙ্গে আমার মা যান। আমি আর আমার মা (রিঙ্কু মোদক) দু’জনে মিলে করি। শখ, ভালো লাগার পাশাপাশি পেশা হিসাবেও করি। আমার মূল প্রফেশন নেইল এক্সটেনশনের কাজ। আমার কাজ মানুষ পছন্দ করে তাই তত্ত্ব সাজানোর কাজ করি। মা খুব সাহায্য করেন আমায়। প্রত্যেক সিজনে কাজ থাকে।” বিভিন্ন ট্রে অনুযায়ী ও সাজানোর ধরন অনুযায়ী পারিশ্রমিক নেন তিনি।
পেশাদারদের হাতে তত্ত্ব সাজানোর প্রবণতা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে দেবশ্রীর মত, “যে সব পরিবারের লোক সংখ্যা কম, এমন পরিবার থেকে বেশি কাজের বরাত আসে। বাড়িতে যদি একজন বা দু’জন চাকুরীজীবি থাকেন, সে সব পরিবারে একা একা কারও পক্ষে তত্ত্ব সাজানো সম্ভব নয়। এখন সবাই চায় বিয়েতে আসবো, আনন্দ করবো, চলে যাবো। কেউ কাজ করতে চায় না। সবাই নানান পেশায় যুক্ত, কেউই বিয়ের আগে থেকে এসে থাকতে পারেন না। এই জন্যেই আমাদের প্রয়োজন পড়ে।”
এখন সবাই নিত্যনতুনভাবে তত্ত্ব সাজাতে চাইছে। আরও কীভাবে সুন্দর করা যায়! এখন থার্মোকলের উপরে মডেল তৈরি হচ্ছে। তত্ত্ব সূচি, বর-কনের পোশাক দিয়ে নৌকা ইত্যাদি থার্মোকল দিয়ে তৈরি হচ্ছে। আগে কাপড় ভাঁজ করে নৌকা, হাঁস ইত্যাদি বানানো হত। এখন কেউ চাইছে না যে শাড়ির ভাঁজ নষ্ট হোক।
তত্ত্ব সূচি নামে একটি সংস্থা গড়ে তুলেছেন মুর্শিদাবাদ খাগড়ার অনিন্দিতা বিশ্বাস গোস্বামী। তিন-চার বছর ধরে তারা পেশাদারি সংস্থা হিসাবে বিয়ে তত্ত্ব সাজাচ্ছেন। অনিন্দিতা জানালেন, কাজের খুবই চাহিদা রয়েছে। গ্রামের দিকে প্রচুর তত্ত্ব সাজানোর কাজ পান তাঁরা। তাঁর কথায়, “যেসব পরিবারে লোকসংখ্যা তুলনায় কম, সাজিয়ে দেওয়ার কেউ নেই, এমন পরিবার থেকে বেশি সংখ্যায় কাজ আসে।”
সরকারি আর্ট কলেজ থেকে ফাইন আর্টস নিয়ে পড়াশোনা করা আকাশ নন্দী প্রায় বছর দশেক ধরে তত্ত্ব সাজানোর কাজ করেন। তিনি গড়ে তুলেছেন সুচিত্রালয় আর্ট সেন্টার। তিনি বাচ্চাদের আঁকা শেখান পাশাপাশি শিল্পের প্রতি ভালোবাসা থেকে তিনি তত্ত্ব সাজান। তিনি মূলত হাওড়া, কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগনায় কাজ করেন। এমনকি মালদহ, কালিম্পঙেও বিয়ের তত্ত্ব সাজানোর কাজ করেছেন আকাশ। তিনি বলছিলেন, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে বেশিরভাগ কাজের বরাত পান। কমপক্ষে পঁচিশটি ট্রে-র হিসাবে পারিশ্রমিক নেন তাঁরা।
আকাশের কথায়, “পেশাদারদের দিয়ে তত্ত্ব সাজানোর প্রবণতা যত দিন যাচ্ছে, বাড়ছে। একেবারে প্রথমে এতটা ছিল না। এখন মধ্যবিত্তদের মধ্যে খুব দ্রুত হারে বাড়ছে। তাঁরা ভাবছেন, বাড়ি বা পাড়ার কেউ নয়। প্রফেশনালদের দিয়েই তত্ত্ব সাজাবো।”
তাঁর মতে, এখন সবাই নিত্যনতুনভাবে তত্ত্ব সাজাতে চাইছে। আরও কীভাবে সুন্দর করা যায়! এখন থার্মোকলের উপরে মডেল তৈরি হচ্ছে। তত্ত্ব সূচি, বর-কনের পোশাক দিয়ে নৌকা ইত্যাদি থার্মোকল দিয়ে তৈরি হচ্ছে। আগে কাপড় ভাঁজ করে নৌকা, হাঁস ইত্যাদি বানানো হত। এখন কেউ চাইছে না যে শাড়ির ভাঁজ নষ্ট হোক। আগে কাপড়ে সেফটিপিন দিয়ে নানা আকারে সাজানো হত তাতে শাড়ির ক্ষতিও হত। এখন মানুষ চাইছেন ‘ডেকোরেশন’ সুন্দর হোক। জিনিসগুলো নিজের মতোই থাকুক। এই বদলটা এসেছে। প্রথম দিকে যখন তত্ত্ব সাজাতাম মাছ, নৌকা তৈরি করা হত। দিনে দিনে শাড়ি ভাঁজের ধারণা বদলে গিয়েছে। শাড়ি শাড়ির মতোই থাকবে, বাইরে থেকে ফুল, থার্মোকলের নানান জিনিস দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হোক, এটাই নাকি মানুষ চান। আকাশের কথা থেকে অনুমান করা যায়, এক দশকে তত্ত্ব সাজানোর ধরনেও বদল এসেছে।
সদ্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে শ্রীরূপা সেনগুপ্ত (নাম পরিবর্তিত)। তাঁর বিয়ের তত্ত্ব সাজিয়েছে একটি পেশাদার সংস্থ। শ্রীরূপা বলেন, “বাড়িতে মা আর আমি। বাবা নেই। কত কাজ, কে করবে! একটা সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তারাই সব করে দিয়েছে।” নিউ আলিপুরের সায়ন মুখোপাধ্যায় জানুয়ারিতে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। তিনি জানান, “বাড়ির গেট, গাড়ি সাজানোর কাজ যাঁদের দিয়েছিলাম। ওঁরাই প্রথম জিজ্ঞাসা করেছিল তত্ত্ব সাজানোর বিষয়ে। তখনই জানলাম আজকাল পয়সা নিয়ে এই কাজটাও করা হচ্ছে। ওঁদের দায়িত্ব দিলাম। ভালোই কাজ করেছে। এ বাড়ির তত্ত্বের প্রশংসিত হয়েছে।”
যৌথ পরিবারের বদলে ‘নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি’ আদতে মানুষের লোকবল কমিয়ে দিয়েছে। আগে হাঁক-ডাকে, আপদে-বিপদে-অনুষ্ঠানে ছুটে আসতেন পড়শিরা, সেদিনও আর নেই। ফলে তত্ত্ব সাজানোয় মাসিমা-কাকিমাদের দেখা মিলছে না। পাশাপাশি মানুষ আরও স্বাচ্ছন্দ্যের পিছনে ছুটছেন, সব কিছু নিখুঁত করতে চাইছেন, অন্যকে টেক্কা দিতে চাইছেন। রয়েছে সময়ের অপ্রতুলতা। যার ফলে বিয়ের তত্ত্ব সাজানো-র মতো ঘরোয়া কাজেও ঢুকে পড়ছে পেশাদারিত্ব। খুব স্বল্প পরিসরে হলেও এতেও কিন্তু কর্মসংস্থান হচ্ছে। শিল্পকলা পাচ্ছে প্রকাশ মাধ্যম। মানুষ উপার্জন করছেন।