মুকুলের সোনার কেল্লায় ভর করে কীভাবে পর্যটন মানচিত্রে উঠে এল রাজস্থানের জয়সালমের?

রাজস্থানের ধূ-ধূ মুরুভূমির বুক চিরে ছুটে চলেছে ট্রেন, ভিতরে মুকুল আর ‘আসল দুষ্টু লোক’ ভবানন্দ। সে ট্রেন রুখতে উটের পিঠে চড়ে হাজির ফেলু, তোপসে আর জটায়ু। ছবিতে এহেন দৃশ্য দেখে তাজ্জব বনে গিয়েছিল বাংলা তথা তাবড় ভারত, দর্শক উপভোগও করেছিল তাড়িয়ে তাড়িয়ে। ১৯৭৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর মুক্তি পেয়েছিল সোনার কেল্লা। বইয়ের পাতা ছেড়ে পর্দায় এলেন ফেলুদা। বাঙালি তাকে আপন করে নিল। তারপর কেটে গিয়েছে পঞ্চাশটি ডিসেম্বর, কিন্তু আজও বিন্দুমাত্র কমেনি সোনার কেল্লা ছবির প্রতি দর্শকদের আকর্ষণ। মানুষের মনে গেঁথে গিয়েছে ছবির প্রতিটি দৃশ্য, সংলাপ, চরিত্র। কিন্তু সিনেমা কি কেবল মননেই প্রভাব ফেলে? আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে কি তার কোনও প্রভাব নেই? প্রেক্ষিত যদি সোনার কেল্লা হয়, তবে বলতে হয় আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সোনার কেল্লার প্রভাব অসীম। তার জীবন্ত প্রমাণ হল জয়সালমের সহ গোটা পশ্চিম রাজস্থান। একটি সিনেমা মরু শহরকে পর্যটন শিল্পের মূলস্রোতে এনে ফেলল।
একসময় জয়সালমের ছিল পাণ্ডব বর্জিত এলাকা। কেউই সেখানে বেড়াতে যেতেন না। রাজস্থান, দেশের পর্যটন মানচিত্রে জায়গা করে নিলেও, ঠাঁই মেলেনি জয়সালমের-সহ পশ্চিম রাজস্থানের। তারপর মুকুল ও সত্যজিৎ রায়ের দৌলতে বদলে গেল জয়সালমের। নিজের গপ্পোকে জয়সালমের নিয়ে গিয়ে ফেললেন মানিকবাবু। ফলে সিনেমাতেও উঠে এল পশ্চিম রাজস্থানের এই জনপদ। ছবির দৌলতে দেশের পর্যটন মানচিত্রে ঢুকে পড়ল জয়সালমের। পর্যটকেরা এলেন, ভিড় জমে উঠল। হোটেল, লজ তৈরি হল। গাড়ি-ঘোড়া, ট্যাক্সি-ট্রাফিক বাড়ল, দোকান-হাট-বাজার তৈরি হল। অর্থনীতি চাঙ্গা হল। স্থানীয়েরা উপার্জন পেলেন। কর্মসংস্থান হল। জয়সালমেরের জন্য সত্যজিৎ রায় এবং মুকুল ধর যেন ভাস্কো দা গামা হয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। গোটা জয়সালমির আজও কৃতজ্ঞ সত্যজিৎ রায়ের প্রতি, মুকুলের প্রতি। তাঁরা ঈশ্বর জ্ঞানে সত্যজিৎকে ভালোবাসেন। শ্রদ্ধা করেন। দোকানে সত্যজিৎ রায়ের ছবি রাখেন। দোকান, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নাম রাখেন মুকুলের নামে।
রাজস্থান, দেশের পর্যটন মানচিত্রে জায়গা করে নিলেও, ঠাঁই মেলেনি জয়সালমের-সহ পশ্চিম রাজস্থানের। তারপর মুকুল ও সত্যজিৎ রায়ের দৌলতে বদলে গেল জয়সালমের। নিজের গপ্পোকে জয়সালমের নিয়ে গিয়ে ফেললেন মানিকবাবু। ফলে সিনেমাতেও উঠে এল পশ্চিম রাজস্থানের এই জনপদ।
কীভাবে সোনার কেল্লা ছবির মাধ্যমে বদল গেল জয়সালমিরের আর্থ-সামাজিক অবস্থা? তা জানতে বঙ্গদর্শন.কম কথা বলেছিল, প্রখ্যাত অভিনেতা কুশল চক্রবর্তীর সঙ্গে। সোনার কেল্লা ছবিতে মুকুল চরিত্রে তিনিই অভিনয় করেছিলেন। তাঁর কথায়, “প্রাক সোনার কেল্লা সময়ে রাজস্থানের পর্যটন বলতে একদিকে যোধপুর আর অন্যদিকে চিতোর। এর বাইরে কিছু নয়। পশ্চিম রাজস্থান ছিলই না।” সোনার কেল্লা পরবর্তী সময়ে অন্য ছবির শুটিং করতে গিয়ে তাঁর চোখে পড়ে পরিবর্তন। সেই অভিজ্ঞতার কথাই জানিয়েছেন পর্দার মুকুল। তিনি বলেন, “জয়সালমেরে তো কিছু নেই। সোনার কেল্লার জন্য এবং পাহাড়ি ট্যুরিস্টদের জন্যেই জয়সালমেরের পর্যটন শিল্প জমে উঠেছে। জয়সালমেরে কিছু ছিল না। লোকে চিনত না। অত দূরে মানুষ যেতও না। এখন জয়সালমের খুবই জনপ্রিয়। দূর্গের নামই তো সোনার কেল্লা হয়ে গেছে। আমি গিয়ে দেখেছি মুকুলের নামে দোকান আছে। দোকানে সত্যজিৎ রায়ের ছবি আছে। ওঁরা আমাকে বলেছিল, ‘ভাস্কো দা গামা যেমন নতুন দেশ খুঁজে বার করেছিলেন, তেমন সত্যজিৎ রায় আমাদের খুঁজে বার করেছেন।’ ওঁদের বক্তব্য, ভগবানের পরে সত্যজিৎ রায়।”
তিনি আরও বলছিলেন, জয়সালমেরে প্রচুর বাঙালি পর্যটক যান। এত বাঙালি পর্যটক যাওয়ার কারণে ওঁরাও (পশ্চিম রাজস্থান, মূলত জয়সালমেরের লোকেরা) ভালো বাংলা বলতে পারেন। সোনার কেল্লা ছবি তৈরি হওয়ার পরে পর্যটন শিল্পের দিকে থেকে এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে জয়সালমের। অন্তর্জাতিক ট্যুরিস্ট আছেই তা ছাড়া জয়সালমের যাঁরা বেড়াতে যান, তাঁদের পঞ্চাশ শতাংশই বাঙালি। কুশল চক্রবর্তীর মতে, এর পুরো কৃতিত্বই সোনার কেল্লা সিনেমার। ওখানে সবটাই সত্যজিৎ রায় এবং মুকুলকে ঘিরে। কারণ সোনার কেল্লা হল মুকুলের বাড়ি। সোনার কেল্লা ছবি না-হলে এতদিন হয়তো জয়সালমের থাকতই না।
কুশল চক্রবর্তীর কাছেই শোনা, জয়সালমেরের নানান দোকানে সত্যজিৎ রায়ের বিভিন্ন ছবি সাজানো রয়েছে। কিছু ছবি তুলে এনে, সন্দীপ রায়কে দেখিয়েছিলেন তিনি। সন্দীপ রায় বলেছেন, এর মধ্যে বেশ কিছু ছবি তাঁর (সন্দীপ রায়) কাছেও নেই। এগুলো কোথা থেকে পাওয়া তিনিও জানেন না। খুব সম্ভবত শুটিংয়ের সময় স্থানীয় বাসিন্দারা এসব মুহূর্ত লেন্স বন্দি করেছিলেন।
পশ্চিম রাজস্থানে সবটাই সত্যজিৎ রায় এবং মুকুলকে ঘিরে। কারণ সোনার কেল্লা হল মুকুলের বাড়ি। সোনার কেল্লা ছবি না-হলে এতদিন হয়তো জয়সালমের থাকতই না।
জয়সালমিরে একাধিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হয়েছে মুকুলের নামে। তেমনই একটি দোকান মুকুল স্টোন শপ, এই দোকানের বয়স প্রায় পনেরো বছর। ২০১০ সালের ৫ অগাস্ট দোকানটির পথ চলা আরম্ভ হয়। দোকানের নাম মুকুলের নামে রাখার কারণ হিসাবে মুকুল স্টোন শপের কর্ণধার অশোক সিং ভাটি বঙ্গদর্শন.কম-কে বলছিলেন, “সোনার কেল্লা মুভি তৈরি হওয়ার আগে জয়সালমেরে কোনও মানুষ আসত না। সিনেমা মুক্তি পাওয়ার পর বাঙালিরা সিনেমা দেখে এখানে বেড়াতে (জয়সালমের) আসতে শুরু করে। বাঙালিরা নিজেদের ক্যামেরায় জয়সালমেরের ছবি তুলে, সে সব ছবি অন্যদের দেখিয়ে জয়সালমিরকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। তারপর থেকে এখানে পর্যটকেরা আসতে শুরু করেছে। আজ ভারতের পর্যটন মানচিত্রে জয়সালমের জায়গা পেয়েছে ‘মুকুল ভাইয়া’র জন্যে। জয়সালমের আর ‘মুকুল ভাইয়া’র নাম এক সঙ্গে উচ্চারিত হয়। আমার দোকানের বয়স চোদ্দ বছর হয়ে গেছে। আমি যখন পাথরের দোকান খুলবো বলে ঠিক করলাম, তখন ভাবলাম মুকুলের নামেই দোকানের নাম রাখি। মুকুল আমাদের জয়সালমেরকে খ্যাতি এনে দিয়েছে।”
তিনি আরও বলছিলেন, বাঙালিরা মুকুল শপ নাম দেখে আরও বেশি করে তাঁর দোকানে আসে। অশোক বলছিলেন, সম্প্রতি (২০২৪, ডিসেম্বর) জয়সালমেরের সংবাদপত্রে সত্যজিৎ রায়, মুকুলকে নিয়ে খবর ছাপা হয়েছিল। তিনি তা পড়েওছেন। তাঁর কাছেই শোনা, আগে দূর্গের নাম ছিল ত্রিকূট গড় (জয়সালমির ফোর্ট)। কারণ, দূর্গটি তিনটে পাহাড়ের উপর অবস্থিত। ওখানেই সোনার কেল্লার শুটিং হয়েছে। সিনেমা মুক্তি পাওয়ার পর লোকের মুখে মুখে দূর্গের নাম সোনার কেল্লা হয়ে গিয়েছে। সিনেমা হিট হতেই জয়সালমেরে পর্যটকদের ভিড় শুরু হয়।
অশোক বললেন, “আজও গুজরাতি, দক্ষিণ ভারতীয় এমনকি বিদেশি যে পর্যটকই আসুক না কেন, সোনার কেল্লা সিনেমার কথা বলেন তাঁরা। বলেন, এখানে বাংলা সিনেমা তৈরি হয়েছিল। আমাকেও সবাই এসে জিজ্ঞাসা করে, দোকানের নাম কেন মুকুল স্টোন শপ রাখলাম। আমিও সত্যজিৎ রায়ের কথা বলি। বলি, বাংলা সিনেমা তৈরি হয়েছিল, তারপরই জয়সালমের বিখ্যাত হয়েছে।”
সিনেমা মাধ্যমটি দ্রুত গতিতে এবং বিপুল সংখ্যক মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। সোনার কেল্লা ছবিকে ঘিরে জয়সালমেরের উত্তরণের সফর সত্যিই অনন্য। আদপে শিল্পের যে ভাষা হয় না, তার সাক্ষ্যই যেন বহন করছে সোনার কেল্লা পরবর্তী সময়ে দেশের অন্যতম সেরা পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে জয়সালমেরের উঠে আসা। এক চলচ্চিত্র গোটা জনপদের আর্থিক হাল-হকিকত বদলে দিল, এমন জিনিস বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বিরল।
পঞ্চাশ বছর আগে মুক্তি পাওয়া একটি বাংলা ছবি আজও সুদূর পশ্চিম রাজস্থানের এক জনপদের মানুষের অন্নসংস্থান করে যাচ্ছে। এখানেই স্রষ্টা সত্যজিৎ এবং তাঁর সৃষ্টির সার্থকতা। জয়সালমেরের মানুষও তাঁদের ভাস্কো দা গামার প্রতি কৃতজ্ঞ। মুকুলের নাম, সত্যজিৎ রায়ের ছবি, সোনার কেল্লা সিনেমার স্মৃতি তাঁরা বুকে করে আগলে রেখেছেন। এটাই হয়ে উঠেছে জয়সালমেরের পর্যটন শিল্পের ইউএসপি।