কেমন আছে রাভা জনগোষ্ঠী?

একসময় তাঁরা ঘর থেকে বের হতেন না। বাইরের লোক তাঁদের জঙ্গল বস্তিতে এলে তাঁরা ঘরের কোণেই মুখ লুকোতেন। পুরুষদের পরনে থাকত নেংটি। আজ সরকারি বিভিন্ন কর্মসূচি ও গানবাজনা বিশেষ করে বিশ্বায়ন ও আধুনিক ডিজিটালাইজেশনের ফলে তাদের মধ্যে অনেক পরিবর্তন আসা শুরু হয়েছে। উত্তরবঙ্গের প্রাচীন নৃগোষ্ঠী হিসাবে পরিচিত রাভা-রা এখন নতুন পথের পথিক।

তাঁদের রাভা বলা হলেও আসলে তাঁরা কোচা-ক্রৌ । উত্তরবঙ্গের তরাই ও ডুয়ার্স অঞ্চলে ৩৮টি নৃগোষ্ঠীর লোক বসবাস করেন। এরমধ্যে জলপাইগুড়ি জেলাতেই ৩০টি নৃগোষ্ঠীর লোক রয়েছে বলে খবর। তার মধ্যে বাইরের লোকদের কাছে রাভা হিসাবে পরিচিত কোচা-ক্রৌ একেবারে আলাদা। ইতিহাসবিদদের মতে, ১৪৫০ থেকে ১৪৬০ খ্রিস্টাব্দের সময় গারোদের এক শক্তিশালী রাজা গারো পাহাড় অঞ্চল ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় কৃষিকাজে পারদর্শী ও অভিজ্ঞ কোচদের ঐ উপত্যকায় নিয়ে যান। তারপর তাঁদের নিয়ে শিবির করে গারোদের কৃষি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। আর এই বাইরে থেকে ডেকে নিয়ে আসা-কে গারো ভাষায় বলা হয় ‘রাবা’, যার অর্থ আহুত। পরে এই রাবা থেকেই রাভা শব্দটি এসেছে। রাভারা মূলত ইন্দো-মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠী। এরা অসম থেকে এই বাংলার উত্তরবঙ্গে বিস্তৃত। কোচ বা কোচা-ক্রৌ থেকেই রাভাদের মূল উৎপত্তি। উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহারের আন্দুবস্তি, কুরমাইবস্তি, বানিয়াবস্তি, মেন্দাবাড়ি, খয়েরবাড়ি, ধুমচি, পারো, নিমতি, কামাখ্যাগুড়ি, গোঁসাইর হাট, তুফানগঞ্জ সহ অন্য বনবস্তি এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করেন তাঁরা।
২০০১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহে তাঁদের সংখ্যা যথাক্রমে ১২২২১, ২২৮০, ৫, ২১, ৪ ও ৩ জন। কোচ যুক্ত করলে এই সংখ্যা আরও বেশি হবে। গোটা রাজ্যে তাঁদের সংখ্যা দুই লক্ষ ৭৭ হাজার। সুশীল কুমার রাভা তাঁর বৈরাতী সংখ্যার লেখায় জানাচ্ছেন, কোচা-ক্রৌ মূলত চিনীয় ভোটবর্মী ভাষা পরিবার ভুক্ত। সরকারি ভাবে কোচা-ক্রৌ নামটি স্বীকৃত না হলেও যুগযুগান্ত ধরে বংশ পরম্পরায় বহন করে নিয়ে আসা চিরায়ত এই নামটিই গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত। রসিকবিলের বাসিন্দা গবেষক ছাত্র সুশান্ত রাভা-র কথায়, ‘আমি নিজের পয়সা খরচ করে রাভা আর কোচা নিয়ে কাজ করছি। ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত কাজ করে যা জেনেছি তা হল, রাভারা এসেছেন কোচা থেকে। তাদের ভাষা হল কোচা-ক্রৌ। এই কোচ-রা প্রকৃতির উপাসক। যদিও তাঁদের অনেকেই আজ এই ভাষা জানেন না। হারিয়ে যেতে বসেছে এই ভাষা। তাঁদের মধ্যে যারা হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত হলেন তাঁরা মূর্তিপুজো শুরু করলেন।

এই রাভারা তাঁদের নাচগান, আর তাঁদের ঘর নিয়েই একসময় জঙ্গলের মধ্যে পড়েছিলেন। তাঁরা ঝুম চাষ করতেন। চাষবাস ছাড়া মাছ ধরায় তাঁরা পটু ছিলেন। তার পাশাপাশি তাঁত বোনাও তাঁদের একটি গুণ। তাঁরা নিজেদের পোশাক নিজেরাই তৈরি করতেন। নেংটি পরা ছেড়ে তাঁরা নিজেদের জন্য পোশাক তৈরি করতে লাগলেন এক সময়। তাঁদের অবসর প্রাপ্ত সংস্কৃতি কর্মীদের মধ্যে একজন, ধীরেন্দ্র রাভা থাকেন আলিপুরদুয়ারের চিলাপাতা লাগোয়া কুরমাই বস্তিতে। তিনি জানালেন, রাভাদের ঘরে এখন বছরে একবার শিবপুজো হয়। রান্নাঘরে দুটি মাটির হাড়ি রাখা হয়। একটি কেবল শিব, অন্যটি পার্বতী। সেখানে চাল ঢেকে রেখে পুজো হয়। গ্রাম বা বস্তির সকলে মিলে একত্রিত হয়ে পুজো করে। এইসব অনুষ্ঠানের কোনোটাকে বেওসি, কোনোটাকে রুম্পুক বলে। এর বাইরে হি হি হা হা পুজো, হুজি পুজো, বাইখো বা দুর্গোৎসবের কথাও শোনা যায়। হুজি মানে একপ্রকার ওঝা। রোগব্যাধি হলে হুজি-র কাছে গেলে বলা হয় শুয়োর অথবা মুরগি বলি দিয়ে পুজো করতে। তাঁদের মধ্যে যাঁরা আবার খ্রিষ্টান তাঁদের মধ্যে অবশ্য এইসব পুজোর প্রথা নেই।

যাঁরা পুজো করেন তাঁরা পুজোর সময় গামছা, নেংটি আর গেঞ্জি পড়তেন। মাথায় বাঁধা থাকত সাদা কাপড়। আর নাচ গানের সময় পুরুষরা ধুতি আর জামা পড়তেন। মেয়েরা লুফুন। আগে কেউ পড়াশোনা করতেন না। অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের হয় কৃষিকাজ বা নাচগানে নামিয়ে দিতেন। তাঁদের সমাজ মূলত মাতৃতান্ত্রিক। আর বিয়ের পর ঘর জামাই থাকার প্রথা রয়েছে।
নব্বইয়ের শেষ দিকে তাঁদের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আসা শুরু হয়। সরকারের কৃষি দপ্তর তাঁদের মধ্যে উচ্চফলনশীল ধানের বীজ দিয়ে তাদের উন্নত কৃষিকাজের প্রশিক্ষণ দেয়। এর অনেক আগেই অবশ্য তাদের মধ্যে ঝুমচাষের ধারায় পরিবর্তন ঘটে। চাষবাসে পরিবর্তন আসতে থাকায় তারা গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসে যেতে থাকেন। গান বাজনার জন্য তাঁদের সরকারি তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর বিভিন্ন সহায়তা দিতে থাকে। ফলে তাঁরা বন থেকে বিভিন্ন কাজে শহরে যাওয়া শুরু করেন। আর তাতেই তাঁদের মধ্যে অনেক পরিবর্তন আসা শুরু হয়। এই পরিবর্তন বলতে তাঁরা এখন নেংটি বা গামছা না পড়ে প্যান্ট, জামা পরছেন। বাইরে গেলে কথাও তাঁরা বলছেন বাংলা ভাষায়। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা চিলাপাতা আন্দুবস্তির শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের শিশু সহায়িকা জ্যোৎস্না বলেন, তাদের ছেলেমেয়েরা এখন বাংলা বলতে জানে। তারা বাংলার সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্রে ইংরেজি শিখছে। তারা শিখছে ভূগোল, বিজ্ঞান। তাদের কেন্দ্রে ৪৫ জন রাভা ছেলেমেয়ে পড়ে। যারা বাংলা ভাষা জানে না, তাদের বিভিন্ন পড়ার বিষয় বাংলা থেকে রাভা ভাষায় অনুবাদ করে বুঝিয়ে দেন জ্যোৎস্না। জ্যোৎস্না আরও বলেন, কামাং, লুফুন তাঁদের মেয়েদের পোশাক হলেও তাঁরা এখন বাঙালিদের মতো শাড়ি পরছেন। লুফুন, কামাং বুক থেকে হাঁটু পর্যন্ত তাঁদের বস্ত্র। সেই সব ঐতিহ্যের বস্ত্র পুরুষ বা মহিলারা শুধু এখন নাচ-গান, উৎসবের সময়ই পড়েন। তাছাড়া সবাই ধীরে ধীরে প্যান্ট, শাড়ি পড়ে অফিসে যাচ্ছেন। অনেকে সরকারি অফিসে কাজে যান, কেউ আবার শিক্ষক। কেউ নানান কাজে ব্যাঙ্কে যাচ্ছেন। তাছাড়া নেট, মোবাইল, টিভি চলে এসেছে। ফলে দিন-কে-দিন পরিবর্তন হচ্ছে।

জ্যোৎস্নার স্বামী ভুটু রাভা জানালেন, অনেকদিন আগে তাঁদের পূর্বসূরীরা জঙ্গলের মধ্যে যে বাড়ি ঘরে থাকতেন সেই বাড়িঘর সব সময় নোংরা থাকত। তাঁরা ঘরেই থাকতেন। এখন সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প, তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের নাচগানের জন্য তাঁদের ভাতা দেওয়া ও বিশ্বায়নের ফলে তাদের জীবনযাত্রা অন্যমাত্রায় যাচ্ছে। ভুটু আরও জানান, তাঁদের খাবারের মধ্যে হাতির প্রিয় খাবার পুরুন্দি রয়েছে। এটা এক ধরনের কান্দা আলু জাতীয় খাবার। চিংড়িমাছের সঙ্গে এই পুরুন্দি বেশ স্বাদের। তাঁদের বিয়ে থেকে শুরু করে অন্যত্র শুয়োরের মাংস প্রধান খাবার। তার সঙ্গে আবার হাড়িয়া আছে। যদিও এখন শিক্ষার প্রসার ঘটায় হাড়িয়ার প্রভাব কমেছে। হাড়িয়া এক প্রকার নেশা করার তরল জিনিস। তাদের খাবারে তেল মশলা নেই। সিদ্ধ খেতে তারা বেশি ভালোবাসেন। সকালে তাদের ব্রেকফাস্ট নেই। সকাল নটার মধ্যে পেট ভরে ভাত খেয়ে নেন। এতে নাকি পেটে গ্যাস কম হয়। আর খাবারে কাঁচা লঙ্কা বেশি চলে। একটা সময় তাঁরা জঙ্গলের ধারে নদী থেকে মাছ ধরে তা পুড়িয়ে খেয়ে নিতেন। তাদের বাড়িঘর আগে বাঁশ, কাঠ, ছনের ছাউনি দেওয়া থাকলেও এখন কিছুকিছু পাকাঘরও করছেন তারা।

গনত রাভা, সুশীল রাভারা তাঁদের এই জনজাতির উন্নতির জন্য রাভা সমিতিও গঠন করেছেন। এর মধ্যে সুশীল রাভা তাঁদের রাভা নাচ ও গান নিয়ে বাইরেও অনুষ্ঠান করে আসছেন। দিল্লির লালকেল্লায় গিয়ে অনেক অনুষ্ঠান করে এসেছেন সুশীলবাবু। তিনি জানালেন, প্রয়াস চলছে আমাদের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার।