চির’সবুজ’ প্রমথ চৌধুরী

সরস্বতী পূজার দিন। রবীন্দ্রনাথ তার ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাকে নিয়ে এলবার্ট হলে এসেছেন বক্তৃতা দিতে। প্রেসিডেন্সি কলেজের মাঠে তখন বেড়াচ্ছেন প্রমথ চৌধুরী। হঠাৎ করে প্রমথ-র সাথে দেখা পুরনো বন্ধু নারায়ণ শীলের। নারায়ণ প্রমথকে জানালেন এলবার্ট হল-এ রবীন্দ্রনাথ এসেছেন বক্তৃতা দিতে। তাঁর খুব ইচ্ছা প্রমথকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা শুনতে যায়। কিন্তু প্রমথ সাফ ‘না’ করে দিলেন বন্ধু নারায়ণকে। নারায়ণ যখন দেখল বন্ধু প্রমথ-র বক্তৃতার প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই এবং যাওয়ারও কোনোরকম ইচ্ছাই নেই তখন সে প্রমথকে বলল, “বক্তৃতা শোনো না শোনো, রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রীকে দেখে আসি চল, শুনেছি সে অসামান্য সুন্দরী।”
ব্যাস! একথা শুনে প্রমথ গেলেন রেগে। আর রেগে গিয়ে একটি গাছের তলায় চুপ করে শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর বললেন- “পরের বাড়ীর খুকী দেখার আমার কোন ইচ্ছা নেই, ভাই।” কেউ জানত না সেদিন যে এই ‘পরের বাড়ির খুকী’ই একদিন হবেন প্রমথ-র স্ত্রী।
ঘটনাচক্রে ঠাকুরবাড়ির সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর ‘অসামান্য সুন্দরী’ কন্যা ইন্দিরার সঙ্গেই বিয়ে হয়েছিল প্রমথ-র। দু'জনেই খুব ভাল ফরাসি ভাষা জানতেন। বিয়ের আগে প্রমথ ও ইন্দিরার মধ্যে চিঠিপত্রের আদান-প্রদান চলত। আর সেই চিঠিপত্রে থাকত ফরাসি শব্দ তারা চিঠিপত্রে একে অপরকে 'Mon ami' বলে সম্বোধন করতেন। 'Mon ami' অর্থাৎ ইংরাজিতে 'My Friend'।
পাবনা জেলার হরিপুর গ্রামে ছিল প্রমথ’র আদিবাড়ি। বাবা দুর্গাদাস চৌধুরী ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মা মগ্নময়ী দেবীর বড় আদুরে ছেলে ছিল প্রমথ। প্রমথ তাঁর ‘আত্মকথায়’ লিখছেন—“আমি ছেলেবেলায় কৃষ্ণনগরেই বাস করতুম সাড়ে এগারো মাস আর হরিপুরে কাটাতুম পনেরো দিন। কিন্তু হরিপুর আমরা সঙ্গেই এনেছিলুম, আর সাথে এনেছিলাম তার মানসিক আবহাওয়াও।”
পাবনা থেকে এসে কৃষ্ণনগর কলেজে ভর্তি হলেন। তারপর কলকাতার নামজাদা হেয়ার স্কুল। সেখান থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন। আর এফ.এ. পাশ করেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে। দর্শন শাস্ত্র নিয়ে প্রথম শ্রেণীতে বি.এ এবং পরে ইংরাজিতে এম.এ. পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হলেন মেধাবী প্রমথ। এরপর প্রমথ চলে গেলেন ইংল্যান্ড, আইন পড়তে। ব্যারিস্টার হয়ে ফিরে এলেন চার বছর পর। ব্যারিস্টার হিসাবে প্রথম কাজে যোগ দিলেন কলকাতা হাইকোর্টে।
ব্যারিস্টারি অবশ্য বেশিদিন করলেন না। আইনের জটিল ব্যাপার-স্যাপার তাঁর খুব একটা ভালো লাগেনি। চাকরি ছাড়লেন। তারপর গেলেন আইন কলেজে। কিছুদিন আইন কলেজে অধ্যাপনার কাজ করলেন। মাঝে আবার কিছুকাল ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করলেন। তারপর কিছুদিন জোড়াসাঁকো ঠাকুর এস্টেটে চাকরি। তাও বেশিদিনের জন্য নয়। তারপর যোগ দিলেন গোপাল লাল এস্টেটের রিসিভার হিসেবে। দক্ষিণেশ্বর দেবোত্তর এস্টেটের ম্যানেজারও ছিলেন কিছুদিন প্রমথ। খামখেয়ালি প্রমথ একাধিক চাকরি করেছেন, ছেড়েছেন। কোথাও তাঁর মন বসেনি।
পাবনার বিখ্যাত সম্ভ্রান্ত চৌধুরী পরিবারের সন্তান প্রমথ চৌধুরী কেবল কুলে-মানে অভিজাত ছিলেন তা নয়, মনের দিক থেকে ছিলেন উদার। নানান সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মানুষটির মধ্যে আরও একটি মস্ত গুণ ছিল যা হল বিভিন্নধরনের মানুষের সঙ্গে খুব অনায়াসে মিশে যাওয়ার প্রবণতা। সদালাপী মানুষটি খুব সহজেই সবাইকে আপন করে নিতে পারতেন।
সাহিত্য ও সঙ্গীতের প্রতি প্রমথর বিশেষ অনুরাগ ছিল সেই ছোটবেলা থেকেই। সাহিত্যের প্রতি তীব্র অনুরাগবশত প্রমথ ‘সবুজপত্র’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। অবশ্য ‘সবুজপত্র’ পত্রিকা প্রকাশের সঙ্গে অন্য গল্পও জড়িয়ে আছে।
রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি উপলক্ষে শান্তিনিকেতনে এক সংবর্ধনা সভার আয়োজন হয়। যেখানে রবীন্দ্রনাথ কথাপ্রসঙ্গে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে কিছু অপ্রিয় কড়া কথা বলে ফেলেন। ফলে সংবর্ধনা সভায় উপস্থিত সাধারণ সভ্য, অতিথি, এবং সাহিত্যিকরা ক্ষুব্ধ হন এবং এই বিষয়কে কেন্দ্র করে কিছুদিন ধরে বিভিন্ন পত্রিকাতে রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে বিষোদগার চলতে থাকে।
এই সুযোগে রবীন্দ্রবিরোধীরাও রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতায় উঠে পড়ে লাগলেন। এসব দেখেশুনে কবি অত্যন্ত মর্মাহত হলেন এবং স্থির করলেন যে, সাময়িক পত্রিকার এই আচরণের কারণে তিনি সাময়িকপত্রে আর কোনোদিন কিছু লিখবেন না। এই সময় কবির অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ;প্রমথ চৌধুরীও একটা পত্রিকা প্রকাশের চিন্তাভাবনা করছিলেন। পত্রিকার কথা শুনে রবীন্দ্রনাথ প্রমথকে উৎসাহ দিলেন। এরপর, প্রমথ এই পত্রিকায় তাঁকে লেখার অনুরোধ করলেন। রবীন্দ্রনাথ না লিখলে পত্রিকা প্রকাশ সম্পূর্ণই হবে না। প্রমথ আবদারে নাছোড়বান্দা। সাময়িক পত্রিকাগোষ্ঠির ওপর অভিমান সত্ত্বেও এই মেধাবী প্রিয়পাত্রর কথায় শেষমেশ রাজি হলেন রবীন্দ্রনাথ। জানালেন, প্রমথ’র নতুন পত্রিকায় লিখবেন। প্রমথও যথাযোগ্য সম্মান উপুড় করে দিলেন রবীন্দ্রনাথকে। আর তাই, ‘সবুজপত্রে’র আত্মপ্রকাশ হল ২৫শে বৈশাখ, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনেই। সময়টা রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়ার ঠিক একবছর পর।
প্রমথ চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হল 'সবুজপত্র'। প্রতি সংখ্যার মূল্য ঠিক হল মাসিক চার আনা এবং বার্ষিক মূল্য ছ’আনা। সংখ্যাটির প্রথমদিকে তিনজন লেখক নিয়মিত কলম ধরলেন—সম্পাদক প্রমথ নিজে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। সম্পাদক ‘মুখপত্রে’ নিজ বক্তব্য শুরু করতেন ‘ওঁ প্রাণায় স্বাহা’ লিখে।
পত্রিকাকে কেন্দ্র করে ধীরেধীরে গড়ে উঠল একদল নতুন তরুণ লেখকগোষ্ঠী। শুধু লেখাই নয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে উঠলেন এই নতুন লেখকদের মূল অনুপ্রেরণা। “পুরনোকে বিদায় করতে চাই, নতুনের আবাহন চাই।” - এই ছিল সবুজপত্রের শ্লোগান।
এই সাময়িকীতে শুধু সবুজ রঙ-ই ব্যবহার করা হত। নন্দনাল বসু অঙ্কিত একটি সবুজ তালপাতা এর প্রচ্ছদে ব্যবহার করা হত। সবুজপত্রে কখনো কোনো বিজ্ঞাপন এবং ছবি প্রকাশিত হয়নি। প্রমথ চৌধুরী সাময়িকীটিকে বাণিজ্যিকভাবে আকর্ষক রূপ দেওয়ার জন্যে কোনো চেষ্টা করেননি। বরং তিনি এর গুণগতমান এবং আদর্শের কথা ভেবে সবসময় খুব সতর্ক থাকতেন।
প্রথম পর্যায়ে আট বছর নিয়মিত 'সবুজপত্র' প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর দ্বিতীয় পর্যায়ে কিছুদিন ‘সবুজপত্র’ প্রকাশিত হওয়ার পর সাময়িকীটি শেষ পর্যন্ত একাধিক কারণে বন্ধ হয়ে যায়।
‘সবুজপত্র’ যে তেরো বছর প্রকাশিত হয়েছিল তার পেছনে কবিগুরুর অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। এই ‘সবুজপত্রে’ই ‘শেষের কবিতা’ প্রকাশিত হয়। এছাড়াও ‘হালদার গোষ্ঠী’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘পয়লা নম্বর’-এর মতো বিখ্যাত সব ছোটগল্পও প্রকাশিত হয় এখানে।
রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর থেকেই লেখার চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ‘সবুজপত্রে’র কথা ভাবতে গিয়ে অন্য পত্রিকায় লেখার কাজে বিশেষ সময় দিয়ে উঠতে পারছিলেন না। ভাইজি-জামাই প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্রে’ লিখতে গিয়ে তিনি রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় পত্রিকা ‘প্রবাসী’তে লিখতে পারছিলেন না। ক্ষুব্ধ হলেন ‘প্রবাসী’ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। অসহায় কবি রামানন্দবাবুর মান ভাঙাতে শান্তিনিকেতন থেকে চিঠি লিখলেন রামানন্দবাবুকে – “প্রবাসীর প্রতি আমার মমতা কিছুই কমে নাই। আমার মুস্কিল এই যে ‘সবুজপত্রে’ ঢাকা পড়িয়াছি। ওটা আত্মীয়ের কাগজ বলিয়াই যে কেবল উহাতে আটকা পড়িয়াছি তাহা নহে। ওই কাগজটা আমাদের দেশের বর্তমান কালের একটা উদ্দেশ্য সাধন করিবে বলিয়া আমার ধারণা হইয়াছে।”
রবীন্দ্রনাথ চাইলেও অবশ্য ‘সবুজ-পত্র’কে কেন্দ্র করে শক্তিশালী কোনো লেখকগোষ্ঠি সেভাবে গড়ে ওঠেনি। সেই সময়ের বিখ্যাত অনেকে লিখলেও পত্রিকার নিয়মিত ও নিজস্ব লেখকের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা।
‘সবুজপত্রে’র একটি মারাত্মক দোষ ছিল এর ছাপার ত্রুটি। রবীন্দ্রনাথ বারে বারে এ-নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করলেও প্রমথ এই বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না। তাঁর সাফ কথ-- “ছাপার ভুলকে আমি তেমন মারাত্মক দোষ বলে মনে করি না, কেননা পাঠকমণ্ডলী ও ভুল নিজগুণেই অনায়াসে সংশোধন করে নিতে পারেন।”
‘সবুজপত্র’কে আকর্ষণীয় করে তুলতে প্রমথ চৌধুরীর বিশেষ কোনো চেষ্টা ছিল না। বাণিজ্যিক পত্রিকা কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে তাঁর কোনো ধারণাও তেমন ছিল না। পত্রিকাটি ছিল একেবারে বিজ্ঞাপনবর্জিত। প্রমথ শুধুমাত্র সাহিত্য চাইতেন। এ-বিষয়ে বলেছিলেন – “কলম চালানো আমার শখ, কাগজ চালানো আমার ব্যবসা নয়।” ‘সবুজপত্র’ ছাড়াও পরবর্তীকালে ত্রৈমাসিক ‘বিশ্বভারতী পত্রিকা’ ও মাসিক ‘অলকা’ পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন তিনি।
বীরবল' ছদ্মনামে প্রমথ প্রায়শই লিখতেন। এমনিতে তাঁর লেখালিখির শুরু ‘সবুজপত্র’ প্রকাশেরও আগে। ‘বীরবল’ ক্রমশই বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ধীরেধীরে ‘সবুজপত্রে’র মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে ‘বীরবলী চক্র’। আর বাংলা সাহিত্যে ‘বীরবলী যুগে’র সূচনা হয়। প্রমথ একটি কথা বারে বারে বলতেন “জোর-করা ভাব, আর ধার-করা ভাষা’য় সাহিত্য হয় না।” প্রমথ চৌধুরী বাংলাভাষীদের বোঝাতে চেয়েছিলেন, ‘‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ থেকে মানুষের মুখে নয়। উল্টোটা চেষ্টা করতে গেলেই মুখে শুধু কালি পড়ে।’’ বিশ্বাস করতেন, “শুধু মুখের কথাই জীবন্ত। যত দূর পারা যায়, যে ভাষায় কথাকে লিখতে পারলেই লেখা প্রাণ পায়।”
ফরাসি সাহিত্য ছিল প্রমথ-র প্রিয়। যে-কারণে বাংলায় ফরাসি ছোটগল্পের আঙ্গিকরীতির সাথে তিনিই প্রথম বাঙালি পাঠকদের পরিচয় করিয়েছিলেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে ইতালীয় সনেটের প্রবর্তক হিসেবেও খ্যাত। বাংলা সাহিত্যে ‘চুটকি’ সাহিত্যের প্রসার ও নতুনত্বে প্রমথ চৌধুরীর নাম বেশ খানিকটা ওপরের দিকে। ছোট ছোট লেখার মেজাজই তাঁর প্রিয় ছিল বেশি। নিজস্ব সাহিত্যরুচিতে, ভাবনায়, বক্তব্যে এবং পাণ্ডিত্যে তিনি আজীবন যথার্থই ছিলেন স্বাধিকার প্রমত্ত।