মৃত্যুর মুখে যন্ত্রণা? উপশমে ব্রতী বাঙালি চিকিৎসক শুভজিৎ রায়

“ডাক্তারে যা বলে বলুক নাকো,/ রাখো রাখো খুলে রাখো,/ শিয়রের ওই জানলা দুটো,/ গায়ে লাগুক হাওয়া/ ওষুধ? আমার ফুরিয়ে গেছে ওষুধ খাওয়া।”
(মুক্তি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
_______________
ওষুধ খাওয়া শেষ। এক অর্থে, চিকিৎসার আর হয়তো রোগীকে ফেরানো যাবে না। পরিস্থিতি এমনই। অথচ রোগী যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট। তা হলে সেই রোগীকে কি একটু আরাম দেওয়া যায় না? একটু আনন্দ দেওয়া যায় না জীবনের শেষ দিনগুলিতে?
এই ধরনের রোগীদের জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে উপশম চিকিৎসা। ইংরেজিতে একে বলা হয় প্যালিয়েটিভ কেয়ার (Palliative care)। রোগীর আয়ু যখন হাতে গোনা কদিন, তখন তাঁকে একটু আরাম ও আনন্দ দেওয়ার চিকিৎসা পদ্ধতি প্যালিয়াটিভ কেয়ার নামে পরিচিত। বিশ্ব জুড়ে এই পদ্ধতি ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও আমাদের দেশে কাজ খুব বেশি এগোয়নি। সেই কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন এক চিকিৎসক। ডা. শুভজিৎ রায় (Subhajit Roy) গড়িয়ার পাঁচপোতায় গড়ে তুলতে চলেছেন শুধু উপশম চিকিৎসার কেন্দ্র। তার শিলান্যাসও হয়ে গিয়েছে।
গড়ে ওঠার পথে হসপিস ইন্ডিয়া
শুভজিতের এই উদ্যোগের নেপথ্যে রয়েছে করুণ কাহিনি। মা, জ্যাঠামশাই, জেঠিমা ও দিদিকে ক্যান্সারে হারিয়েছেন তিনি। তাঁদের যন্ত্রণা দেখতে হয়েছে চোখের সামনে। মায়ের মৃত্যুর সময় শুভজিৎ কিশোর, চিকিৎসক হওয়ার পর দেখেছেন দিদির যন্ত্রণা। তাই ‘পেন ম্যানেজমেন্ট' নিয়ে পড়াশোনা করে রোগীর কষ্ট উপশমের শপথ নিয়েছেন। শুভজিৎ বলেন, ‘‘আমি অনেক যন্ত্রণা চাক্ষুষ করেছি। সেসব দেখে মনে হয়েছে, এর জন্য একটা কিছু করা দরকার। সেই লক্ষ্যে আমার স্বপ্ন ‘হসপিস ইন্ডিয়া’ (Hospice India)। সামান্য খরচে রোগীর পাশে থাকা আমাদের লক্ষ্য, যাতে জীবনের শেষ সময়টা একটু আনন্দ দেওয়া যায়। নানারকম থেরাপির সুযোগ মিলবে এই প্রতিষ্ঠানে। এর সঙ্গে বাড়িতে গিয়ে আমাদের টিম পরিষেবা দেবে।”
আরোগ্যের সম্ভাবনা নেই – এমন রোগীর যন্ত্রণা কমানোর লক্ষ্যে জনপ্রিয় হচ্ছে উপশম চিকিৎসা। কলকাতার (Kolkata) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আলাদা ইউনিট খোলা হয়েছে এ জন্য। গড়ে উঠছে শুধু উপশম চিকিৎসার আলাদা কেন্দ্র। এই চিকিৎসা সম্পর্কে শুভজিৎ বলেন, “ক্যান্সার-সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত অনেক রোগীর ক্ষেত্রে ওষুধের মাধ্যমে নিরাময়ের সম্ভাবনা থাকে না। চিকিৎসকরা বলেই দেন, এই রোগীর আয়ু সীমিত। সেই সময় রোগীর যন্ত্রণা উপশম করা পরিবারের পক্ষে কঠিন হয়ে ওঠে। প্রিয়জনের যন্ত্রণার সাক্ষী হয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন পরিবারের সদস্যরা। রোগী ও তাঁর পরিবারকে স্বস্তি দেওয়াই উপশম চিকিৎসার উদ্দেশ্য।”
চিকিৎসক শুভজিৎ রায়
রাজপুর-সোনারপুর পুরসভার (Rajpur-Sonarpur Municipality) চার নম্বর ওয়ার্ডে গড়ে উঠবে উপশম চিকিৎসা কেন্দ্র। গাছপালায় ঘেরা পরিবেশে বিলাসের বাহুল্য থাকবে না, আন্তরিকতার পরশ পাবেন রোগীরা। এমনই প্রতিশ্রুতি শুভজিতের। প্রতিষ্ঠানের পরিষেবা গ্রহণের জন্য খরচও থাকবে নিয়ন্ত্রণে। এ ব্যাপারে সরকারি হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেন তিনি। এই উদ্যোগে তরুণ চিকিৎসক পাশে পেয়েছেন গুণিজনদের। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বাংলার অগ্রণী চিকিৎসক ডা. সুকুমার মুখোপাধ্যায়। তিনি হসপিস ইন্ডিয়ার প্রধান উপদেষ্টা। শুভজিতের উদ্যোগ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, “এখন আয়ু বেড়েছে। এর ফলে বার্ধক্যে রোগ নিয়ে ভোগান্তিও বেড়েছে। তার উপশম হওয়া জরুরি। সে কারণে হসপিস ইন্ডিয়াকে সফল করে তুলতে সকলের এগিয়ে আসা উচিত।” শুভজিতের প্রতিষ্ঠানে উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন চিকিৎসক-সার্জেন ডা. ভবতোষ বিশ্বাস, ডা. বি ডি মুখোপাধ্যায়, ডা. সুব্রত গোস্বামী প্রমুখ।
রোগীর আয়ু যখন হাতে গোনা কদিন, তখন তাঁকে একটু আরাম ও আনন্দ দেওয়ার চিকিৎসা পদ্ধতি প্যালিয়াটিভ কেয়ার নামে পরিচিত। বিশ্ব জুড়ে এই পদ্ধতি ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও আমাদের দেশে কাজ খুব বেশি এগোয়নি।
কলকাতায় এখন উপশম চিকিৎসার পরিষেবা কোথায় পাওয়া যায়? শুভজিৎ জানান, সরকারি ক্ষেত্রে কলকাতার চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার ইনস্টিটিউট-এ আলাদা বিভাগ খোলা হয়েছে। এখানে বিনা খরচে পরিষেবা দেওয়া হয়। উপশম চিকিৎসা নিয়ে পঠনপাঠন হয় কলকাতার দুটি জায়গায়। ২০১৩ সাল থেকে শিয়ালদহ ইএসআই-এ পাঠ্য পেন ম্যানেজমেন্ট। তারপর এই বিষয়ে পড়াশোনা শুরু হয়েছে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে।
ক্যান্সারের রোগী মানে অঙ্কোলজি বিভাগের অধীনে কেমোথেরাপি (Chemotherapy) করা হবে, এই ভাবনার পরিবর্তন হয়েছে। তাই যখন চিকিৎসা করলে লাভ হয় না, তখন যন্ত্রণা উপশমই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপির পর শরীরে যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়, তাতেও উপশম চিকিৎসা দরকার। তবে মনের জোরই বড়ো কথা। সেটাই চিকিৎসকরা জোগান।
এই পাশে থাকার ব্রত নিয়ে এগিয়ে চলতে চাইছেন শুভজিৎ। দুই শিশু সন্তানের বাবা পৃথিবীকে দেখেন অন্য চোখে। রক্তের সম্পর্কের থেকে মানবিকতায় আস্থা রাখেন বেশি। নিজেই গল্প শোনান, কীভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত সহযাত্রীকে ট্রেন থেকে নামিয়ে পাঁজাকোলা করে ছুটে গিয়েছেন হাসপাতালে। অথচ এই শহর একটা সময় তাঁর প্রতি ছিল নির্মম। যে কলকাতা শহরের জন্য তিনি এমন মানবিক উদ্যোগ নিয়েছেন, সেখানেই শুভজিৎকে বাড়িভাড়া দেওয়া হয়নি ভিন্ন ধর্মে বিয়ে করার জন্য।
শুভজিৎ ও নাজমা রায়, ভিন ধর্মে বিয়ের জন্য কলকাতায় ঘরভাড়া পাননি চিকিৎসক শুভজিৎ
চিকিৎসকের গড়িয়ার বাড়িতে বসে সহধর্মিণী নাজমা রায় শোনালেন তাঁদের স্বপ্নের কথা। এ কাজে তিনি পুরোদস্তুর স্বামীর সহযোদ্ধা। তাঁর ভাষায়, “এই পরিবারের বাইরে আমাদের বৃহত্তর পরিবার রয়েছে। সেই পরিবারের সদস্যদের জন্য কিছু করার তাগিদে হসপিস গড়ার পরিকল্পনা।” এক সময় মহানগরে আশ্রয় না পাওয়া শুভজিৎ নিজের বাড়ির একতলায় তৈরি করেছেন অস্থায়ী বাসা। কেউ যাতে শহরে এসে আশ্রয় থেকে বঞ্চিত না হন, প্রয়োজনে মাথা গুঁজতে পারেন!