সংকটকালে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে যাচ্ছে বই, দায়িত্ব নিয়েছেন বইপাড়ার প্রকাশকরা

করোনার থাবা ভারত তথা বিশ্বের একাধিক দেশকে আক্রান্ত করেছে। পশ্চিমবঙ্গের ছবিটাও কেমন যেন অজানা। একে প্রায় তিনমাসের লকডাউন, তার মধ্যে আমফান ঘূর্ণিঝড়। প্রভাব পড়েছে কলেজস্ট্রিটেও। ঠিক কয়েকদিন আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছিল এমন কিছু ছবি, যেখানে দেখা যাচ্ছে রাস্তার জলে ভেসে যাচ্ছে অসংখ্য বই৷ অক্ষরকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ঘাম যেন নৌকা হয়ে ভেসে যাচ্ছে এক দোকান থেকে আরেক দোকান। ঝড়ের ধাক্কা সামলে নেবে বইপাড়া। কিন্তু এতদিন যে ব্যবসা বন্ধ রইল? খাতা, বই, পেন্সিল যে আর কেউ কিনছেন না! দিশেহারা পরিস্থিতি হয়েছিল প্রকাশক থেকে ছাপাখানার কর্মীদের।
কিন্তু ওই উপন্যাসের অক্ষরগুলোর মতোই বইপাড়া ঘুরে দাঁড়াতে জানে। তাই যখনই এরকম ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে কলেজস্ট্রিট, হাসি মুখে আবার নতুন উদ্যোগে কাজ শুরু করেছে। ওদিকে বঙ্কিম চাটুজ্জে স্ট্রিট থেকে রমানাথের গলি, এদিকে সূর্য সেন স্ট্রিট থেকে ফুটপাথের সারি সারি বইয়ের দোকান— একত্রিত হয়ে রাস্তা দেখিয়েছে নতুন আলো।
কিন্তু মানুষ তাঁর প্রাথমিক প্রয়োজনের বাইরে আর কী কী করতে পারবেন এই মহামারীর সময়? চারদিকে যখন একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বেসরকারি সংস্থা, প্রতিনিয়ত কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে, আগামীকাল কীভাবে চলবে জানা নেই— তখন প্রশ্ন উঠছে, মানুষ কি বই কিনবেন আগের মতো? কলেজস্ট্রিটে কি আর ভিড় জমবে চেনা সন্ধেগুলোয়? এখানেই চলে আসছে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। ছাপা বইয়ের পাশাপাশি তাহলে কতটা গুরুত্ব পাবে ডিজিটাল বা ই-বুক? বাড়িতে বই পৌঁছে দেওয়ার জন্য কী কী ভূমিকা পালন করছে প্রকাশক সংস্থাগুলি?
প্রকাশকদের পক্ষ থেকে আসছে কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ উত্তর৷ আমরা কথা বলেছিলাম বইপাড়ার বেশ কয়েকজন প্রবীণ ও নবীন প্রকাশকদের সঙ্গে। এক এক করে বরং তাঁদের বক্তব্যগুলো তুলে ধরা যাক—
‘রিড বেঙ্গলি বুকস’-এর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় ধানসিড়ি প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে। যাঁরা এখন কলেজস্ট্রিট গিয়ে বই কিনতে পারছেন না, তাঁদের বাড়িতে বই পৌঁছে দেওয়া হবে। এমনকি আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ধানসিড়ি বই পৌঁছে দিচ্ছে। ধানসিড়ির কর্ণধার শুভ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, “একটি বইয়ের সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রায় কয়েকশো কর্মী। তাই সরাসরি ই-বুক-এ পৌঁছে যাওয়া এখনই সম্ভব নয়। তাছাড়া প্রচুর গ্রামবাংলার মানুষজন আছেন, যাঁদের পক্ষে ই-বুক পড়া সম্ভবই নয়৷ অবশ্যই যেকোনোরকম পরীক্ষানিরীক্ষার প্রয়োজন। আমাদের নতুন রাস্তাও খুঁজতে হবে৷ কিন্তু পাঠক কী চাইছেন, তা মাথায় রেখেই৷ এই লকডাউন পর্ব কিছুটা মেটার পর আমাদের কলেজস্ট্রিটের দোকান থেকে বেশ লাভজনক বই বিক্রি হয়েছে। এমনকি অনলাইন অর্ডারও হয়েছে। পাঠকদের বাড়িতে বই পৌঁছে গেছে সঠিক সময়েই।”
বিখ্যাত প্রকাশনী সংস্থা গাংচিল-এর কর্ণধার অধীর বিশ্বাস পুরো বিষয়টি ভাবতে চাইছেন অন্যরকমভাবে। সমাজজীবনে একসময় যাঁর পরিচয় ছিল ‘অচ্ছুৎ’। তেমন লেখাপড়া হয়নি। কলকাতার পথেঘাটে লজেন্স বিক্রি থেকে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ, এমনকি প্রকাশকদের প্রুফ দেখা— সবকিছুই করেছেন। একসময় ‘পদ্মা-গঙ্গা’ নামের একটি লিটল ম্যাগাজিন ফেরি করতেন কলকাতার রাস্তায়। তাই তাঁর কাছে বই ফেরি করার ইতিহাস বহু পুরোনো৷ এখনও বইপাড়াতে এই অধীর বিশ্বাস নিজের কাঁধে বই তুলে এ দোকান, সে দোকান দিয়ে বেড়ান। কে বলবে, তিনি একজন নামজাদা প্রকাশনীর কর্ণধার৷ অধীরবাবু জানান, “অনেক মানুষ খেতে পারছেন না— এই ছবিটা যেমন সত্যি। পাশাপাশি এটাও সত্যি তাঁদের সামান্য প্রয়োজনটুকু কিন্তু দরকার। এই সামান্য প্রয়োজনের মধ্যে যেমন ভাত-ডাল পড়ে, তেমনই বই-ও পড়ে। অনেক পাঠক আছেন, যাঁদের বই ছাড়া চলবেই না। ওটিই তাঁদের চাহিদা। সেখানে আমাদের তো এগিয়ে যেতেই হবে। দরকার হলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই পৌঁছে দিতে হবে। অনলাইন সংস্থাগুলি খুবই ভালো কাজ করছে। প্রায় সমস্ত জায়গাতেই আমাদের বই এখন পাওয়া যাচ্ছে। গাংচিলে এখনও প্রচুর ফোন আসছে বই করার জন্য৷ তাঁরা কিন্তু ই-বুক করতে চান না, ছাপা বইয়ের আকারই তাঁরা চাইছেন। আসলে এই মাধ্যমে আসতে আরও অনেক অনেক বছর সময় লাগবে। নতুন পথ তখন আপনাআপনিই বেরিয়ে যাবে।”
অন্যদিকে তবুও প্রয়াস প্রকাশনীর তরুণ প্রকাশক সেলিম মণ্ডল বলছেন, "আমি নদীয়া জেলায় থাকি। কলকাতা যেতে পারছি না বলে বইঘরকে বিপণনের দায়িত্ব দিয়েছি। তাঁরা বাড়িতে বই পৌঁছে দিচ্ছেন। তাছাড়া অনেকেই ই-বুক নিয়ে ভাবছেন। সবাই হয়তো নন। তবে 'তবুও প্রয়াস' আগামীতে বই দুই মাধ্যমেই প্রকাশ করবে। মুশকিল হল অধিকাংশ মানুষ ই-বুক বলতে পিডিএফ ভাবে। সদ্য ৬ জন তরুণ কবির একফর্মার ই-সিরিজ প্রকাশ করে এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমরা যাঁরা বইনির্মাণের সঙ্গে যুক্ত, পাঠককে আগে ই-বুক সম্পর্কে ধারণা না দিলে বাংলায় ই-মাধ্যমে বইপ্রকাশ করা দুষ্কর।"
আশাবাদের কথা শোনালেন সপ্তর্ষি প্রকাশনীর কর্ণধার সৌরভ মুখোপাধ্যায়ও। তিনি বলছেন, "২০ এপ্রিলের পর থেকে আমরা সব কিছুই শুরু করেছিলাম। গাড়ির মাধ্যমে হোম ডেলিভারিও করেছি। এই অর্ডার যে শুধুমাত্র অনলাইন থেকে হচ্ছিল এমন নয়, আমাদের দপ্তরে প্রচুর অর্ডার আসছিল। রাজ্যের বাইরেও আমরা বই সাপ্লাই করেছি। এবং এই পুরো কাজটাই করেছি কোনোরকম ডেলিভারি চার্জ ছাড়া৷ আমাদের মনে হয়েছে প্রকাশকদের পাশে যখন এত বিপুল সংখ্যক পাঠক দাঁড়াচ্ছেন, তখন আমাদেরও তাঁদের জন্য কিছু করা উচিত।" সপ্তর্ষি প্রকাশনীর বই ছাপা এবং ই-বুক এই দুই মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। যার ফলে প্রচুর বিদেশি পাঠক আগ্রহ দেখাচ্ছেন বাংলা বই সংগ্রহ করতে।
আসলে প্রত্যেকের কথাই সঠিক। কারণ যে মুহূর্তে মানসিক অস্থিরতা, অবসাদ, বাইরে বেরোতে না পারা, প্রিয় মুখ দেখতে না পাওয়া সামগ্রিকভাবে জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করছে; সেই মুহূর্তে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে বই। বন্ধুর মতো পাশে দাঁড়াচ্ছে সে। অথবা যে বইয়ে ধুলো পড়েছিল এতদিন, এখন ফুরসৎ পাওয়া গেছে ধুলো ঝেড়ে আবার পড়ে ফেলাগুলো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। বই কোন মাধ্যমে পাঠকের কাছে পৌঁছাবে, সেই সমস্ত প্রশ্ন আজকের নয়, বহুকাল ধরে এই প্রশ্ন-উত্তর খেলা চলতে থাকবে। তাছাড়া একটি শিশুর যখন প্রথম অক্ষর পরিচয় হয়, তখন কিন্তু সে ছাপা বইটিই হাতে তুলে নেয়। পরবর্তীতে সিলেবাসের যাবতীয় বইও কিন্তু প্রিন্টেড। আর ই-বুককেও আমরা গ্রহণ করব। কারণ যুগের চাহিদা পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে মাধ্যমগুলো পাল্টে পাল্টে যায়, কিন্তু অবশ্যই পুরোনো বা ঐতিহ্যকে অস্বীকার না করেই তা গ্রহণ করব। এই সংকটকালে যারা পাঠকের বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেবার দায়িত্ব নিয়েছেন, তা ই-কমার্স সাইট হোক বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে, তাঁদের প্রত্যেককে স্যালুট। বাংলা বই পৌঁছে যাক পাঠকের ঘরে ঘরে। মহামারী আসবে যাবে, কিন্তু বই পরম দোসর হয়ে থেকে যাবে আজীবন।
ছবি সৌজন্যে : ধানসিড়ি