No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ভুলে যাওয়া নদী বিদ্যাধরী  

    ভুলে যাওয়া নদী বিদ্যাধরী  

    Story image

    এক যে ছিল বাংলাদেশ। না না, এপার-ওপারের বাঁধাবাঁধির বাংলাদেশ না। সেসময়ের গল্পই ছিল জুড়ে জুড়ে থাকার। সে বাংলাদেশে কত না নদনদী। জলো হাওয়া এদেশের বুকে চিরকাল বহমান। নদীর উত্তাল ঢেউয়ের বাঁকে   কত ঘটনা। কত রাজ্য রাজধানী। কত লোকের বাস। নদীরা ফুরোল যেমনি, গল্পের নটেগাছের মুড়োনো সেদিন থেকেই। তেমনি এক নদীর নাম বিদ্যাধরী। চিরতরে সে হারায়নি যদিও। তবু রোজই সে ফুরোয়, একটু একটু করে ফুরিয়ে যাওয়ার পদ্য লেখে।

    আচ্ছা, নদীর নাম কেমন করে হয়? কে করে এইসব নামকরণ?  জানা নেই। পথঘাটের নামের হদিস মিললেও নদীর নামের উৎস মেলে কি? কেই-বা তার নাম রেখেছিল বিদ্যাধরী!  কী আশ্চর্য নামখানা। খ্রিস্টীয়  ষষ্ঠ শতক  অবধি এই নদী ছিল ভাগীরথীর একটি শাখা। বিদ্যাধরীর তীরেই ছিল চন্দ্রকেতুগড়। তিনশো খ্রিস্টাব্দের বাংলায় এই চন্দ্রকেতুগড় বন্দরের সুনাম ছড়িয়েছিল দিগ্বিদিক।  টলেমি নাকি এই বন্দরকেই বলেছিলেন, ‘গঙ্গা বন্দর’। আবার সিংহলি পুরাণ ‘বঙ্গনগর’ বলেছিল তাকেই।   চন্দ্রকেতুগড়ের এই যে রমরমা বাজার – তার মূলে ছিল বিদ্যাধরী নদী। কিন্তু ভাগীরথীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হলে, ক্রমশ মজে যেতে থাকে নদীখাত। চন্দ্রকেতুগড়েরও আয়ু ফুরোতে থাকে।

    ষোড়শ শতকের শেষে ভাগীরথীর স্রোত কমতে থাকে। বিদ্যাধরীতে পলি জমে। গঙ্গার মূল স্রোত ততদিনে ডানা মেলেছে পদ্মার দিকে। ভাগীরথী তখন কল্যাণী, হরিণঘাটার কাছে সরে আসে। আর ফেলে আসে কতগুলি অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ। সেই হ্রদ আজ বিলে পরিণত৷ তেমনি একটি বিল আজকের বিদ্যাধরীর উৎস। 

    বিদ্যাধরী নদীর অবস্থান 

    অবশ্য বিদ্যাধরীর গতিপথ নিয়ে সন্দেহ আছে ভালোই। কারো কারো মতে   হরিণঘাটার কাছে উৎপন্ন হয়ে, হাবড়া, দেগঙ্গা, হাড়োয়া ঘুরে সে পড়েছে মাতলা নদীতে। চব্বিশ পরগণার গুমা পর্যন্ত তার নাম নোনাগাঙ। তবে এই নদীর শাখাপ্রশাখা কম নয়। তেহট্টের কাছে দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায় সে। পশ্চিমদিকে প্রবাহিত শাখাটির সঙ্গে অনেকগুলি লবণহ্রদ জুড়েছিল এককালে।  ১৮৫২ সালের জুলাই মাসে প্রবল বন্যায় বিদ্যাধরীর জল বেয়ে কতগুলি শুশুক নাকি চলে এসেছিল এইসব লবণহ্রদে। বোট্যানিক্যাল গার্ডেনের সুপারিন্টেন্ডেন্ট এডওয়ার্থ ব্লিথ সাহেব সেই শুশুকদের দেখে ভেবেছিলেন, এ তাঁরই আবিষ্কার করা নতুন কোনো প্রাণী। নামকরণও করেছিলেন, ‘গ্লোবিসেফেলাস ইন্ডিকাস’। পরে অবশ্য ভুল শুধরোন তিনি। গাঙ্গেয় শুশুক হিসেবেই তারা থেকে যায়। তবে বিদ্যাধরী নদীর এই পশ্চিম শাখাটির কোনো চিহ্ন আজ আর নেই। তার রেখে-যাওয়া লবণহ্রদেরা ভরাট হয়ে পরিণত হয়েছে সল্টলেক উপনগরীতে।  প্রকৃতিকে এভাবেই আমরা অদলবদল করে চলেছি আরকি।

    বিদ্যাধরীর পশ্চিম শাখা থেকে বেরিয়ে পিয়ালি নদী মিশেছিল মাতলার সঙ্গে। কিন্তু বিদ্যাধরীর মজে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পিয়ালির উত্তরাংশে জল প্রায় নেই। 

    বিদ্যাধরীর এই মজে যাওয়া অবশ্য সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক কারণে নয়। ভাগীরথী থেকে বিচ্ছিন্ন সে হয়ে পড়েছিল ঠিকই। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ থেকে অনেকগুলি খাল তৈরি করা হয়েছিল কৃত্রিমভাবে। নৌ-চলাচলের সুবিধের কথা ভেবে। ১৮৩০ সাল পর্যন্তও নাকি এই বিদ্যাধরী নদী   গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের এক অন্যতম প্রবাহ ছিল। কলকাতা পর্যন্ত তা বিস্তৃত ছিল বটেই। কিন্তু কৃত্রিম খালের বাড়াবাড়ির ফলে নদী খুব দ্রুত চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়ে। 

    বর্তমানে কলকাতার সমস্ত নিকাশি ব্যবস্থা নির্ভর করে আছে বিদ্যাধরীর ওপর। কিন্তু নদী প্রায় মজে যাওয়ায়,  সুপরিকল্পিত  সংস্কার না-হওয়ায়   আজ তাতেও দুর্ভোগের কোনো শেষ নেই। 
    নদী অনেকসময়ই নিজের মতো দিক বদলায়। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনের যুগে ইচ্ছেমতো জলপথ নির্মাণ হতে থাকে, ফলাফলে বহু নদীই হারাতে থাকে তাদের মূল স্রোতখাত। কিন্তু আজ এতবছর পরেও, আমরাই বা কোথায় যত্ন নিলাম আমাদের নদনদীদের। ফলে হারিয়ে যাওয়াই নদীর ভবিতব্য, হয়তো আমাদেরও। 

    তথ্যঋণ – বাংলার হারানো নদীর ইতিকথা, প্রীতিতোষ রায়

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @