একসময় শিলিগুড়ি থেকে পাহাড়ে যেতে হলে খচ্চরের পিঠে চেপে যেতে হত

রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর শিলিগুড়ি। উত্তরপূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার হিসাবে পরিচিত এই শহর বা এই মহকুমার যাত্রা সরকারিভাবে শুরু হয়েছিল ১৯০৭ সালের ২৫ মে। ১৯০৭ সালের ২৫ মে ব্রিটিশরা কার্শিয়াং থেকে শিলিগুড়িকে আলাদা মহকুমা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯০৩ সালে তৈরি হয়েছিল শিলিগুড়ি থানা। তার অনেক আগে থেকেই শিলিগুড়ি ঘিরে কাজকর্ম শুরু হয়েছিল ব্রিটিশদের। কারণ, দার্জিলিং পাহাড়ে বিনোদন বা অন্য কাজে যেতে হলে পাহাড়ের কোলে শিলিগুড়িকে তৈরি করার প্রয়োজন ছিল। ১৮৬৪ সালে শিলিগুড়ি তরাই এলাকার সদর দফতর ছিল বর্তমান ফাসিদেওয়া থানার হাঁসখোয়াতে। ১৮৭৮ সালে শিলিগুড়িতে তৈরি হয় রেল স্টেশন, তখন এই শহরের জনসংখ্যা ছিল ৪০০ জন। ১৮৬৪ থেকে ১৮৮০ সাল পর্যন্ত তরাই মহকুমার সদর অফিস ফাসিদেওয়ার হাঁস খোয়াতে হলেও ১৮৮১ সালে তা শিলিগুড়ি শহরে আনা হয়।
রেল স্টেশন তৈরি হওয়ার আগে শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং পাহাড়ে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা ছিল গ্যাঞ্জেস রোড। রাস্তাটি ১২৬ মাইল দীর্ঘ ছিল। এই রাস্তা আজ শিলিগুড়ি শহরে ‘বর্ধমান রোড’ নামে পরিচিত। অবিভক্ত বাংলার তেঁতুলিয়া, কিষানগঞ্জ, ডেরাংঘাট, পুরনিয়া, সাহেবগঞ্জ হয়ে গঙ্গার কারাগলা ঘাট পর্যন্ত ছিল। দার্জিলিং আসার জন্য বর্ধমানের মহারাজা এই রাস্তা তৈরি করেছিলেন। তবে শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন তৈরি হওয়ার পর তৈরি হয় হিলকার্ট রোড। শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন থেকে মহানন্দা নদী পর্যন্ত হিলকার্ট রোড তৈরি হয়ে তা গ্যাঞ্জেস রোড বা বর্ধমান রোডের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। পরে সেই বর্ধমান রোডের সংযুক্ত হওয়ার স্থান থেকে গ্যাঞ্জেস রোডকে সকলে হিলকার্ট রোড বলতে থাকেন যেটা দার্জিলিং পর্যন্ত চলে যায়। আর ট্রেন চলাচল শুরু হওয়া এবং পরবর্তীতে দেশ ভাগ হলে বর্ধমান রোড বা গ্যাঞ্জেস রোড তার আগের গুরুত্ব হারায়।
পুরোনো সেই শিলিগুড়িতে সেই সময় ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, পেটের রোগ, বাত লেগেই থাকত। উন্নত চিকিৎসার জন্য তখনকার শিলিগুড়ির মানুষদের জলপাইগুড়িতে যেতে হত। শিলিগুড়ির মানুষদের সেই সময় ভালো কোনো শৌখিন জিনিস কিনতে হলেও জলপাইগুড়িতে যেতে হত। শিলিগুড়ি থেকে আশপাশের চা বাগানে যাওয়ার প্রধান বাহন বলতে ছিল গরু বা মোষের গাড়ি। টয় ট্রেন চালু হওয়ার আগে শিলিগুড়ি থেকে পাহাড়ে যেতে হলে খচ্চরের পিঠে চেপে যেতে হত।
পুরোনো শিলিগুড়ি শহর
শিলিগুড়ির পুরোনো দিনের বাসিন্দা তথা লেখক গৌরিশঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, মিলনপল্লি এলাকায় সেই সময় জলপাইগুড়ির রাজার কাছারি ছিল। শিলিগুড়িতে সেই সময় রাস্তাঘাট বলতে বর্ধমান রোড, এস এফ রোড, হিল কার্ট রোড ছিল। রাস্তাঘাট সব ছিল কাঁচা, পাথুরে। এখানকার সাধারণ মানুষ খালি পায়ে চলাফেরা করতো। কিছু কিছু বাবু জুতো পড়লেও মহিলাদের মধ্যে জুতো পড়ার প্রচলন ছিল না।
পুরানো শিলিগুড়ি বলতে স্বাধীনতার আগে হিলকার্ট রোড, তার দুই পাশে কিছু বাড়ি ঘর, মহাবীরস্থান, বাবুপাড়া, মিলনপল্লী, ডি আই ফান্ড মার্কেট, তিলক ময়দান প্রভৃতি। যানবাহন বলতে তখন কাঠ ও পাঠ বহনকারী গরুর গাড়ি ছিল। রাস্তাঘাটে ধুলো। প্রয়াত প্রবীণ সাংবাদিক নিপেন বসু লিখে গিয়েছেন, রাস্তার দুই পাশের মাটি কেটে উঁচু করে হিল কার্ট রোড তৈরি হয়েছিল। রাস্তার পূর্ব অংশে ছিল দার্জিলিং হিমালয়ান রেলের ন্যারো গেজ রেল লাইন। শিলিগুড়ি রোড স্টেশন থেকে উত্তরপূর্ব কোণ বরাবর চলে গিয়েছিল গেলিখোলা পর্যন্ত, মানে পাহাড়ি কালিম্পং-এর দিকে। সেই রোড স্টেশনের অস্তিত্ব আজ আর নেই। শিলিগুড়ি হিল কার্ট রোড বা বিধান রোড দিয়ে আজ আর দেখা যায় না রেল লাইন। রোড স্টেশনের নাম এখন হয়েছে হাসমিচক। ভ্রমণ গবেষক রাজ বসুর কথায়, মহানন্দা সেতুতে আগে বাঁশের সাঁকো ছিল। পরে লোহার ফ্রেমের সঙ্গে কাঠের পাটাতন জুড়ে মহানন্দা ওপর দিয়ে যাতায়াতের ব্যবস্থা হয়। আর ন্যারোগেজের রেল লাইন পাতা হয়। মহানন্দার এক পাশে রেলের ওয়ার্কশপ ছিল।
১৮৬০ থেকে ১৮৬৯ সালের মধ্যে নির্মিত হয় হিল কার্ট রোড যেটি কার্শিয়াং থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত ছিল। ১৮৭৮ সালে মহানন্দার ওপর কাঠের সেতু তৈরি হয়। ১৮৯১ সালে ব্রিটিশের গননা অনুযায়ী শিলিগুড়ির বিরাট এলাকার লোক সংখ্যা ছিল ৭২ হাজার ৯৭ জন। আর যখন ব্রিটিশরা শিলিগুড়িকে মহকুমা হিসাবে স্বীকৃত দেয় তখন মানে ১৯০৭ সালের ২৫ মে এখানকার জন সংখ্যা ছিল এক হাজার। আর আজ ২০১১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী এর লোক সংখ্যা ৫ লক্ষ ১৩ হাজার ২৬৪ জন। ১৯০৯ সালে শিলিগুড়ি শহরে সংস্কৃতি চর্চার জন্য তৈরি হয়েছিল মিত্র সম্মিলনী। ১৯৫০ সালে তৈরি হয় শিলিগুড়ি পুরসভা। চিন ভারত যুদ্ধ, বাংলাদেশ ভাগ, অসমে গোলমাল এই শহরের জনবসতি বা গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দেয়। এখান থেকে সহজেই প্রতিবেশী রাজ্য সিকিমে যেমন যাওয়া যায় তেমন পাশেই বিহার ও অসম। আবার শিলিগুড়ির গায়েই নেপাল, পাশে ভুটান, বাংলাদেশ। এর পাশেই পাহাড় ঘেঁসে রয়েছে চিন সীমান্ত।
১৯২৫ সালে এই শহরে প্রথম বাস চলেছিল। ১৯২৬ সালে শিলিগুড়ি কলকাতা প্রথম ব্রড গেজ রেল লাইন শুরু হয়। নব্বইয়ের দশকে এটা হয় পুর নিগম। যদিও মহকুমা এখনও রয়ে গেছে। গোটা রাজ্যের সর্বত্র জেলা পরিষদ থাকলেও এখানে মহকুমা পরিষদ রয়ে গেছে পাহাড়ের প্রশাসনিক কারণেই। রাজ্যের সর্বত্র পঞ্চায়েত ভোট একসঙ্গে হলেও এখানে তা হয় না। এখানকার পঞ্চায়েত ভোট হয় আলাদা ভাবে।
বাংলার বহু মনীষী হিল কার্ট রোড ধরে টয় ট্রেনে করে পাহাড়ে গিয়েছেন। হিল কার্ট রোডের পুরানো বাড়িগুলোকে চিহ্নিত করে সেই সব বাড়ির কর মকুব করার দাবি তুলেছেন ভ্রমণ গবেষক রাজ বসু। আরও বলছেন, শিলিগুড়ি হিল কার্ট রোডে আজ একটি মিউজিয়াম হওয়া দরকার। বহু কিছু হারিয়ে গিয়েছে এই শহর থেকে। রেলকে ঘিরে একটি হেরিটেজ পর্যটন গড়ে উঠতে পারে শিলিগুড়িতে।