No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    কলিকাতা কালিকাক্ষেত্রের আজব গপ্প-ইতিহাস

    কলিকাতা কালিকাক্ষেত্রের আজব গপ্প-ইতিহাস

    Story image

    “এই কলিকাতা কালিকাক্ষেত্র, কাহিনী ইহার সবার শ্রুত”

    সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার এই কথাগুলো কিন্তু ফেলনা নয়। কলকাতার সঙ্গে কালীর সম্পর্ক এমনকি দুর্গাঠাকুরের চেয়েও বেশি পুরোনো। কলকাতা শহর গড়ে ওঠার আগেই দূর-দূরান্ত থেকে মানুষরা এসে ভিড় করে পুজো দিতেন কালীঘাটের মন্দিরে। কেউ কেউ তো ‘কলিকাতা’ নামের পিছনেও ‘কালী’ শব্দটির খোঁজ পেয়েছেন। সে হয়তো কষ্ট-কল্পনা, কিন্তু তা বলে কালীপুজোর সঙ্গে এই শহরের সম্পর্ক খুঁজতে কল্পনাবিলাসী হওয়ার প্রয়োজন নেই। এমনিতেই শহরজোড়া একাধিক বিখ্যাত কালীমন্দির। কালীঘাটের মন্দির ছাড়াও চিৎপুরের ডাকাতে কালী, ঠনঠনিয়ার সিদ্ধেশ্বরী কালী, ফিরিঙ্গি কালী বা দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী। এইসব বিখ্যাত কালীমন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে কত রোমাঞ্চকর ইতিহাস। নেহাত ভক্তিরসের সামগ্রী নয় সেইসব গল্প। আর, কলকাতার কালীপুজো বলতে এই বিখ্যাত মন্দিরের বাইরেও হাজারো ইতিহাস। রাজ-রাজরা, ডাকাত, জমিদার, লালমুখো সাহেব, বড়োলোক সবাই সমাপতিত সেখানে। 

    কলকাতার সবচাইতে বিখ্যাত কালীমন্দির কালীঘাটের পুজো নিয়েই গল্পের শেষ নেই। অনেকের মতে, এই কালীই কলকাতার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। হিন্দু রাজা-রাজরা-জমিদার তো বটেই এই মন্দিরের ‘জাগ্রত’ দেবীর কাছে পুজো দিতে আসতেন সাহেবরাও। পাদরি ওয়ার্ড লিখে গেছেন, পালকি করে মন্দিরে এসে সাহেব-মেমদের হাজার-হাজার টাকার পুজো দিয়ে যাওয়ার কথা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক লালমুখো সাহেব-কর্তা নাকি মামলা জেতার আগে মানত করে গেছিলেন মন্দিরে। মামলা জেতার পর পুজো দিয়েছিলেন হাজার তিনেক টাকার। সেইযুগে টাকাটার পরিমাণ নেহাত কম নয়।

    পাঞ্জাব আর বার্মা দখল করল ব্রিটিশরা। তারপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফে কালীঘাটে ঘটা করে পুজো দেওয়া হল ষোড়শোপচারে। শুধু ইংরেজরাই নয়, ওয়ার্ড লিখেছেন প্রতি মাসে প্রায় পাঁচশো জন মুসলমানও নাকি পুজো দিয়ে যেতেন এই মন্দিরে। 

    আর, এই মন্দিরে রাজাদের দানধ্যান-ব্যয়ের কথা বললে তো শেষই হবে না। রাজা নবকৃষ্ণ ১৭৬৫ সালে সোনার মুণ্ডমালা দান করলেন কালীপ্রতিমাকে। সঙ্গে লক্ষাধিক টাকা। শোভাবাজারের রাজা গোপীমোহন দেব এমনই ধূমধাম করে পুজো দিতে এলেন যে তা দেখতে ভিড় হামলে পড়ল। ভিড় সামলাতে গিয়ে পুলিশ লাঠি চালিয়েও কুল পায় না শেষে।  খিদিরপুরের গোকুলচন্দ্র ঘোষাল গড়ে দিয়েছিলেন দেবীর চারটি রুপোর হাত। সেই হাতকেই পরে সোনায় বদলে দেন কালীচরণ মল্লিক। সোনার জিভটি পাইকপারার রাজা ইন্দ্রচন্দ্র সিংহর উপহার। পাতিয়ালার মহারাজ দান করেছিলেন দেবীর গলার মুণ্ডমালা আর দেবীমূর্তির ওপরের ছাতাটি দান করেছিলেন নেপালের প্রধান সেনাপতি জঙ বাহাদুর।

    দেবীর অঙ্গসজ্জার পাশাপাশি এই মন্দিরের গড়ে ওঠার, সেজে ওঠারও বিচিত্র ইতিহাস। পাঞ্জাবি সৈনিক হুজুরিমল্লের শেষ ইচ্ছেনুযায়ী মন্দিরের সামনের আদি গঙ্গার ঘাটটা বাঁধিয়ে দিয়েছিল কোম্পানি সরকার। বর্তমান মন্দিরটির নির্মাণ হয়েছিল বড়িশার জমিদার সন্তোষ রায়চৌধুরীদের উদ্যোগে। আন্দুলের জমিদার রাজা কাশীনাথ রায় ১৮৩৫ সালে গড়ে দিয়েছিলেন নাটমন্দির। তথ্য গুনে শেষ করা যাবে না।  

    শুধু কালীঘাট নয়, কলকাতার অন্যান্য সাবেক কালীমন্দিরগুলোর ইতিহাসও কম রঙিন নয়। ‘ব্ল্যাক প্যাগোডা’ নামে প্রচলিত ছিল দেওয়ান গোবিন্দরাম মিত্র প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির। উচ্চতায় নাকি মনুমেন্টের থেকেও উঁচু ছিল এই মন্দির। ভূমিকম্পে, ঝড়ে একাধিকবার ভেঙেছে, নির্মিতও হয়েছে নতুন করে। আর, ‘সমাচার দর্পণ’ ১৮৫৫ সালের ৩১ মে-তে লিখেছিল, দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে কালীমূর্তির প্রতিষ্ঠার দিন “কলিকাতার বাজার দূরে থাকুক্‌, পাণিহাটি, বৈদ্যবাটি, ত্রিবেণী ইত্যাদি স্থানের বাজারেও সন্দেশাদি মিষ্টান্নের বাজার আগুন হইয়া উঠে। এইমত জনরব যে পাঁচশত মণ সন্দেশ লাগে।” 

    কলকাতায় নানা বড়োলোক-অভিজাত মানুষদের বাড়ির কালীপুজোয় জাঁক-জমকের পাশাপাশি অবধারিত ছিল পশুবলি। খিদিরপুরের ন্যায়নারায়ণ ঘোষালের পুজোয় বা শোভাবাজারের কালীশঙ্কর ঘোষের বাড়ির কালীপূজার টাকার পাশাপাশি মদ্য ও রক্তেরও বন্যা বইত। ওয়ার্ডের লেখায় কালীশঙ্কর ঘোষের বাড়ির পুজোর যে বিবরণ আছে, তা ভয়াবহ। নর্দমা লাল হয়ে যেত পশুবলির রক্তে। মায়ের পুজোর ভোগ হিসেবে থাকত মদ। সেই মদ পুজোর শেষে পান করতেন বাবু স্বয়ং। শুধু পশুবলিই নয়, নরবলির ঘটনাও শোনা যেত তখন কলকাতায়। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতা তখন জঙ্গলাকীর্ণ এক শহর। এখানে-সেখানে ডাকাতদের ডেরা। চিতু ডাকাত-প্রতিষ্ঠিত চিত্তেশ্বরী কালী মন্দিরে ১৭৭৮ সালের এক অমাবস্যায় নাকি নরবলি হয়েছিল। কালীঘাটেও নাকি নরবলি দেওয়া হয়েছিল একবার। ডঃ ডাফ লিখেছেন, এই নরবলির ঘটনায় কোম্পানির শাসকরা ফাঁসিতেও ঝুলিয়েছিলেন কয়েকজনকে। 

    সেদিনের কলকাতা শহর আজকের তিলোত্তমা মহানগরী নয়। তার কালীপুজোর ধরণেও তাই ভক্তিরসের সঙ্গে অনায়াসে মিশে যায় বীভৎসরস। পশুবলিকে ঘিরে রাজা-বাবুদের উদ্দামতার বিবরণ শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। এবং, এরই পাশাপাশি মিশে থাকে বাবু-জমিদারদের আড়ম্বরের কথাও। কালীপুজোর রাতে কারণবারি তো ‘প্রসাদ’। তার নেশা সাত্ত্বিক নেশা। সেই ‘কারণবারি’ হোক না বিলিতি। ক্ষতি কী? মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, শিমলার বসুবাড়ির বিখ্যাত কালীপুজোয় ততোধিক বিখ্যাত মদ্যপানের কথা। গৃহস্থ-ভক্ত সবাই মিলে মাটির গামলায় কারণবারি নিয়ে ঘোল হয়ে ঘিরে বসতেন। তারপর স্ট্র থুড়ি নল দিয়ে টানতেন সুরা। আবার শোভাবাজারের কালীশঙ্কর ঘোষের বাড়িতে তো ভৃত্য-গৃহিণী কেউই সুরারসে বঞ্চিত হতেন না। একবার নাকি নেশার ঘোরে পুরুতকেই বলি দেবার উপক্রম হয়েছিল। 

    এই নিয়ে প্রাণকৃষ্ণের মজার গপ্প আছে একখানা। কারণবারি প্রসাদে চুর এক ভৃত্য পদসেবা করতে গিয়ে কিছুতেই আর বাবুর পা খুঁজে পাচ্ছে না। গোটা বাড়ি জুড়ে পায়ের খোঁজে হইহই পড়ে গেল। বাবুর পা কোথায় গেল? পুজোমণ্ডপেও পা নেই। এদিকে পায়ের অভাবে বাবু নামতে-হাঁটতে পারছেন না। শেষে গিন্নিমা আদেশ দিলেন পুরুতমশাইয়ের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ করার। নৈবেদ্যর সঙ্গে পা-টাও ভুলক্রমে চলে গেছে হয়তো। পুরুতমশাই সব শুনে খুবই বিনয়ের সঙ্গে বললেন, এত নৈবেদ্যর মধ্যে বাবুর পা খুঁজতে রাত কাবার হয়ে যাবে। খুঁজে পেলে কাল সকালে তিনি স্বয়ং বাবুকে পা ফিরিয়ে দিয়ে আসবেন।

    শুধু মদ্যপানে কি আর জমে পুজো? তাই, পুজোর পরে পার্টি হত। সেই পার্টিতে সাহেব-মেমরা আসতেন। বাইজি নাচ, কবিগান, পাঁচালি, তরজা, আখড়াই-হাফ আখড়াইতে মেতে থাকত আসর। পরে যুক্ত হল যাত্রাগান আর জেলেপাড়ার সঙ। তাছাড়া ছিল আতসবাজির পসরা। কালীপ্রতিমা নিয়ে বাজনা-আলো সহকারে শোভাযাত্রাতেও বেরোতেন বাবুরা। সেই শোভাযাত্রার জাঁক নিয়ে পরস্পরের মধ্যে রেষারিষিও ছিল তীব্র। সব মিলিয়ে কালীপুজো ব্যাপারটা মোটে সাধারণ এক উৎসব ছিল না কলকাতাবাসীর কাছে।

    সময় গড়িয়ে গেল ঢের। গঙ্গার মূল স্রোত সরে এসে আদিগঙ্গাও শুকিয়ে পরিণত হল খালে। সেইসব বাবুয়ানি-রাজ-রাজরাদের কালও শেষ হল। মহানগরীর সেইসব কালীপুজোও মুখ লুকোল ইতিহাসে। বিখ্যাত কালীমন্দিরগুলোর পুজোর কথা অবশ্য আলাদা। প্রথা মেনে তারা আজও বহমান। কিছু সাবেক পুজোও বেঁচে-বর্তে আছে কোথাও কোথাও। কিন্তু, ফাঁকা জমি-জঙ্গলাকীর্ণ আধো আলো-আধো অন্ধকারের সেই গা ছমছমে কলকাতার গায়ে কাঁটা দেওয়া কালীপুজোরা আর নেই। ডাকাতরা নেই, বলির বীভৎসতাও নেই। কিন্তু, ইতিহাসের গপ্পেরা এত সহজে মরে না। আতসবাজির মতো আকাশজুড়ে তাদের ছড়িয়ে পড়তে দেখাও কম লোভনীয় নয়।

    অঙ্কন- পার্থ দাশগুপ্ত 

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @