পুরুলিয়ার কাশীপুর রাজবাড়ি : চিন থেকে রাজমিস্ত্রি এনে ১২ বছর ধরে তৈরি করা স্থাপত্য

লালমাটি ও সবুজ অরণ্যে ঘেরা পুরুলিয়া জেলা। পশ্চিমবঙ্গের পর্যটনের নিরিখে জেলা পুরুলিয়া অন্যতম। পুরুলিয়া বলতেই চোখের সামনেভেসে ওঠে অযোধ্যা পাহাড়, শিমুল পলাশে ঘেরা ছোট ছোট টিলা আরআদিবাসীদের গ্রাম। বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই জেলা। তার মধ্যে অন্যতম কাশীপুর রাজবাড়ি। বহু ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পঞ্চকোট রাজত্বের কাশীপুর রাজবাড়ি। দক্ষিণবঙ্গের বিস্তৃত অঞ্চল একসময় এই পঞ্চকোট রাজত্বের অন্তর্গত ছিল। একাধিক জনপদ গড়ে উঠেছিল পঞ্চকোট রাজার দানের জমি থেকে।
আর কিছু বছরেই সেই রাজধানী প্রতিষ্ঠার দুই শতবর্ষ পূর্ণ হবে। ১৮৩৩-এ মানভূম জেলা তৈরি হয়। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহে রাজা নীলমণি অংশ নেওয়ায় তাঁকে প্রথমে শান্তিপুরে পরে কলকাতায় বন্দী করে রাখা হয়।
পুরুলিয়া-বরাকর পাকা রাস্তার গোবাগ মোড়ের কাছে গড় পঞ্চকোট গ্রাম। এই গ্রামের মধ্য দিয়ে সোজা উত্তরে প্রায় দেড় কিলোমিটার কাঁচা রাস্তাপেরিয়ে মন্দিরক্ষেত্র। তারও উত্তরে পাহাড়ের ৫০০ ফুট উপরে দুর্গ-মন্দির-ধারা (জলধারা)। দক্ষিণপূর্ব রেলওয়ের রামকালানি স্টেশনে নেমেও রাজধানীতে পৌঁছানো যেত।
গড়পঞ্চকোট গ্রামে ঢোকার মুখেই ঐতিহাসিক দুয়ারবাঁধ তোরণ। পাথরের তৈরি বর্তমানে জীর্ণ তোরণটির কারুকার্য, গঠনরীতি মুসলিম স্থাপত্যের কথা মনে করায়। J. D. BEGLAR 1872 খ্রিষ্টাব্দে পঞ্চকোট ভ্রমণের সময় এমনি চারটি তোরণ দেখেছিলেন। তাদের নামগুলিও তিনি উল্লেখ করেছেন—আঁখ দুয়ার, বাজার মহলদুয়ার বা দেশবাঁধ দুয়ার, খড়িবাড়ি দুয়ার, দুয়ার বাঁধ। এদের মধ্যেদুয়ারবাঁধ তোরণ বাদ দিয়ে সবগুলিই BEGLAR-এর সময়েই জীর্ণদশাপ্রাপ্ত হয়েছিল। তোরণ চারটি দুর্গে ঢোকা ও বেরনোর পথ হিসেবে ব্যবহৃত হত। রাজধানীটি সম্পর্কে BEGLAR-এর উদ্ধৃতি:
The Fort is very large. The outermost ramparts having a total length of more than five miles. While the traditional outermost defence viz.ridge lines round the fort enclose a space of about 12 square miles, exclusive the hill itself.
“দুর্গটি ছিল বিশাল, দুর্গ প্রাচীরের দৈর্ঘ্য পাঁচ মাইলের বেশি, দুর্গটি প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত, দুর্গ ঘিরে ছিল দীর্ঘ উচ্চভূমি, পাহাড় বাদ দিয়েস্থানটি ছিল ১২ বর্গমাইল।”
রাজবাড়ির নির্মাণে ইসলামী স্থাপত্যরীতির নিদর্শন
১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে পঞ্চকোটের রাজধানী স্থানান্তরিত হয় কাশীপুরে। সেইথেকে রাজপরিবারটির অধিষ্ঠানক্ষেত্র কাশীপুর। সর্বমোট ৭ জন রাজাকাশীপুরে রাজত্ব করেছিলেন। জগজীবন (১৮১৮-১৮৫১), নীলমণি(১৮৫১-১৮৯৮), হরিনারায়ণ (১৮৯৮-১৯০১), জ্যোতিপ্রসাদ (১৯০১-১৯৩৮), কল্যানীপ্রসাদ (১৯৩৮-১৯৪০), শঙ্করীপ্রসাদ (১৯৪৭-১৯৫৪), ভুবনেশ্বরীপ্রসাদ (জন্ম ১৯৪৩- মৃত্যু ১৯৭২ ২রা অক্টোবর)।
রাজবাড়ির মূল ফটক
গড় পঞ্চকোট গ্রামে ঢোকার মুখেই ঐতিহাসিক দুয়ারবাঁধ তোরণ। পাথরের তৈরি বর্তমানে জীর্ণ তোরণটিরকারুকার্য, গঠনরীতি মুসলিম স্থাপত্যের কথা মনে করায়।
আর কিছু বছরেই সেই রাজধানী প্রতিষ্ঠার দুই শতবর্ষ পূর্ণ হবে। ১৮৩৩-এ মানভূম জেলা তৈরি হয়। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহে রাজা নীলমণি অংশ নেওয়ায় তাঁকে প্রথমে শান্তিপুরে পরে কলকাতায় বন্দী করে রাখা হয়। লর্ড ক্যানিং পরবর্তীকালে তাঁকে মুক্তি দেন। রাজ্যটিবাজেয়াপ্ত হয়—পরবর্তীকালে ফেরত দেওয়া হয়। একটি মফস্সলের গ্রামথেকে কাশীপুর সাংস্কৃতিক রাজধানীতে পরিণত হয়। রাজপ্রাসাদ তৈরিহয়। ‘দ্বিতীয় নবদ্বীপ’ বলা হত কাশীপুরকে। বহু পুকুর খোঁড়া হয়, উদ্যানতৈরি হয়। আসানসোল-আদ্রা রেলপথ স্থাপিত হওয়ার পর কাশীপুরের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। এসময় রানীগঞ্জ-আসানসোল এলাকায়কয়লাখনি আবিষ্কৃত হওয়ায় তার রয়েলটি রাজকোষের শ্রীবৃদ্ধিতেসহায়ক হয়। তৈরি হয় রাজরাজেশ্বরী মন্দির। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ম্যানেজার হিসেবে কিছুকাল কাশীপুরে ছিলেন (১৮৭২)। কাশীপুরে বহু সংগীতজ্ঞ, পণ্ডিত, জ্যোতিষবিদের অধিষ্ঠান ক্ষেত্র হয়। সারা রাজ্যে গান, নাটক, লোকগান, লোকউৎসবের প্লাবন বইতে থাকে। শিল্প-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে কাশীপুর।
রাজবাড়ির অভ্যন্তরে
মহারাজ জ্যোতিপ্রসাদ পঞ্চকোটের শেষ খ্যাতিমান রাজা। তাঁর পরবর্তীকালে কোনও রাজা তাঁদের পূর্বপুরুষদের মতো মহনীয় দায়িত্বপালন করতে পারেননি। অবশ্য ইতিমধ্যে দেশ স্বাধীন হওয়ায় জমিদারিপ্রথার বিলোপ হয়—রাজত্বও ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যায়। ভুবনেশ্বরীপ্রসাদেরঅকালমৃত্যু রাজপরিবারটির ১৯০০ বৎসরের ইতিহাসে যবনিকা টেনেদেয়। অনেকদিন রাজবাড়ির দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন ভুবনেশ্বরীরভগ্নী মহেশ্বরী।
কথিত আছে মহারাজ জ্যোতিপ্রকাশ সিংহদেও ১৯১৬ সালে এই কাশীপুর রাজবাড়ি তৈরি করেন চিন থেকে রাজমিস্ত্রি এনে। টানা ১২ বছর ধরে চলেছিল নির্মাণ কাজ। বেলজিয়াম থেকে বিশাল ঝাড়লন্ঠন নিয়ে এসে লাগিয়েছিলেন প্রাসাদের দরবার হলে। বেলজিয়ামের পেন্টিং করা কাচ, সুবৃহৎ ঝাড় লন্ঠন, পাথরের মূর্তিদেখলে রাজাদের রুচির পরিচয় পাওয়া যায়। আবার রাজাদের শিকারকরা মৃত বাঘ, সিংহ, বাইসন, চিতা প্রভৃতির দেহের ভিতর থেকেনাড়ি-ভুঁড়ি বের করে খড় ভরে যে স্টাফড বা ট্যাক্সিডার্মি রাখা আছে তাও দেখার মতো। রয়েছে রাজাদের ব্যবহৃত তরোয়াল, ঢাল, বর্শা ইত্যাদি যুদ্ধাস্ত্র। তবে রাজবাড়িতে সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। ওই বাড়িতেই রাজপরিবারের বর্তমান বংশধররা থাকেন। শুধু পুজোর সময় রাজবাড়ির একাংশ সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। আজ সেই জৌলুস অনেকখানি স্তিমিত। তবুও দুর্গা পুজোর সময় উৎসব মুখর হয়ে ওঠেএই রাজবাড়ি।
বাঘ শিকার
পঞ্চকোট রাজপরিবারের দুর্গা রাজরাজেশ্বরী রূপে পূজিতা। পুরুলিয়ার কাশীপুর রাজবাড়ির এই কুলদেবীর পুজো কয়েকশো শতক পুরোনো। বর্তমান প্রজন্ম পরিবারের রাজকন্যা মাহেশ্বরী দেবীর পুত্র আনসুলরাজোয়াটের তত্ত্বাবধানেই এখন পুজো হয় রাজবাড়িতে। পুজোর চার দিন এক অন্য মহিমায় সেজে ওঠে রাজবাড়ির মন্দির। সারা বছর বহিরাগত দর্শনার্থীদের প্রবেশের অনুমতি না থাকলেও পুজোর সপ্তমী থেকে দশমী রাজবাড়ির দ্বার খুলে দেওয়া হয় জনসাধারণের উদ্দেশ্যে। পুজোর চার দিন এ রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ আসেন। এ ছাড়া ঝাড়খণ্ড, বিহার থেকেও প্রচুর মানুষ আসেন এই পুজো দেখতে।
কীভাবে যাবেন
হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে যেতে পারেন এবং আদ্রা জংশন বা পুরুলিয়া জংশনে নামতে পারেন।
আসানসোল, বোকারো এবং জামশেদপুর থেকেও ট্রেন ও পাওয়া যায়।
এছাড়াও, আপনি ধর্মতলা থেকে বাসে চড়ে পুরুলিয়া বাস স্টপে নামতে পারেন।
কলকাতা এবং পুরুলিয়ার মধ্যে দূরত্ব প্রায় ৩৩০ কিলোমিটার। সেখান থেকে রাজবাড়ি যাওয়ার জন্য টোটো বা অটো বুক করতে পারেন। আপনি এখানে পৌঁছানোর জন্য একটি স্থানীয় বাস ধরেও যেতে পারেন।
তথ্যসূত্র :
Nature in my lens
মধুময় তামরস, সমীরণ দাস