ভারতের সবথেকে পুরোনো জাদুঘর আমাদের মহানগরেই

‘মিউজিয়াম’-এর বাংলা কেন ‘জাদুঘর’ রাখা হল? কী এমন জাদু আছে বিশাল বিশাল ওই বাড়িগুলোয়? আসলে কল্পবিজ্ঞানের টাইম মেশিন যেন বাস্তবের রূপ পেয়েছে এই জাদুঘরগুলোতে। একের পর এক যুগ চোখের সামনে থরে থরে সাজানো। ইচ্ছে হল তো চলে গেলাম ফ্যারাও যুগের মিশরে। আবার ঠিক তার পরেই যদি ডাইনোসোরদের জগতে চলে যেতে মন চায়, তাতেই বা আটকাচ্ছে কে? এখানেই মিউজিয়ামের জাদু। লাইব্রেরির সঙ্গে মিউজিয়ামের সেদিক থেকে দারুণ মিল। তবে অতীতে পেছোতে পেছোতে লাইব্রেরি আপনাকে ততটাই নিয়ে যেতে যেতে পারে, যতদিন আগে মানুষ লেখা শিখেছে। এর বেশি যাওয়ার ক্ষমতা গ্রন্থাগারের নেই। কিন্তু জাদুঘরের গতি আরও অনেক দূর পর্যন্ত।
ছুটির দিনে আমাদের কলকাতা শহরে পার্ক স্ট্রিট মেট্রো স্টেশনে নেমে যে মিউজিয়াম দেখতে যাই আমরা মাঝেসাঝে, সেটা আধুনিক ভারতের সবথেকে পুরোনো এবং বড়ো জাদুঘর তো বটেই, গোটা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেরই প্রথম জাদুঘর এটি। আজ্ঞে হ্যাঁ, ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের কথাই বলছি আমি। অর্থাৎ কিনা পাতি বাংলায় ভারতীয় জাদুঘর। জাদুঘর যেমন ইতিহাস সংরক্ষণ করে রাখে, তেমনই জাদুঘরেরও তো একটা ইতিহাস থাকে। যদি ভারতীয় জাদুঘরের ইতিহাস খুঁড়তে থাকি, তাহলে পিছিয়ে যেতে হবে সেই উইলিয়াম জোন্সের আমলে। ১৭৮৪ সাল। উইলিয়াম জোন্স তৈরি করলেন এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল। উদ্দেশ্য ছিল প্রাচ্যদেশ নিয়ে গবেষণার জন্য ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায় একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। তখন এশিয়াটিক সোসাইটির দপ্তর ছিল ফোর্ট উইলিয়ামে। সোসাইটির সদস্যরা একটা সময়ে বুঝতে পারলেন, তাঁদের গবেষণার প্রয়োজনেই পুরোনো দিনের মানুষের ব্যবহার করা জিনিসপত্রকে সংরক্ষণ করা দরকার। তার সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক জগৎ নিয়ে পড়াশোনা চালাতে গেলে তো নানা ধরনের জীব ও জড় পদার্থের নমুনাও রাখা উচিত সংগ্রহে। সেখান থেকেই ১৭৯৬ সালে একটি জাদুঘর বানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।
১৮০৮ সালে ব্রিটিশ সরকার চৌরঙ্গী অঞ্চলে এশিয়াটিক সোসাইটিকে জমি দেয় মিউজিয়াম তৈরির জন্য। সে বছরই পার্ক স্ট্রিটের একটা বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় এশিয়াটিক সোসাইটিকে। ১৮১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে যাত্রা শুরু করে সেই দানবীয় টাইম মেশিন। এর নাম তখন ছিল ওরিয়েন্টাল মিউজিয়াম অফ এশিয়াটিক সোসাইটি। পরবর্তীকালে নাম পাল্টে হয় ইম্পিরিয়াল মিউজিয়াম। এদিকে শ্রীরামপুর যুদ্ধের সময়ে বন্দি করা হয়েছিল দিনেমার উদ্ভিদবিদ ড. নাথানিয়েল ওয়ালিচকে। অবরুদ্ধ হয়ে বসে থাকতে থাকতে তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি মিউজিয়ামের। যখন তিনি পাড়ি দিলেন ভিন দেশে, তাঁর দেশ ডেনমার্কের প্রথম জাদুঘর ন্যাশনালম্যুজিত-এর পথ চলা তখন শুরু হয়ে গেছে। পরে তাঁর বৈজ্ঞানিক মেধার কথা বিবেচনা করে তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দিয়েছিল সরকার বাহাদুর। সুযোগ পেয়ে তাঁর মনোবাসনা জানিয়ে একটি চিঠি লিখলেন এশিয়াটিক সোসাইটির কর্তৃপক্ষের কাছে, একটি মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠার অনুরোধ জানালেন। জানালেন, তিনি মিউজিয়ামের সেবা করবেন অবৈতনিক কিউরেটর হিসেবে, তার সঙ্গে উপহার দেবেন দেবেন তাঁর সংগ্রহের দুষ্প্রাপ্য গাছগাছড়াগুলো। প্রাচ্য জাদুঘরের প্রথম সাম্মানিক কিউরেটর নিযুক্ত করা হয় তাঁকেই।
১৮৭১ সালে দীনবন্ধু মিত্র তাঁর ‘সুরধুনী কাব্য’র দশম সর্গে লিখেছিলেন-
“মনোহর যাদুঘর আশ্চর্য-আলয়,
ধরার অদ্ভুত দ্রব্য করেছে সঞ্চয়,
দেখিলে সে সব নিধি স্থিরচিত্ত হয়ে
ঈশ্বর মহিমা হয় উদয় হৃদয়ে;
বিরাজে পুস্তক পুঞ্জ বিজ্ঞান-দর্পণ
মীমাংসা করেছে সবে জলের মতন”।
এশিয়াটিক সোসাইটিতে তখন দোতলায় ছিল লাইব্রেরি আর মিউজিয়াম গড়ে উঠেছিল একতলাতে। তাই ‘পুস্তক পুঞ্জ’ এবং ‘অদ্ভুত দ্রব্য’-র কথা বলেছিলেন ‘নীলদর্পণ’-এর রচয়িতা। এখনকার ভিক্টোরিয়ান প্রাসাদটির ভিত্তি স্থাপন করা হয় ১৮৬৭ সালে। ১৮৭৫ সালে শুরু হয় এটি তৈরি করার কাজ। স্থপতি ছিলেন ডব্লিউ.এল গ্র্যানভিল। চৌরঙ্গী রোডের উপর সবুজ মাঠের পাশে এই প্রাসাদ ১৮৭৮ সালে উন্মুক্ত করা হয় সাধারণ দর্শকদের জন্য। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর এই জাদুঘর এখন রয়েছে ভারত সরকারের সংস্কৃতি দপ্তরের অধীনে।
তথ্যসূত্র – কলিকাতার পুরাকথা, Indian Museum Website