বিধাননগরের ইতিহাস

কমল চৌধুরী
লবণহ্রদ উপনগরী - যা পরিচিত আজ বিধাননগর নামে, তারও একটা হারানো ইতিহাস আছে। আজকের সুদৃশ্য নয়নাভিরাম ঘরবাড়ি, পার্ক, বাজার, ব্যাঙ্ক, স্কুল, খেলার মাঠ, স্টেডিয়াম নিক্কো পার্কের দিকে তাকিয়ে সেই অতীত ইতিহাসের পাতাগুলো ওল্টাবার অবসর কারোর হয় না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের পরিকল্পিত নগরী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর এর নাম হয় ‘বিধাননগর’। কিন্তু আরও আগে, কেমন ছিল এলাকাটি?
লবণহ্রদের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হত বিদ্যাধরী। একদিন মজে গেল বিদ্যাধরী। মজা নদীর আবদ্ধ জলাশয়ে জন্ম নিল ভেড়ি। জল আর জল। বিশাল মাছ চাষের ক্ষেত্রে পরিণত হল। লোকে জায়গাটাকে বলত দত্তাবাদ। উল্টোডাঙা স্টেশনের উঁচু রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে বেলেঘাটা খাল পারে পৌঁছে সামনে দেখা যেত আদিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। মাঝে মাঝে ছোট ছোট দ্বীপের মতো। তার ওপর কিছু চালাঘর। সেখানকার মানুষজন চোখে পড়ত কম। দিনের বেলায়, ভোর না হতেই দেখা যেত সারি সারি জেলে ডিঙি। বলা যায়, ওটা ছিল কলকাতার মাছের আড়ত। অজস্র মালবোঝাই নৌকা জলের বুক চিরে পৌছে যেত শ্যামবাজার বা বেলেঘাটায়। আসত তারা পূর্ববাংলার খুলনা, যশোহর বা অন্য কোনো এলাকা থেকে। অজস্র জ্যান্ত মাছ আসত নৌকার খোল ভরে। কলকাতার মানুষ তখন মাছের সমুদ্রে যেন ভেসে থাকত। বিদ্যাধরীর বুক জুড়ে যখন চড়া পড়ছে, সম্পদশালী লবণহ্রদ তখন শুকিয়ে আসছে। অসংখ্য ভেড়ি জুড়ে তখন আকাল।
কলকাতার যত ময়লা গিয়ে পড়ছে, গঙ্গার কাটা খালের পলি গিয়ে জমছে। এইভাবে কলকাতার পার্শ্ববর্তী লবণহ্রদের এলাকা বেশ উঁচু হয়ে পড়ছিল। আরও দক্ষিণে ক্রমশ সরে সরে যাচ্ছে। লবণহ্রদের বুকে আজ যেখানে বিধাননগর তার পিছন এলাকায় ভেড়ির সংখ্যা কম নেই। বিধাননগরের বিতাড়িত ঐশ্বর্য পাখির আশ্রয়স্থল এখন ঐ ভেড়ি অঞ্চল। মাছও আছে।
আরও পড়ুন
রামচন্দ্র গোয়েঙ্কা জেনানা স্নান ঘাট
কতরকম পাখিই না ছিল লবণহ্রদে! ওখানে পাখি শিকারে যেত ইংরেজ সাহেবরা। অজস্র পাখি মারত এখানে। পাখি মেরেও তারা শেষ করতে পারেনি। যুগোশ্লাভিয়ার একটি সংগঠনের সহযোগিতায় গঙ্গার বুকে জমে থাকা বালি পাইপে করে এনে যখন লবণহ্রদের জায়গা ভরাট করা হল, গাছ কেটে পরিকল্পিত শহর গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হল, তখন স্থানীয় জেলেদের মতো তারাও নিরাশ্রয় হয়ে পড়ল। পাখির সাম্রাজ্যে এখন পাখির আকাল।
কৃষ্ণপুর কাটাখাল ইংরেজ সরকারের অবদান। লবণ হ্রদের উত্তরে এই খাল কাটা হয়েছিল উল্টোডাঙা থেকে কুলটি পর্যন্ত। এভাবেই মিলিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিদ্যাধরীর মূল শাখার সঙ্গে। আর একটা খাল ছিল উল্টাডাঙা থেকে বাগবাজার গঙ্গার ঘাট পর্যন্ত। দুটো খালকে মিশিয়ে দিয়ে নৌচলাচলের পথকে প্রশস্ত করা হয়েছিল সেদিন। বাগবাজার গঙ্গার মুখে একটা লকগেট, কুলটিতে বিদ্যাধরীর মুখে একটা লকগেট তৈরি হল। লবণহ্রদের মধ্যে প্রবাহিত বিদ্যাধরীর মুখে একটা স্লুইসগেট বসানো হয়। বিদ্যাধরী মজে যাওয়ায় ঐ গেটও তাৎপর্যহীন হয়ে পড়েছে। কৃষ্ণপুর খাল কাটার ফলে আজকের লেকটাউন, বাঙ্গুর এভিনিউ, দমদম পার্ক এসব এলাকা লবণহ্রদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। লবণহ্রদ যে দমদম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বিদেশীদের বিবরণে তার প্রমাণ রয়েছে। বিশেষ করে বর্ষার সময় দমদমসহ লবণ হ্রদের উলরাশি একাকার হয়ে যেত।
নতুন জলপথ তৈরির পর পণ্যবাহী নৌকো সরাসরি শ্যামবাজার এসে পৌছাত। এতদিন বেলেঘাটা যে ব্যবসায়ীদের নানা দ্রব্যের আড়ত ছিল, তা সরে আসতে থাকে শ্যামবাজারের দিকে। যেখানে লেকটাউন সেখানে আগে ছিল বিচালিঘাট। নৌকা বোঝাই, বিচালি এসে এখানে জমা হত। দক্ষিণদ্বারি আর ভি আই পি রোডের মুখে ছিল বড় বড় কাঠের গোলা। যার জন্য স্থানটির নাম হয় গোলাঘাট। দেশভাগের পরেও বেশ কিছুকাল ছিল। কৃষ্ণপুরে একটা কুতঘাটা ছিল। অর্থাৎ টোল স্টেশন। এখানে টোল আদায় হত নৌকা প্রতি। তখন তো আজকের মত এত সড়ক ছিল না। আজকের বেশির ভাগ সড়ক তৈরি হয়েছে দেশভাগের পর।
(ঋণ – চব্বিশ পরগনা / কমল চৌধুরী)