‘বেহুলার ঘাট’ থেকেই কি বেহালা অঞ্চলের নামকরণ?

কলকাতা শহর গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে। তবে কলকাতা অঞ্চলে যে আগেও জনবসতি ছিল, তার প্রমাণ ইতিহাসবিদরা পেয়েছেন। কলকাতার মধ্যেই এমন এক জায়গা রয়েছে, যেখানে বেশ তাক লাগানোর মতো বর্ধিষ্ণু জনপদ গড়ে উঠেছিল বেশ কয়েক শতাব্দী আগে। এমনকি বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবেও জায়গাটার খ্যাতি ছিল। এখন সেই অঞ্চলের নাম বেহালা, কলকাতার সবথেকে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে একটা।
বেহালার ইতিহাস খুঁজতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে আটশো বছর পেছনে। অর্থাৎ দ্বাদশ শতাব্দী। বাংলায় তখন পাল-সেন যুগ। এই সময় থেকেই বাংলায় প্রচলিত ছিল বেহুলা-লখিন্দরের গল্প। ‘মনসামঙ্গল’ প্রথম লেখা হয় ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে। কানা হরিদত্ত ছিলেন প্রথম ‘মনসামঙ্গল’-এর রচয়িতা। হরিদত্তের রচিত কাব্য এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে বিজয়গুপ্তের লেখায় এঁর নাম পাওয়া যায়। বিজয়গুপ্তকে ‘মনসামঙ্গল’ ধারার সর্বশ্রেষ্ট কবি বলা হয়ে থাকে।
তখনকার দিনে নদীগুলোর গতিপথ ছিল এই সময়ের থাকে অনেকটাই ভিন্ন। এখন যেটা হুগলি নদী, তা ছিল আগে খুব সংকীর্ণ। বরং আদিগঙ্গাই তখন গঙ্গার মূল ধারা ছিল, বয়ে চলত দুকূল প্লাবিত করে। মানুষ তখন ‘গঙ্গা’ বলতে হুগলি নদীকে নয়, আদিগঙ্গাকেই বুঝত। চিৎপুরে বাঁক নিয়ে কালীঘাট, বারুইপুর হয়ে গঙ্গাসাগরে গিয়ে মিশত এই নদী। ‘মনসামঙ্গল’ অনুযায়ী সাপের কামড়ে লখিন্দরের মৃত্যু হলে তাঁর মৃতদেহ নিয়ে বেহুলা এক ভেলায় চড়ে গাঙুর নদীতে ভেসে সমুদ্রের দিকে রওনা দেন। লোককথা থেকে জানা যায়, বেহুলার ভেলা আদিগঙ্গা দিয়ে যেতে যেতে সুন্দরবনের এক ঘাটে থেমেছিল। সেখানকার নাম পরে হয়ে যায় ‘বেহুলার ঘাট’। এই ‘বেহুলার ঘাট’ নাম থেকেই লোকের মুখে মুখে গোটা অঞ্চলের নাম হয়ে যায় ‘বেহালা’।
প্রথমে জায়গাটা ছিল খুব ঘন জঙ্গল। তখন সেই অঞ্চলটা সুন্দরবনেরই অংশ ছিল। অধিবাসীদের বেশিরভাগই ছিল জেলে আর মধুকর। বেহালার প্রথম যে শাসকের নাম পাওয়া যায়, তাঁর নাম ধনঞ্জয় মিত্র। তিনি ছিলেন দেবী চণ্ডীর উপাসক। দেবী চণ্ডীর আরেক নাম বহুলা। কেউ কেউ মনে করেন, ‘বহুলা’ থেকেই ‘বেহালা’ নামটা এসেছে। কালীঘাট মধ্যযুগে শাক্তদের খুব বড়ো তীর্থক্ষেত্র ছিল। প্রচুর ভক্তের আনাগোনা লেগে থাকত এখানে। আরেকটা বিখ্যাত তীর্থক্ষেত্র গঙ্গাসাগরও ছিল কাছেই। দু’দিকে এমন বড়ো বড়ো তীর্থক্ষেত্র থাকায় বেহালার ঘাটে তীর্থযাত্রীদের ভিড় লেগে থাকত। আর তাদের পেছন পেছন আসত বণিকরা। এইভাবে বেহালা খুব সমৃদ্ধ জনপদে পরিণত হয়।
আরও পড়ুন
এক যে আছে রাজভবন
তখন অনেকগুলো ছোটো ছোটো গ্রাম ছিল এখানে। গ্রামের নামগুলোর শেষে হত ‘বেহালা’ দিয়ে। যেমন, বাজারবেহালা, বোঁড়শেবেহালা (বড়িশা) কিংবা সরশুনোবেহালা। এখনও কলকাতা পুরসভার নথিপত্রে নস্করপুরবেহালা, রাজারবাগানবেহালা, সন্তোষবাটিবেলা – এই নামগুলো পাওয়া যায়। যশোরের দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসক প্রতাপাদিত্যের কাকা ছিলেন বসন্ত রায়। তাঁর রাজধানী ছিল সরশুনোবেহালা। প্রথম শতকের গ্রিক ভূতত্ত্ববিদ টলেমির লেখায় ভারতের মানচিত্রে সালসুনো উপত্যকার নাম পাওয়া যায়। অনেক গবেষকের মতে এই সালসুনোই হল সরশুনোবেহালা। প্রতাপাদিত্য এক শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে হত্যা করেছিলেন বসন্ত রায়কে। প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে যখন মুঘল সম্রাট আকবরের যুদ্ধ লাগল, তখন আকবরের পক্ষে লড়াই করেছিলেন লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় নামে এক বাঙালি। আকবরের ছেলে সম্রাট জাহাঙ্গির তাঁকে দক্ষিণবঙ্গের বিশাল অঞ্চল জায়গির হিসেবে প্রদান করেন। লক্ষ্মীকান্তের রাজধানী ছিল বোঁড়শেবেহালা বা বড়িশা। বাংলায় তিনিই প্রথম দুর্গাপুজো করেছিলেন বলে মনে করা হয়। বিখ্যাত জমিদার বড়িশার সাবর্ণ রাজচৌধুরী ছিলেন তাঁরই বংশধর।
ঋণস্বীকার – বেহালা (ফেসবুক পেজ)