গণিকাপল্লি থেকে শ্মশান-- রাতের কলকাতা শাসন করতেন সাহিত্যিক হেমেন্দ্রকুমার
![Story image](https://www.bongodorshon.com/uploads/story_image/hemendrakumar_roy.jpg)
প্রায় প্রতি রাতেই তখন কলকাতা অভিযানে বেরোতেন হেমেন্দ্রকুমার রায়। সঙ্গী বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেও অনেকে সাহিত্যিক। সকলেই ডাকাবুকো। যে-কোনো রোমাঞ্চকে চেখে নিতে গভীর উৎসাহ সবার। এই দলেরই মাথা হেমেন্দ্রকুমার। যিনি ‘যকের ধন’, ‘আবার যকের ধন’-এর মতো কালজয়ী কিশোর অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী লিখবেন পরে, তাঁর নিজের জীবনের অ্যাডভেঞ্চারগুলো শুনলেও গায়ে কাঁটা দেবে। তবে সেইসব অ্যাডভেঞ্চারগুলো কিশোরমনস্ক ছিল না অবশ্য।
কলকাতার প্রায় সব গণিকাপল্লিতেই রাতের পর রাত ঘুরে বেড়িয়েছেন হেমেন্দ্রকুমার ও তাঁর বন্ধুরা। সোনাগাছি থেকে জয়া মিত্রর গলি, হাড়কাটা, হরি-পদ্মিনীর গলি থেকে মহেন্দ্র গোস্বামী লেন। দেহপসারিনীদের জীবন খুঁটিয়ে দেখেছেন, দেখেছেন বাবুদের হাবভাবও। এই দেখায় বিপদও কম ছিল না। এই যেমন, একদিন এক যৌনপল্লিতে সদলবলে ঢুকেছেন হেমেন্দ্রকুমার। আকণ্ঠ মদ্যপান করে সবাই টলছেন। এই অবস্থায় বাড়ি ফেরার চাইতে কোনো ‘বুলবুলি’র ডেরাতেই রাত কাটিয়ে দেওয়া ভালো। বেশি খুঁজতেও হল না। একটা বাড়ির ছাদে এক মহিলা দাঁড়িয়ে। সে হাতছানি দিয়ে ডাকল। হেমেন্দ্রকুমার আর তাঁর বন্ধুরা ঢুকে পড়লেন সেই বাড়িতে।
সবাইকে ডেকে ভারী যত্ন করে ঘরে বসাল সেই মহিলা। তারপর, একটু বসতে বলে বেরিয়ে গেল। সময় বয়ে যায়, সেই মহিলা আর ফেরে না। ডাকাডাকি করেও সাড়া মিলল না। দরজা খুলে বেরোতে গিয়ে দেখা গেল, দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। হঠাৎ চোখে পড়ল ঘরে একজন শুয়ে। কিন্তু একি! এ তো গলাকাটা একজনের লাশ। নেশা ছুটে গেল। সবাই স্পষ্ট বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা। খুন করে নিজেকে বাঁচাতে তাঁদের ফাঁসাবে ঠিক করেছে সেই মহিলা। যে করেই হোক পালাতে হবে। উপায়? পিছনে একটা দরজা। সেটাও বন্ধ। কোনোমতে খোলা হল। বারান্দা পেরোলেই অন্য বাড়ির ছাদ। কোনোমতে ছাদ টপকে রাস্তায় বেরোতেই সবাই দূর থেকে দেখলেন, কয়েকজন রাতের পাহারাদারকে নিয়ে বাড়ির দিকেই চলেছে তাঁদের হাতছানি দিয়ে ডাকা সেই সুন্দরী।
এমন গপ্প একটা-দুটো নয় হেমেন্দ্রকুমারের জীবনে। তাঁর গোটা জীবনটাই রঙিন রোমাঞ্চে মোড়া। অসামান্য আঁকতেন। গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে ছবি আঁকাও শিখেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ স্নেহও করতেন বেশ। লেখা শুরু মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে। প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ‘বসুধা’ পত্রিকায়। তখন হেমেন্দ্রকুমারের বয়স পনেরো। বাবা রাধিকাপ্রসাদ ছিলেন নামকরা এস্রাজবাদক। গানের পরিবেশে বড়ো হওয়া হেমেন্দ্রকুমার নিজের নিয়মে চুটিয়ে বেঁচেছেন গোটা জীবনটাই। লিখবেন বলে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। অভাবের বশে বইয়ের কপিরাইট বেচে দিয়েছেন। কিশোরদের জন্য লিখতে শুরু করেছেন টাকার প্রয়োজনেই। কে জানত, মূলত কিশোর সাহিত্যিক হিসেবেই পরে অমরত্ব লাভ করবেন তিনি! আমৃত্যু টানা লিখে গেছেন। লিখতে লিখতে হাতে কড়া পড়ে গিয়েছিল। আর লেখার পাশাপাশিই যৌবনে চলেছে কলকাতায় নৈশ অভিযান। সেই অভিযানে নিষিদ্ধ মজলিশ, নিষিদ্ধ পল্লি, গুন্ডাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ-- কী নেই! নিজের জীবনের সেইসব গল্প ছদ্মনামে লিখেও গেছেন। নিজের নামে এইসব দুঃসাহসী অভিযানের গপ্প লেখার দুঃসাহসটি অবশ্য দেখাতে পারেননি তিনি।
দুঃসাহসী অভিযানই বটে। জোড়বাগান এলাকায় ঘুরছেন এক সাহিত্যিক বন্ধুর সঙ্গে। রাত তখন তিনটে-সাড়ে তিনটে হবে। হঠাৎ কানে এল গানবাজনার শব্দ। খানিক এগোতেই চোখে পড়ল গলির শেষে রীতিমতো শামিয়ানা টাঙিয়ে বাইজি গানের মেহফিল বসেছে। গানে ভাসছে গোটা মহল্লা-- ‘আমার ভালবাসা আবার কোথায় বাসা বেঁধেচে/ পিরিতের পরোটা খেয়ে মোটা হয়েচে।/মাসে মাসে বাড়ছে ভাড়া,/বাড়িউলি দিচ্ছে তাড়া,/ গয়লা পাড়ার ময়লা ছোঁড়া প্রাণে মেরেচে’।
শুনেই কেমন ঘোর লেগে গেল হেমেন্দ্রকুমারের। গান-বাজনা তাঁর রক্তে। নিজে পরে লিখেওছেন চারশোর কাছাকাছি গান। তাঁর লেখা গান গেয়েছেন শচীন দেববর্মন, গানে সুর দিয়েছেন কাজী নজরুল ইসলাম, হিমাংশু দত্ত, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়রা। এই গান শুনে তাঁর ঘোর লাগা স্বাভাবিক। কিন্তু দর্শকাসনে চোখ পড়তেই চমকে উঠলেন দুজনে। কলকাতার নামকরা খুনে-গুন্ডারা সেখানে বসে। রাত হলেই এরা নেমে পড়ে ছিনতাই-খুন-ডাকাতিতে। তাতে কী! হেমেন্দ্রকুমার ঠিক করে ফেলেছেন গান শুনেই যাবেন। বন্ধু প্রাণভয়ে বারণ করেন। আজন্ম জেদি হেমেন্দ্র শোনেন না। তিনি বসে পড়েন আসরে।
সেই ‘কুখ্যাত’, ‘দাগি আসামি’ দর্শকরাও খুব তোয়াজ করে বসতে দেয় তাঁদের। ভোরবেলা গান শেষ হতে শুরু হয় খাতির। খালিমুখে ফেরা যাবে না। পোলাও, মাংস, পান—সে এলাহি ব্যবস্থা! কোথায় ছিনতাই, খুনের ভয়! এ যে জামাই আদর।
ভয়ডর বাদ দিয়ে জীবনকে চাখতে না চাইলে বোধহয় এমন অভিজ্ঞতার মোহর জমা হয় না। হেমেন্দ্রকুমার কোনোদিনই শান্তশিষ্ট, ভদ্র, মধ্যবিত্ত সংসারী মানুষটি হতে চাননি। জীবন নিয়ে কোনো ছুৎমার্গ ছিল না তাঁর। সামাজিক মূল্যবোধের আপাত মাপকাঠিতে তাই তিনি আঁটবেন না, তাঁকে বেখাপ্পা ঠেকবে। কিন্তু, তাতে হেমেন্দ্রকুমারের কিচ্ছুটি যায় আসে না। তিনি অনায়াসে চলে যাবেন ভিখিরিদের নৈশ জলসায়। সেখানে ভিখিরিদের সঙ্গে বসেই গান শুনবেন, সুখটান দেবেন তাঁদের এঁটো ছিলিম থেকেই। গুন্ডাদের নৈশজীবন দেখতে গিয়ে কোনোমতে প্রাণ হাতে করে ফিরবেন। শ্মশানে-শ্মশানে ঘুরে বেড়াবেন রাতের পর রাত। আর তারপর কিশোর সাহিত্যের পাতা ভরিয়ে তুলবেন উজ্জ্বল সব অ্যাডভেঞ্চারের গল্পে। তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতার কাছে সেইসব রোমাঞ্চও ম্লান।
এমন মানুষদের মনটাও বোধহয় ছাপোষা মধ্যবিত্তদের চাইতে খানিক বড়ো হয়। বৃদ্ধ নাট্যকার ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ একদিন তাঁকে জানালেন, তাঁর নাটক নাকচ করে হেমেন্দ্রকুমারের নতুন নাটক গৃহীত হয়েছে কর্নওয়ালিশ থিয়েটারের জন্য। ক্ষীরোদপ্রসাদের কাতর মুখ দেখে ভারী মায়া হল হেমেন্দ্রকুমারের। ঠিক করলেন, তাঁর ওই নতুন নাটকের পাণ্ডুলিপি তিনি তুলে নেবেন। সে নাটক আর মঞ্চস্থ হতে দেননি হেমেন্দ্রকুমার। গণিকাপল্লিতে রাতের পর রাত কাটানো, নিশাচর-‘উচ্ছৃঙ্খল’ হেমেন্দ্রকুমারের বড়ো মনের এই পরিচয়টাও অবশ্য আড়ালেই থেকে গেছে চিরকাল।
তথ্যঋণ: ‘যাদের দেখেছি’, ‘রাতের কলকাতা’, ‘চেনা-অচেনা হেমেন্দ্রকুমার’, ‘ভাটি গাঙ বাইয়া’, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়; ‘হেমেন্দ্রসরণি’, বিনোদ ঘোষাল, আনন্দবাজার পত্রিকা।