No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    হেমন্ত-গুলজার জুটিতে নতুনভাবে বাঁধা হল রবীন্দ্রনাথের গান

    হেমন্ত-গুলজার জুটিতে নতুনভাবে বাঁধা হল রবীন্দ্রনাথের গান

    Story image

    ‘কোথায় সাকিন?’

    -‘সাকিন নেই।’

    দু’পাশে সাদা-কালো সবুজ মাঠ। একটা-দুটো গাছ। মাঝের সরু মেঠো রাস্তাটা ধরে লেংচাতে লেংচাতে হেঁটে আসছেন আংটি চাটুজ্জের ভাই বসন্ত। আবহ থেকে ভেসে আসছে কাজী সব্যসাচীর কণ্ঠ-- ‘এখানে ঘর আছে, ভালোবাসা আছে, মানুষও আছে। কিন্তু এমন মানুষ, ঘরের ভালোবাসা যাকে বেঁধে রাখতে পারে না। তাই ঘর ছেড়ে সে শুধু পথে পথে ঘুরে বেড়ায়।’ এমনই মানুষ বটে বসন্ত। তারই গল্প। কোথায় যাওয়ার কথা ছিল, কোথায় চলে যায়। সাকিন জিজ্ঞেস করলে গেয়ে ওঠে—‘জীবনপুরের পথিক রে ভাই/ কোনো দেশেই সাকিন নাই...’

    ‘পলাতক’ আসলে একটা ঘোরের নাম। মনোজ বসু রচিত ‘আংটি চাটুজ্যের ভাই’-কে নিয়ে চিত্রনাট্য সাজালেন তরুণ মজুমদার। পোস্টারে পরিচালনার জায়গায় যদিও লেখা ‘যাত্রিক’, কিন্তু পরিচালক তরুণই। তবে, এই ছবি যতখানি তরুণ মজুমদারের, যতখানি অনুপকুমারের, ঠিক ততখানিই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়েরও। ছবির সুরকার তিনি। একাধিক গানের গায়কও। নিজেকে নিংড়ে এই ছবির গান বুনেছেন হেমন্ত। ঝুমুর, বৈষ্ণবীয় সুরের স্পর্শগুলোতেও নিজের স্বাক্ষর জুড়ে দিয়েছেন। এই ছবি থেকে হেমন্তর গানকে আলাদাই করা যায় না। বংশীপুরগামী খড়বোঝাই গরুর গাড়ির সামনে হঠাৎ বসন্ত গেয়ে ওঠে-- ‘তব রথচক্রতলে পিয়া বলে প্রাণপাখি দিব হে...’ ওই একটি মাত্র পঙ্‌ক্তি। ‘হে’-এর পরের টানটি যেন শ্রোতা ও দর্শকের সামনে একটা দিকনির্দেশহীন আকুল চলার পথ বুনে দেয়। সেই পথ ধরেই চলতে থাকে গরুর গাড়ি। মুকুল দত্তের লেখা গানও ভাসতে থাকে-- ‘খেয়ালপোকা যখন আমার মাথায় নড়ে-চড়ে/ আমার তাসের ঘরের বসতি হে, অমনি ভেঙে পড়ে রে/ তখন তালুক ছেড়ে মুলুক ফেলে হই রে ঘরের বার...’ 

    হেমন্তর কণ্ঠকে তখন আদর করে আকাশ ও চরাচর।

    এই ছবিতে বারবার ম্যাজিক বুনেছেন হেমন্ত। ঝুমুরাঙ্গের গান, তারপর গমগমে তবলার শেষে হঠাৎ ‘আহা কৃষ্ণ কালো, আঁধার কালো, আমিও তো কালো সখী’। কিংবা মেলার মধ্যে ‘দোষ দিও না আমায় বন্ধু’ গানে ‘সুখে থাকো তুমি বন্ধু আমি চলে যাই’-এর পরে টান হঠাৎ বদলে যায় কাশির দমকে। এই ছবিতে বসন্তর গানে প্রয়োজনই ছিল একটা খোলা, ব্যাপ্ত পরিবেশের মেজাজ। যেটা ‘সূর্য ডোবার পালা, আসে যদি আসুক’-এর রোমান্টিকতার মৃদু ঘোরের থেকে আলাদা। আর, হেমন্ত এইখানেই অনবদ্য। সুরকার হেমন্তও এই ছবিতে খুঁতহীন। কী সব গান আছে ‘পলাতকে’। ‘আহা রে বিধি গো তোর’ কিংবা ‘মন যে আমার কেমন কেমন করে’-র সুর অনায়াসেই মুগ্ধতার চাদর জড়িয়ে নেয় গায়ে। 

    ‘পলাতক’ রিলিজ করল ১৯৬৩-তে। আর এর ৬ বছর পরে বেরোলো ‘রাহগির’। হিন্দি সিনেমা। পরিচালনায় সেই তরুণ মজুমদার। ফের এক ভবঘুরে নায়কের চরিত্রে বিশ্বজিত। গোটা সিনেমার সঙ্গেই ‘পলাতক’-এর বিপুল সাদৃশ্য। এখানেও সঙ্গীতের দায়িত্বে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ‘পলাতক’-এর ম্যাজিককেই যেন আরো বাড়িয়ে নিলেন হেমন্ত। এখানে তাঁর সঙ্গে জুটি বাঁধলেন গুলজার। ‘জনম সে বানজারা হুঁ বন্ধু’ গানটি ‘জীবনপুরের পথিক রে ভাই’-এরই অনুবাদ। মুকুল দত্তের লেখা গানকেই মূলত অনুসরণ করেছে গুলজারের দেওয়া নতুন শব্দশরীর। এই ছবির নানা গানে কণ্ঠ দিয়েছেন কিশোরকুমার, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁশলে, আরতি মুখোপাধ্যায়, মান্না দে। মিউজিকাল হিসেবে সোনার ফ্রেমে বাঁধানোর মতো ছবি।

    ছবিতে ‘কভি রুক গ্যয়ে হ্যায়’ গানটির শুরুতেই হেমন্ত গেয়ে ওঠেন—মুঝে দোষ না দে না বন্ধু/ মেরা কোয়ি দোষ নেহি...’। শ্রোতামাত্রেই মনে পড়ে যেতে বাধ্য, ‘পলাতক’-এর ‘দোষ দিও না আমায় বন্ধু, আমার কোনো দোষ নাই’ গানটি। যদিও সুরের গড়নে গানদুটি আলাদা। কিন্তু ‘রাহগির’-এর গানের কথা লেখার সময় বারবার ‘পলাতক’-এর গানগুলির কাছে নতজানু হতে হয়েছে গুলজারকে। 

    এই ছবির একটি অন্যতম চমকের জায়গা আরতি মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘দো দো পঙ্খ লাগাকে’। গানটি রবীন্দ্রনাথের ‘তোমার খোলা হাওয়া’-র সুরে। যদিও গানের কথায় গুলজার রবীন্দ্রনাথের থেকে সরে এসেছেন অনেকখানি। স্বাধীনতা নিয়েছেন। এক স্রষ্টার গান অন্য ভাষার গড়ন পেয়েছে। গানটিও তাই নিছক অনুবাদ হয়ে ওঠেনি। এবং এই গানকেই আরো নতুন করে তুলেছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরারোপ। শুরুতে কোরাস, মাঝের অ্যারেঞ্জমেন্ট গানের মেজাজকে গড়ে-পিটে নিয়েছে নতুনভাবে। অত্যন্ত আধুনিক সেই গড়ে তোলা। বিশ্বভারতী এই গান ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল, ভাবলে অবাক লাগে। ভালোও লাগে।

    ‘রাহগির’ ৫০তম বছরে পা রাখল এইবারে। আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষও এই বছরেই। মুগ্ধতার সমাপতন।    

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @