মৃত্যুকে যেভাবে পড়লেন হাইডেগার

সব থেকে পুরোনো দার্শনিক প্রশ্ন কী? এর উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে ‘জীবনের অর্থ কী?’, এই প্রশ্ন অনাদি কাল থেকে মানুষ করে এসেছে। কখনও অপরকে আবার কখনও নিজেকে। এই প্রশ্ন দার্শনিক প্রশ্ন হলেও, কেবল মাত্র তত্ত্বচর্চায় মশগুল দার্শনিকদের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকেনি। মগজ পুড়িয়েছেন সাধারণ মানুষ, শিল্পী সকলেই। আর এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে অবধারিতভাবে এসে পড়েছে মৃত্যুর প্রসঙ্গ। কী অর্থ মৃত্যুর? কেননা মৃত্যুকে আমি কী ভাবে দেখছি তা যদি স্পষ্ট না হয়, তাহলে জীবনের অর্থ কী, সে পথে আমার ভ্রমণ কী ভাবে সম্ভব হবে।
হাইডেগারের দর্শনে মৃত্যুর গুরুত্ব বুঝতে হলে একটি জার্মান শব্দের অর্থ জানতে হবে। ‘ড্যাসায়েন’ শব্দের অর্থ হল এখানে থাকা বা ওখানে থাকা। থাকা মানেই ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্ব। অন্য যা কিছু আছে জগতে, ইট, কাঠ, পাথর, সেসব নিছকই আছে। আর ড্যাসায়েন, মানে এমন ব্যক্তিসত্তা যা জগতকে নিয়ে অস্তিত্ববান। যাকে জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। যখন কোনও ব্যক্তি সত্তা জগতকে ব্যাখ্যা করতে যায়, তখন সে নিজেকেও ব্যাখ্যা করে। কেননা তাঁকে বাদ দিয়ে জগৎ সম্পূর্ণ নয়, সেও এই জগতের মধ্যে। আবার যখন কেউ নিজেকে ব্যাখ্যা করতে যায়, তখন সে জগতকেও ব্যাখ্যা করে ফেলে, কেননা জগতকে বাদ দিয়ে তার কোনও অস্তিত্ব নেই। বলা যায়, এ ভবসংসারের ‘মায়া’ চাইলেও সচেতন মানুষ এড়িয়ে চলতে পারে না।
হাইডেগার বলেন, এই ড্যাসায়েন বা সচেতন মানবসত্তা কখনোই স্থবির নয়, পূর্ণ হবে বলে সব সময় যেন অপেক্ষা করছে। কী সে হতে পারে সবসময় সে যেন সেই সম্ভাবনাগুলোর দিকে পথ চেয়ে বসে আছে। আর এই মানবসত্তার কাছে সময়ের ধারণা শাশ্বত কিছু নয়। ‘সময়’ তাঁর জন্মের ক্ষণে সৃষ্টি হয়েছে, তাঁর মৃত্যুর ক্ষণে সেই ‘সময়’ ফুরিয়ে যাবে। মাঝখানটুকু হল তাঁর সময়, ‘অথেনটিক টাইম’। মানুষ বর্তমানকে অর্জন ক’রে নিজেকে ভবিষ্যতমুখী করে তোলে। আর তারপর যে অতীত সৃজনে তাঁর ভূমিকা নেই, তাকে আত্তীকৃত করতে পিছনে ফেরে।

এখন যে সম্ভাবনাগুলোর মুখোমুখি হওয়ার জন্য সচেতন মানুষ অপেক্ষা করছে জীবনের এই খেলাঘরে, তার মধ্যে ‘এককতম’ হল মৃত্যু। মৃত্যু এমন এক সম্ভাবনা যাকে সে কখনোই এড়িয়ে যেতে পারে না। মৃত্যু অপরিহারযোগ্য। তা কোনও স্বাধীন বা স্বতন্ত্র বিষয় নয়, বা বহির্জাগতিক কোনও এমন ক্ষমতা নয় যার সঙ্গে মানবসত্তার কোনও সন্মন্ধ নেই। সম্ভাবনারূপে সবসময় মানবজীবনের দ্বারে কড়া নাড়ে, আর বলে আমি না থাকলে তোমার অস্ত্বিত্বের কাঠামো সম্পূর্ণ হবে না। হাইডেগারের কাছে তাই মৃত্যু হল প্রতিমার চক্ষুদানের মতোই এক অনিবার্য বিষয়। মাটির প্রতিমায় রং পড়লো। তাও সে সম্পূর্ণ নয়। যেই শিল্পী তার চোখ দুটি আঁকলেন, তখনই তা সম্পূর্ণ হল। আর মৃত্যুকে বাদ দিয়ে কেউ যদি কেবল অস্তিত্বকে ভাবতে যায়, তাহলে চিন্তা থেকে যাবে অসম্পূর্ণ প্রতিমার মতোই।
তাই হাইডেগারের ড্যাসায়েন বা জগৎ-সম্পৃক্ত-সত্তা বা সচেতন মানব হল সেই অর্থে মৃত্যু- অভিমুখীন- সত্তা। ‘ ভব সিন্ধু পাড় হব বলে তোর লগে বইস্যা আছি’। এই ‘তুই’টা হল হাইডেগারের ‘মৃত্যু’, যার লগে বসে থাকাটাই মানবজীবনের আশ্চর্য নিয়তি।
হাইডেগার মৃত্যুর ধারণা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নিয়ে আসেন উদ্বেগের(অ্যাংজাইটি) ধারণাকেও। ভয় আর উদ্বেগ এক নয়। হাইডেগার বলেন, ভয় কোনও নির্দিষ্ট বিষয় থেকে হয়। আর উদ্বেগ কোনও মানসিক দুর্বলতা নয়, যে তাকে এড়িয়ে চলতে হবে বা অতিক্রম করতে হবে। হাইডেগারিয় উদ্বেগ হল মানব সত্তার অস্তিত্বের ভিতর তার না থাকার সচেতনতার বোধ। অর্থাৎ ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’, একদিন আমি যে থাকব না, এই না থাকার অনিবার্যতাকে উপলব্ধি করা। এই উদ্বেগ অনিবার্যতাকে অনুভবের ভিতর দিয়েই মৃত্যু এমন এক সম্ভাবনা রূপে প্রকাশিত হয় যা মানব সত্তার অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ করে।
মৃত্যু ভাবনা বা মৃত্যু চেতনা মানুষের কোনও দুর্বলতা নয়। হাইডেগারের মতে, ‘একদিন যেতে হবে চলে’ এই ভাবনা হল অস্তিত্বের শক্তি ও ক্ষমতা। কেননা জীবন সম্পূর্ণভাবেই জীবন। কিন্তু তা মৃত্যু অভিমুখী। এই ভাবনাকে দূরে ঠেলে কেউ যদি মৃত্যুকে নৈর্ব্যক্তিক ও গুরুত্বহীন ভাবে এবং আরাম ও বিলাসে জীবন কাটায় তাহলে মানবসত্তা একটি মিথ্যাকে আশ্রয় দেবে। মিথ্যাকে সুরক্ষা দেবে। মৃত্যু যে তাঁর অস্তিত্বের অনন্য সম্ভাবনা এই সত্যটুকু যত সে লুকিয়ে রাখবে ততই সে নিজেকে জানার পথ থেকে দূরে সরে যাবে। সার্থক মানবসত্তা তাঁর সমগ্র জীবন দিয়ে মৃত্যুকে সাক্ষাৎ করে। এইভাবেই সে অন্যদের থেকে আলাদা হয়, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র রচিত হয়। তাই সার্থক আত্মত্ব ( অথেনটিক সেলফহুড) অর্জনের জন্য মানুষকে উপলব্ধি করতে হবে মৃত্যু হল তার চূড়ান্ত যথার্থ, চূড়ান্ত স্পষ্ট, চূড়ান্ত অনবদমনীয় এবং চূড়ান্ত অনতিক্রমনীয় সম্ভাবনা।
এই মার্টিন হাইডেগারই একদিন হিটলারের নাৎসিবাদকে সমর্থন করেছিলেন। নাৎসি পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। তবে খুব বেশি দিনের জন্য নয়। নাৎসিদের ইহুদি বিদ্বেষকে সমর্থন করতে পারেননি তিনি। ইহুদি ধ্বংসলীলাকে তো নয়ই। এই ভাবেই দর্শনের ইতিহাসে এক ও অনন্য থেকে গেছেন তিনি। তাঁর মৃত্যুদর্শনও চিন্তার এক বিস্তৃত ক্যানভাস।