মল্লভূমের হিম পুতুল

বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য টেরাকোটা। বহু শতাব্দী ধরে মন্দির-মসজিদের অলংকরনে, পুতুল শিল্পে, দৈনন্দিন কাজে আমরা পোড়ামাটি ব্যবহার করি। নান্দনিক গুণের জন্য তা কেড়ে নেয় মন। পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয় না টেরাকোটায়। বরং তার অসাধারণ রূপে মুগ্ধ হয়ে বাংলার নানা প্রান্তে ভিড় জমান সারা বিশ্বের পর্যটকরা।
আদিম যুগ থেকে মানুষ পোড়ামাটি দিয়ে পুতুল বানিয়ে আসছে। বাংলার লোকশিল্পীদের বানানো টেপা পুতুলে আদিমতার ছাপ আজও পাওয়া যায়। বাংলার পুতুল শিল্প খুব সমৃদ্ধ। দক্ষিণ ২৪ পরগনার মজিলপুরের পুতুলে ফুটে ওঠে গ্রাম এবং শহুরে জীবনের নানা চিত্র। ইংল্যান্ডের সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়ার আদলে হাওড়ার রানি পুতুল তৈরি হয়। পাঁচমুড়ার বোঙা হাতি এবং ঘোড়া পাড়ি দেয় নানা দেশে। বিষ্ণুপুরের হিঙ্গুল পুতুলও বয়ে নিয়ে চলেছে প্রাচীন উত্তরাধিকার।
একসময়ে বিষ্ণুপুর ছিল মল্ল রাজাদের রাজধানী। বাঁকুড়ার এই প্রাচীন জনপদ এবং তার সংলগ্ন অঞ্চল তাই মল্লভূম নামে পরিচিত। এখানকার অলিতে গলিতে লুকিয়ে রয়েছে ইতিহাস। বিষ্ণুপুর ভ্রমণার্থীদের এক প্রিয় গন্তব্য। টেরাকোটার নানা স্থাপত্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। রাসমঞ্চ, জোড় বাংলা মন্দির, শ্যামরায় মন্দির, মদনমোহন মন্দির, নন্দলাল মন্দির, মৃন্ময়ী মন্দির – যত দেখবেন তত মুগ্ধ হবেন। বাংলার একমাত্র মার্গ সংগীত ঘরানার পীঠস্থান বিষ্ণুপুর।
ষষ্ঠী পুতুলের একটি বিশেষ ধরন হিঙ্গুল পুতুল। তবে ষষ্ঠী পুতুলের কাঁখে শিশু থাকে, যা হিঙ্গুল পুতুলে দেখা যায় না। মাটি দিয়ে পুতুল বানিয়ে রোদে শুকোনো হয়। গাছগাছালির থেকে সংগ্রহ করা রং দিয়ে রাঙানো হয় তারপর। পুতুলকে উজ্জ্বল করে তুলতে লাগানো হয় সিনাবার – লালচে খনিজ পদার্থ। বিষ্ণুপুর অঞ্চলে তা হিঙ্গুল নামে পরিচিত। বাঁকুড়া আর পুরুলিয়ার কিছু জায়গায় সিনাবার পাওয়া যায়। হিঙ্গুল পুতুলের আরেক নাম হিম পুতুল। ইউরোপীয় সংস্কৃতির ছাপ পড়েছে তার সজ্জায়। পরনে ফ্রক, মাথায় পশ্চিমি ধাঁচের টুপি। হিঙ্গুল পুতুলের উচ্চতা হয় এক আঙুলের মতো।
বাচ্চাদের খেলনা হিসেবেই এই পুতুল জনপ্রিয়। পাশাপাশি, ষষ্ঠীপুজো ও জিতাষ্ঠমীর ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে হিঙ্গুল পুতুল কাজে লাগে। কেউ কেউ মানত করার জন্য ব্যবহার করে থাকেন। আপনিও ঘর সাজানোর জন্য হিম পুতুল সংগ্রহ করতে পারেন।
হিম পুতুল বানিয়ে থাকে শীতল ফৌজদারের পরিবার। কার্তিক ফৌজদারের বংশধর শীতল। মল্ল রাজা বীর হাম্বীরের জন্য দশাবতার তাস প্রথম তৈরি করেছিলেন কার্তিক ফৌজদার। প্রজন্মের প্রর প্রজন্ম ধরে তাঁদের পরিবার বাঁচিয়ে রেখেছে পুরোনো শিল্পের ঐতিহ্যকে। বাড়ির মেয়েরাই দক্ষ হাতে হিঙ্গুল পুতুল বানান। এছাড়া দশাবতার তাস এবং দুর্গাপটের শিল্পী তাঁরা।
কীভাবে যাবেন
রেলপথে যেতে চাইলে হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেন ধরতে হবে। নামতে হবে বিষ্ণুপুর স্টেশনে। সময় লাগবে ৩ ঘণ্টার মতো। গাড়ি নিয়ে সড়কপথে গেলে সাড়ে ৪ ঘণ্টায় বিষ্ণুপুর পৌঁছবেন। কলকাতা থেকে বাসে করেও যাওয়া যায়। তবে মহামারির কারণে এখন ট্রেন এবং বাস চলাচল অনিয়মিত। যাওয়ার আগে তাই সঠিক খোঁজখবর নিয়ে তবেই বেরোবেন।
কোথায় থাকবেন
পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন নিগমের নিজস্ব বিষ্ণুপুর ট্যুরিজম প্রপার্টিতে কয়েকদিন পরিবার কিংবা বন্ধুবান্ধব নিয়ে থাকতে পারেন স্বচ্ছন্দে। থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা অসাধারণ। বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করুন –
West Bengal Tourism Development Corporation Ltd
DG Block, Sector-II, Salt Lake
Kolkata 700091
Phone: (033) 2358 5189, Fax: 2359 8292
Website: https://www.wbtdcl.com/
Email: visitwestbengal@yahoo.co.in,
mdwbtdc@gmail.com,
dgmrwbtdc@gmail.com