মোদিকেয়ারের কথা শেষ বছরে!

দেশের সবচেয়ে গরিব ১০ কোটি পরিবারকে(কমবেশি ৫০ কোটি মানুষ) নিখরচায় ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত স্বাস্থ্য–পরিষেবার আওতায় আনার কথা মোদি সরকারের মনে পড়ল একেবারে শেষ বাজেটে। বাজেট বক্তৃতায় অরুণ জেটলি বলেননি কত টাকা এর জন্য লাগবে। বরাদ্দ করেছেন ২ হাজার কোটি। যিনি এই প্রকল্পটির কথা ভেবেছিলেন, তিনি নীতি আয়োগের এক সদস্য। নাম বিনোদ কে পল। স্বাস্থ্য পরিষেবায় দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। ১০ কোটি পরিবারের জন্য, তাঁর হিসাব অনুযায়ী, বিমার খরচ দাঁড়াবে ১২ হাজার কোটি টাকা। তিনি পরিবারপিছু বিমার প্রিমিয়ম ধরেছেন ১ থেকে ২ হাজার টাকা। ধরে নিলাম, তিনি খুব রক্ষণশীলভাবে হিসাব কষেছেন। অনেকে বলছেন টাকা লাগবে অনেক বেশি। ধরে নিলাম আসলে খরচটা দাঁড়াবে এর আড়াই গুণ। তাহলেও দরকার বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা। প্রশ্ন হল, এই টাকাটা কি খুব বেশি, যে সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় বিষয়টা উপেক্ষা করে একেবারে শেষ বাজেটে এই প্রস্তাব পেশ করতে হল।
উত্তরটা সহজ। না, বেশি নয়। দেশের অর্থনীতি আজ যে জায়গায় দাঁড়িয়ে সেখানে এই টাকা মোটেই বিরাট কোনও অঙ্ক নয়। এই খরচের এক–তৃতীয়াংশও যদি রাজ্যগুলো বহন করে, তাহলে কেন্দ্রকে বইতে হবে ২০ হাজার কোটি টাকার দায়। রাজ্যগুলোর কারও ঘাড়ে খুব বেশি বোঝা চাপবে না। তাহলে এই কাজটা প্রথম বছরেই তো শুরু করতে পারত মোদি সরকার। এতদিনে দেশের ৫০ কোটি মানুষ ধন্য ধন্য করতেন নরেন্দ্র মোদিকে। কেন করা হল না? এর সম্ভবত একটাই উত্তর। সেই মানসিকতাই নরেন্দ্র মোদি বা তাঁর মন্ত্রীদের ছিল না। মোদি পুরোপুরি পুঁজিবাদী উন্নয়নে বিশ্বাসী। দেশে শিল্প বাণিজ্য বাড়লে মানুষের কাজের সুযোগ বাড়বে, আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন চুঁয়ে চুঁয়ে নামবে নীচের তলায়, এইটাই তিনি বিশ্বাস করেন। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় নীচের তলায় সমৃদ্ধি পৌঁছতে বহুদিন লেগে যায়। বলা যায়, বহু দশক লেগে যায়। ততদিন পর্যন্ত গরিব মানুষের স্বাস্থ্য–শিক্ষার ব্যবস্থা না করে বসে থাকাটা কি আদৌ মানবিক?
আরও পড়ুন
রাজনীতির অঙ্গনে ঈশ্বরের কোনও ভূমিকা নেই
কাজটা যে সহজেই করে দেখানো যায়, তা মমতা ব্যানার্জির সরকার প্রমাণ করেছে। বাম আনলে শোনা যেত, অর্থনীতির হাল ভীষণ, ভীষণ খারাপ। তাই গরিবদরদী বাম সরকার রাজ্যের মানুষের বিনা পয়সায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেনি। অথচ তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে দেখা গেল, রাজস্ব আদায় বাড়ছে হুহু করে। সব সরকারি হাসপাতালে নিখরচায় স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়াও সম্ভব হল। বিরোধীরা মমতা ব্যানার্জির বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ করে থাকেন। কিন্তু এই যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, যার দৌলতে গরিব মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়, তা এখনও দেশের তিন–চারটির বেশি রাজ্যে নেই। কংগ্রেস–বিজেপি কেউই এই বিষয়টা নিয়ে ভাবেনি। গত ইউপিএ সরকারের আমলে একটা যুগান্তকারী কাজ হয়েছিল। গরিব মানুষকে একশো দিনের কাজ দেওয়া। তার দৌলতে ২০০৯ সালে গ্রামাঞ্চলে ভাল ফল করেছিল কংগ্রেস। আর পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচক গরিব মানুষদের অনেকেও কিন্তু ভোটের দিনে ঘাসফুলেই বোতাম টেপেন।
এই মোদিকেয়ারের কথা বিজেপি হয়তো আদৌ ভাবত না গুজরাটের গ্রামাঞ্চলে ধাক্কা না–খেলে। সেখানে দেখা গেছে কী ভাবে শহুরে ভোটার আর গ্রামীণ ভোটার বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। গুজরাট উন্নত রাজ্য, বাণিজ্যমনস্ক রাজ্য, এবং গত ২০–২৫ বছরে সেখানে নগরায়ণ হয়েছে দ্রুত। তাই সেখানে গ্রামের অসন্তোষ সত্ত্বেও জেতা যায়। কিন্তু রাজস্থানে যায় না। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত যে মোদিকেয়ারের বিষয়টা ভাবা হয়েছে, এটা একটা বড় ঘটনা। একেবারে নীচের তলার মানুষের ন্যূনতম রোজগারের ব্যবস্থা আগেই হয়েছে একশো দিনের কাজের মাধ্যমে। এরপর তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত হলে অনেকটা কাজ হবে। শিক্ষার ভাল ব্যবস্থা কীভাবে করা যায়, সেই প্রশ্নটা অবশ্য থেকে যাচ্ছে। শিক্ষা বা স্বাস্থ্য, দুটোরই মান কীভাবে উন্নত করা যায়, সেই প্রশ্নও থাকছে। বাজেটে বলা হয়েছে, প্রতি তিনটি সংসদীয় কেন্দ্রে একটি করে মেডিক্যাল কলেজ তৈরি করা হবে। সেটা হলে স্বাস্থ্য পরিষেবায় অনেকটা সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু কতদিনে হবে, জানা নেই।