ঠাকুরবাড়ির গুরু-শিষ্য – ১

‘এ বি সি ডি ই এফ জি
এইচ আই জে কে এলেমেনো পি
কিউ আর রেস টি ইউউভি
ডাবলু এক্স ওয়াই জেড্ এ বি সি!
যাত্রা হবে। গুরুর লেখা নাটক অভিনয় করবে তাঁর স্যাঙাতরা। গুরু হলেন ঠাকুর বাড়ির বাচ্চা-কাচ্চাদের প্রিয় দাদামশাই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং স্যাঙাতরা হলেন মোহনলাল, শোভনলাল, বাদশা, বীরু, রাণী, ক্ষিতীশ সহ বাড়ির মাঝারি ও ছোটরা। জোড়াসাঁকো বাড়ির একতলায় শুরু হল রিহার্সাল। এদিকে পাতার পর পাতা যাত্রাপালা থেকে-থেকেই বদলে যাচ্ছে। কিন্তু উৎসাহের অন্ত নেই। যেই আসে রিহার্সাল দেখতে, তাকেই দাদামশাই একটা করে পার্ট দিয়ে দেন। কুমুদ পাল, আরতি, দীপালি, পাশের বাড়ির ঘেঁটু সবাইকেই একটা করে পার্ট দেওয়া হল। আর কুশীলব বাড়াতেই শুরু হয় কাটাকুটি করে নতুন ভাবে আবার লেখা। দাদামশায়ের মতে যাত্রা হবে এমন যাতে, যাঁরা যাত্রা দেখতে আসবেন তাদের যেন মনে হয় তারাও যাত্রার অংশীদার এবং যাত্রায় অংশগ্রহণ করছেন। যাত্রার গানের সুর দেবেন প্রশান্ত রায়। এদিকে যাত্রার ইংরেজ চরিত্র ‘র্যাং সাহেবের’ এর জন্য ফাঁদতে হবে ইংরেজি বর্ণমালার দিয়ে গান। কিন্তু দু-তিন দিন ধরে চেষ্টা করেও তা সম্ভব হল না। একদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চেষ্টা করে সে দিনের মত চেষ্টা চরিত্রে ইতি দিয়ে মন খারাপ করে যে যার কাজে বেরিয়ে পড়ল। দাদামশাই স্নান করতে গেলে পর প্রশান্ত রায় ঘর্মাক্ত অবস্থায় বাড়ির দিকে যাওয়ার জন্য দু-চাক্কার বাহনটি স্টার্ট দিলেন। হঠাৎ এক চিৎকারে সকলে ঘুরে দাঁড়াল। গা ভেজা, লুঙ্গি হাঁটুর উপরে গোটানো, মাথা দিয়ে বৃষ্টির ফোটার মত চুঁয়ে চুঁয়ে জল পড়ছে, অর্ধেক স্নান করে দাদামশাই প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে আর্কিমিডিসের মত ইউরেকা ইউরেকা বলে ছুটে আসছেন। ‘আমি পেয়ে গেছি, ওরে তোরা শিগগিরি গানটা ধর, হারমোনিয়াম নিয়ে আয়।’ স্যাঙাতরাও সব দাদামশাইয়ের হাঁকডাক শুনে সবাই হাজির হল সেখানে। বাঁধা হল ওপরে উল্লিখিত চিরস্মরণীয় গানটি।
জগতে গুরুদের ইতিহাস সকলে অবগত হলেও গুরুদের স্বভাব চরিত্রের সঙ্গে ডালপালার মতো জড়িয়ে-জাপটে থাকা এক দল স্যাঙাত বা সাগরেদর নাম কেউ খুব উচ্চারণ করে না। কিন্তু মিষ্টি জলে এসব সাগরেদরা মিছরির দানা। যেমন ঠাকুর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেবের স্যাঙাত হৃদয়রাম। চ্যালা, স্যাঙাত বা সাগরেদ শব্দগুলি শুনে মনে হয় গুরুর আজ্ঞাবাহী, গুরুর কথায় হ্যাঁ বলা পথ অনুগামী কতগুলি ছিঁচকে পোঁ-ধরা বাদর। যারা যথা সম্ভব সকলের কর্ণে প্রবেশের লক্ষ্যে খোল করতাল নিয়ে গুরুর গুণকীর্তন করতে থাকে, যতক্ষণ না সকলের কর্ণগোচর হয়। গুরু ও স্যাঙাত শব্দ দুটি উচ্চারণ করার সময় শ্লেষের ইঙ্গিত মিশে রসায়নের রস সঞ্চার হয়। কিন্তু কথায় বলে না, যেমন গাছ তেমনি স্বাদ। ঠিক তেমনি ঠাকুরবাড়ির গুরু ও স্যাঙাতরা।
৫ নম্বর ও ৬ নম্বর বাড়ি দু’টি শুধুমাত্র একটি সাঁকো দিয়েই যুক্ত ছিল না। এই দুই বাড়িতেই ছিল গুরু ও স্যাঙাতের বাসস্থান। ছয় নম্বর বাড়ির রবিকা গুরু এবং তার স্যাঙাত ছিলেন পাঁচ নম্বর বাড়ির তিন ভাই গগন, সমর ও অবন। স্বদেশী আন্দোলনের যুগ, সকলেই নিজের দেশকে কিছু দেওয়ার চেষ্টা করছে। ঠাকুরবাড়িতেও তার হাওয়া লাগল। রবীন্দ্রনাথ ও স্যাঙাতরা ঠিক করলেন দেশের মানুষকে একত্রিত করতে হবে। ঠিক করা হল সকলে পায়ে হেঁটে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে স্নান সেরে সকলের হাতে রাখি পড়াবেন। দিন ঠিক হল রাখি পূর্ণিমা। যেমন কথা তেমনি কাজ। সকালবেলা গুরু রবিকা ও তাঁর সাঙ্গ-পাঙ্গরা চললেন মিছিল করে, গান গেয়ে। পথে জুটে গেল আরও হাজারো লোক। গুরু আর স্যাঙাতের পিছু পিছু তারাও চলল গঙ্গার ঘাটে। সেই দিন থেকে রাখি পূর্ণিমার দিনটি সকলের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পেল।
আরও পড়ুন
রবীন্দ্র-প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু
দেশে বিদেশি দ্রব্য বর্জনের ডাক আসল। ঠিক করা হল স্বদেশী দ্রব্যের দোকান খোলা হবে। গুরু রবিকার নির্দেশে স্যাঙাত দল সারা দেশ ঘুরে সংগ্রহ করতে লাগলো স্বদেশী জিনিস। দোকানে নাম দেওয়া হল ‘স্বদেশী ভাণ্ডার’ যেখানে স্বদেশী জুতো থেকে মেয়েদের পায়ের আলতা, যাবতীয় জিনিসপত্র রাখা হল। জায়গায় জায়গায় পল্লী সেবা-সমিতি খোলা হল। দেশে প্লেগ দেখা দিলে সকলে মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাতে এসে আবার যোগ দিলেন সিস্টার নিবেদিতা। তারপর ‘মাতৃভাণ্ডার’ নামে শুরু হল ন্যাশনাল ফান্ডের জন্য টাকা তোলার কাজ। ন্যাশনাল ফান্ডের টাকা তুলতে ঘোড়ার গাড়ি ছুটছে কলকাতার এপ্রান্ত ওপ্রান্ত। ভিতরে রবিকাকার দলবল। আর সে গাড়ির ছাদে মস্ত টিনের ট্রাঙ্ক, তাতে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘মাতৃভাণ্ডার’। আশ্চর্য ভাবে দেখা গেল সাদামুখো সাহেব-সুবোরাও বন্দেমাতরম বলে টুপি উঠিয়ে দানপাত্রে দান করতে লেগেছেন। চোরপট্টিতে গিয়ে টাকা জোগাড় করা হল। এক প্রবল বৃষ্টির দিনে খবর এল, রামকেষ্টপুরে কুলিরা মাতৃভাণ্ডারের জন্য অর্থ জোগাড় করেছে, তা নিতে যেতে হবে। সবাই মিলে চলল সে কাজে। চলল মাতৃভাণ্ডারের ট্রাঙ্ক মাথায় নিয়ে ঠাকুরবাড়ির ঘোড়ার গাড়ি।
এইভাবে যখন স্বদেশী আন্দোলনের কাজ চলছে ঠিক সেই সময় প্রোভিন্সিয়াল কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার জন্য ডাক আসল। রবিকা বললেন কনফারেন্সে বক্তৃতা দিতে হবে বাংলায়। রবিকাকার কথা যাঁদের কাছে অভেদ্য বাণী তাঁদের আর পায় কে। যেমন কথা তেমন কাজ। যেই একজন স্টেজে উঠে ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতে শুরু করেছে সঙ্গে সঙ্গে স্যাঙাতরা চিৎকার করে বলতে থাকলেন - বাংলা, বাংলা। বাধ্য হয়ে শেষে সকলকে বাংলায় বক্তৃতা দিতে হয়। অন্য প্রতিনিধিরা তো রেগে লাল। কিন্তু এর পর থেকেই যে কোনও কনফারেন্সে বাংলায় বক্তৃতা দেওয়ার রীতি চালু হয়।
ইঙ্গ বঙ্গ সমাজের পার্টি, শহরের নামী-দামী সমাজের মানুষের সমাগম সাথে ইংরেজ সাহেব ও তাঁদের মেম সাহেবরাও আসবেন। সকলকে যেতে হবে পার্টি পোশাকে। রবিকা ঠিক করলেন পার্টিতে যাওয়া হবে দেশীয় পোশাকে। ধুতি-পাঞ্জাবি, পায়ে শুঁড় তোলা জুতো তাও আবার মোজা ছাড়া। সেই সময় মেমদের সামনে মোজা ছাড়া জুতো পরা অভব্যতা বলা হত। সঠিক সময়ে রবিকা আর তাঁর সাঙাতের দল মানে গগন, সমর ও অবন উপস্থিত হলেন পার্টিতে। সকলের তো চক্ষু ছানাবড়া, পরিচিত বন্ধুরা দূরত্ব বজায় রাখল। কিন্তু কারও মুখে টু শব্দটি নেই। রবিকা ও তাঁর তিন সাঙাত ধুতি পাঞ্জাবিতেই পার্টি মাত করে দিলেন আর দাপিয়ে বেড়ালেন। এরপর থেকে এই পোশাককে দেশীয় পোশাক নাম দেওয়া হল এবং কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনের নিমন্ত্রণ কার্ডে এই পোশাক পরে আসার জন্য নির্দেশ দেওয়া হল।