জহর রায়ের অ্যাক্সিডেন্ট, চম্বলের ডাকাত আর গুপী-বাঘার আজব গপ্পেরা

‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর শুটিং চলছে জয়সলমিরে। ‘ষড়যন্ত্রী মন্ত্রীমশাই’ জহর রায় তখনো আসেননি। কলকাতায় অন্য শুটিং-পর্ব সেরে যোধপুর নেমে সেখান থেকে ট্যাক্সিতে করে তাঁর জয়সলমিরে পৌঁছনোর কথা রাত দশটায়। কিন্তু, এলেন রাত আড়াইটের পর। জানা গেল, মাঝরাস্তায় গাড়ি নাকি উলটে গেছিল। জহর রায় সত্যজিৎকে বললেন- “আরে মশাই—চাঁদনি রাত, ষাট মাইল স্পিডে চলেছি, দিব্যি পিচ ঢালা সোজা রাস্তা, অন্য গাড়ির চলাচল নেই—সর্দারজি ড্রাইভার বাঁ হাত কাঁধের পিছনে রেখে ডান হাতে আপেল নিয়ে তাতে কামড় দিচ্ছেন, স্টিয়ারিং-এ রেখেছেন নিজের ভুঁড়িটা। সেটাকে একটু এদিক ওদিক করলেই গাড়ি এদিক ওদিক ঘুরছে। এমন সময় হুশ করে রাস্তার মাঝখানে পড়ে গেল খরগোশ। তাকে বাঁচাতে গিয়ে গাড়ি গেল উলটে। আমার হুঁশ ছিল, দেখলাম আমি গড়াচ্ছি, আর আমার পাশ দিয়ে গড়াচ্ছে দুটো হোলডঅল। খটকা লাগল—হোলডঅল তো সঙ্গে একটি, অন্যটি এল কোত্থেকে? বুঝলাম ওটি হল আমাদের সর্দারজি।”
দুর্ঘটনার এমন বর্ণনা ফাঁদা একমাত্র জহর রায়ের পক্ষেই হয়তো সম্ভব। যাহোক, দুর্ঘটনায় নাকে সামান্য চোট পাওয়া ছাড়া গুরুতর কিছু ঘটেনি। পরদিন থেকেই জহর রায় নেমে পড়লেন শুটিং-এ। আর, সেই শুটিং-পর্ব জুড়েই কত গল্প।
এই জয়সলমিরেই শুট হয়েছিল হাল্লা রাজার সেনার দৃশ্য। সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে হাজারখানা উট। এই উট জোগাড় করে দিয়েছেন জয়সলমিরের রাজার ভাই কুমার বাহাদুর। আগে চিত্রনাট্যে ছিল হাল্লার সৈন্য হবে অশ্বারোহী। তখনো শুটিং লোকেশন জয়সলমির চূড়ান্ত হয়নি। জয়সলমিরে এসে সত্যজিৎ রায় দেখলেন, এ দেশে ঘোড়া নেই, শুধু উট। ফলে, চিত্রনাট্য বদলাল। শুধু চিত্রনাট্য নয়, তার সঙ্গে বদলাল সৈন্যদের সাজ-সরঞ্জাম। মুম্বই থেকে আনা যুদ্ধের পোশাক শুরুতে গায়ে তুলতেই চাইছিলেন না স্থানীয় উটের সওয়ারিরা। উদ্ভট রঙের পোশাক। দেখে কেউ হাসে, কেউ ছুড়ে ফেলে দেয়। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাদের গায়ে চাপানো হল সৈন্যের পোশাক। শুটিং হল। সাড়ে চার মিনিটের গানের জন্য চল্লিশটার মতো শট। একাধিক ক্যামেরার ব্যবহার। সে যুগের বাংলা ছবির নিরিখে এলাহি কাণ্ড বটে।
এই ‘ওরে হাল্লা রাজার সেনা’ গানের দৃশ্য শুট করতে গিয়েই সত্যজিৎ রায়ের চোখে পড়েছিলেন দুই বংশীবাদক। শওকত আলি আর কর্ণ। সন্ধেবেলা জওহরনিবাসে এসে হাজির দুজনই। ওখানেই রেকর্ড হল দুজনের বাঁশি। শওকত বাজালেন সাতারা। দুটো বাঁশি একসঙ্গে। নিজের বাঁশির সেই রেকর্ড শুনে ভাবুক হয়ে গেলেন শওকত। বললেন, তাঁর ভাই সীমানা পেরিয়ে চলে গেছে পাকিস্তান। যদি এই গান রেডিওতে বাজে, তাহলে ভাই শুনে ঠিক চিনতে পারবে।
আর, আরেক বাঁশি-বাজিয়ে কর্ণ ছিলেন জাতে ভিল। একসময়ের কুখ্যাত ডাকাত। বিরাট চেহারা ছিল তাঁর। কয়েদের রড বাঁকিয়ে জেল থেকে পালিয়েছিলেন দু’বার। তিনবারের মাথায় পুলিশ তাঁকে ধরার পরেই নাকি শরীর থেকে দু’বাটি রক্ত বের করে নেয়। কর্ণ বলেছিল, রক্তই তো মানুষের প্রাণ। সেটা চলে গেলে আর কীই বা পড়ে থাকে! ফলে, এরপর থেকে ক্রমশ রোগা হতে হতে হাড় জিরজিরে হয়ে যান কর্ণ। গোঁফটা একই ছিল। দুপাশে সোজা করলে সাড়ে তিন ফুট। আর ছিল বাঁশি। কর্ণ বাজাতেন নাড়। সাতারার মতো নাড়েরও জন্ম রাজস্থানের সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত গ্রামে। নাড়ে বাঁশির সঙ্গে গলার সুরও লাগত। আর লাগত অফুরন্ত দম। এই দুজনের বাঁশিই সিনেমায় ব্যবহার করেছিলেন সত্যজিৎ।
কর্ণ তো নিজেই ডাকাত ছিলেন, আর একজন ডাকাতদের ডাক্তারের সঙ্গেও পরিচয় হয়েছিল সত্যজিৎ রায়-সহ গোটা ইউনিটের। রাজস্থানের বুঁদিতে শুটিং চলাকালীন জ্বর এল সত্যজিতের। স্থানীয় এক ডাক্তারকে ডাকা হল। কথায় কথায় জানা গেল, তিনি নাকি চম্বল ডাকাতদেরও ডাক্তার। তখন ডাকুসর্দার মান সিং। ডাকাতদলের কারো কিছু হলে সেই ডাক্তারকে চোখ বেঁধে নিয়ে যেত ডাকাতরা। তারপর, চিকিৎসার শেষে ফের চোখ বেঁধে ফেরত দিয়ে যেত যথাস্থানে। সঙ্গে পারিশ্রমিক হিসেবে এক থলি মোহর। তবে, হুমকিও থাকত জবরদস্ত-- মুখ খুললেই বিপদ হবে। এই ডাক্তারের সঙ্গে এমনই ভালো আলাপ জমে যায় সত্যজিতের যে হাল্লা রাজার মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন এই ডাকাত-ডাক্তারের মেয়েই।
‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমা জুড়েই কত অদ্ভুত সব গল্প। সেযুগের বিচারে সিনেমার বাজেটও বিরাট। প্রায় ৫-৬ লক্ষ টাকা। সত্যজিৎ ভেবেছিলেন কিশোর কুমারকে দিয়ে অভিনয় করাবেন গুপীর চরিত্রে। গানও গাওয়াবেন তাঁকে দিয়েই। কিন্তু, ব্যস্ততার কারণে গান বা অভিনয় কিছুই করতে পারেননি কিশোর কুমার। তাঁর বদলে সিনেমার কালজয়ী গানগুলি রেকর্ড করেন অনুপ ঘোষাল। গান রেকর্ড শেষ, লোকেশন দেখাও শেষ—এমন সময়ে পিছিয়ে এলেন প্রযোজক। ধাক্কা খেলেন সত্যজিৎ। এর পরে এগিয়ে এলেন প্রযোজক পূর্ণিমা দত্ত। সিনেমা রিলিজ করল। আর, তারপরের ঘটনা তো ইতিহাস।
সেযুগে স্পেশাল এফেক্ট এত উন্নত ছিল না। বালাই ছিল না ভিএফএক্স-এর। অথচ, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর নানা দৃশ্যকে ফুটিয়ে তুলতে কারসাজি দরকার। সীমিত ক্ষমতার মধ্যেই ম্যাজিক তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ, সিনেমাটোগ্রাফার সৌমেন্দু রায়-রা। ভূতের রাজার বরের দৃশ্যে ব্যাকগ্রাউন্ডে আলোর ঝিকিমিকি তারা তৈরি হয়েছিল দড়িতে আলো বেঁধে। আর, মিষ্টির হাঁড়ি নেমে আসার দৃশ্যে নাইলনের দড়ি দিয়ে হাঁড়ি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নিচের দিক থেকে ক্যামেরা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল হাঁড়ির দিকে। মনে হল, হাড়িগুলোই নেমে আসছে মাটিতে। হাঁড়ি মাটিতে ল্যান্ড করার দৃশ্যটাও আসলে উলটো করে শুট করা। দড়ি দিয়ে কপিকলে লাগানো হাঁড়ি তুলে নেওয়া হল। ক্যামেরা চালানো হল রিভার্সে। সিনেমায় দেখে মনে হল, হাঁড়িগুলো মাটিতে নেমে আসছে আলতো করে। এই একই টেকনিক ব্যবহার করা হয়েছিল হাতে হাতে তালি দেওয়ার পর গুপী-বাঘার শোঁ করে উড়ে যাওয়ার দৃশ্যেও। উঁচু মাচা থেকে লাফ দিল গুপী-বাঘা। ক্যামেরা চলল রিভার্সে। আর, দর্শক দেখলেন গুপী-বাঘা আকাশে উড়ে গেল। এমনই এক দৃশ্যের শুটিং হয়ছিল সিমলার কাছে, কুফরিতে। সেখানে বরফে হারিয়ে গেল গুপী-বাঘার নক্সা আঁকা চটি। ভাগ্যিস আরেক জোড়া আগে থেকেই বানিয়ে রেখেছিলেন সত্যজিৎ।
গুপী গাইন বাঘা বাইনের গল্প বলতে গেলে শেষ হওয়ার নয়। বোড়ালে বাঘ নিয়ে শুটিং-এর গল্প, মাটিতে এসে পড়া মিষ্টির হাঁড়ি থেকে মিষ্টি খাওয়ার গল্প, দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরের কত গল্প। আসলে, এই সিনেমা এমনভাবেই জড়িয়ে নিয়েছে আমাদের, যে সিনেমার সঙ্গে জড়িত সব কিছুকেই আমাদের অধিকারের গল্প বলে মনে হয়।
দেখতে দেখতে পঞ্চাশ বছরে পা দিল ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’। আমাদের বিস্ময়ের নেশা এখনো ফুরোলো না।