আড়াইশো বছরের ইতিহাস নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনের মহাবটবৃক্ষ

শীতের ছুটিতে বাঙালির অন্যতম গন্তব্য শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেন। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে প্রচুর মানুষ এখানে ভিড় করেন সারা বছর। কেউ আসেন নেহাত বেড়ানোর আনন্দে, কেউ আসেন বিচিত্র সব গাছপালা দেখতে। যাঁরা উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করেন, তাঁদের খুব প্রিয় জায়গায় এই উদ্যান।
ভারতে তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন। ১৮৮৭ সালে উদ্যানটি প্রতিষ্ঠা করলেন কোম্পানিরই এক সেনা আধিকারিক, নাম কর্নেল রবার্ট কিড। তিনি ছিলেন শখের উদ্ভিদবিদ। তাঁর ইচ্ছে ছিল, একটা উদ্যান তৈরি করে সেখানে চা, চন্দন, কফি, তামাক, নীল, দারুচিনি, ঢাকা কটন ইত্যাদি চাষ করবেন। হুগলি নদীর তীরে কলকাতার অপর পারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁকে উদ্যান স্থাপন করতে অনুমতি দেয়। উদ্যানের নাম হয় ‘The Hon’ble Company’s Botanic Garden’। কিড হলেন বোটানিক্যাল গার্ডেনের সাম্মানিক সুপারিন্টেনডেন্ট। এই উদ্যানকে স্থানীয় মানুষ ‘কোম্পানির বাগান’ বলে ডাকত।
তবে কিডের যে উদ্দেশ্য ছিল তা সফল হয়নি। কারণ, তিনি চেয়েছিলেন মূলত বিষুব জলবায়ুর উদ্ভিদ চাষ করতে, কিন্তু, সেই গাছপালাগুলো ভারতের ক্রান্তীয় পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারেনি। কিড তারপর ইউরোপীয় গাছপালা আনেন, কিন্তু, সেগুলোরও পরিণতি একই রকম ঘটে। কিডের পর বোটানিক্যাল গার্ডেনের সুপারিন্টেনডেন্ট হলেন উইলিয়াম রক্সবার্গ। তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে জন হোপের কাছে উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন এবং ডক্টর অফ মেডিসিন ডিগ্রির অধিকারী ছিলেন। রক্সবার্গ দূরপ্রাচ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারতের নানা অঞ্চল থেকে প্রচুর গাছপালা এনে বোটানিক্যাল গার্ডেনে তৈরি করেন হার্বেনিয়াম। তিনি প্রশিক্ষিত চিত্রশিল্পীদের দিয়ে প্রচুর ভারতীয় উদ্ভিদের ছবি আঁকানোর ব্যবস্থা করেন, যেগুলো উদ্ভিদবিদ্যার গবেষণায় কাজে লাগত। জর্জ কিং ছিলেন বোটানিক্যাল গার্ডেনের শেষ সুপারিন্টেনডেন্ট। তার সময়ে সুপারিন্টেনডেন্ট নামটির বদলে কিং ও তাঁর উত্তরসূরীদের ডিরেক্টর বলে ঘোষণা করে সরকার। ১৮৮৭ সালে স্থাপিত হয় বোটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, যার সদর দপ্তর হয় এই বোটানিক্যাল গার্ডেন। ১৯৩৭ সালে গার্ডেনের প্রথম ভারতীয় ডিরেক্টর নিযুক্ত হন কালীপদ বিশ্বাস।
রানি ভিক্টোরিয়ার শাসনে উদ্যানটির নাম হয়েছিল রয়্যাল ইন্ডিয়ান বোটানিক্যাল গার্ডেন। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৬৩ সালে তার নাম রাখা হল ইন্ডিয়ান বোটানিক্যাল গার্ডেন। ২০০৯ সালে আবার গার্ডেনের নাম পাল্টে গেল। কিংবদন্তি বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র বসুর জন্ম সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষ্যে তার নাম রাখা হল আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু বোটানিক্যাল গার্ডেন। এই উদ্যানটি এখন ভারত সরকারের বোটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অধীনে রয়েছে। তবে, বোটানিক্যাল গার্ডেনের পরিচালক পর্ষদের প্রশাসনিক সভায় পশ্চিমবঙ্গে সরকারের প্রতিনিধিরাও যোগ দিয়ে থাকেন।
বোটানিক্যাল গার্ডেনে আছে শাল, শিমূল, সেগুন, বট, অশ্বত্থ, মেহগনি, লবঙ্গ, জায়ফল, এবং আরও অনেক অনেক রকমের গাছ। ঔষধি গাছও আছে প্রচুর। তবে গার্ডেনের প্রধান আকর্ষণ ২৫০ বছরেরও বেশি পুরোনো বিশাল মহাবটবৃক্ষ। জানা যায়, একটি খেজুর গাছের মাথায় বট গাছটির বীজ পড়েছিল কোনোভাবে। খেজুর গাছের ওপরই তারপর বটগাছ জন্মায়, বেড়ে উঠতে থাকে, বিশাল আকারের হয়ে ওঠে। বটগাছের শাখাপ্রশাখা আর জুড়ির ফাঁসে মারা যায় সেই খেজুর গাছ। এখন প্রায় ৫ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত বটগাছের সাম্রাজ্য। ১৮৬৪ এবং ১৮৬৭ সালের ঘূর্ণিঝড়ে গাছটির কিছু হয়নি। শত শত ঝুরি নিয়ে এখনও সে যথেষ্ট প্রাণবন্ত।
তথ্যঋণ – সুপ্রকাশ চক্রবর্তী, প্রিয়দর্শী বন্দ্যোপাধ্যায়।