No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    শুধু উঁচু মাপের অভিনেতা নয়, বড়ো মনের মানুষ ছিলেন তরুণ কুমার

    শুধু উঁচু মাপের অভিনেতা নয়, বড়ো মনের মানুষ ছিলেন তরুণ কুমার

    Story image

    জাতশত্রু বলতে যাকে বোঝায়, তিনি হলেন তরুণ কুমার চ্যাটার্জি ওরফে ‘তরুণ কুমার’। যেকোনও মানুষের সঙ্গেই তাঁর সুমধুর সম্পর্ক ছিল। অন্য অনেকের মতোই আমি তাঁকে ডাকতাম তাঁর ডাকনাম ধরে-‘বুড়োদা’ বলে। আমার কাছে তিনি প্রকৃত অর্থেই ‘মাই ডিয়ার’ লোক ছিলেন। ওরকম সংযমী, ‘ব্যারিটোন ভয়েস’ অথচ দিলদরিয়া লোক খুব কম দেখেছি। এই লেখায় বুড়োদার কথা যেমন বলবো, বলবো তাঁর কাছের মানুষদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা, স্মরণীয় কিছু ঘটনা – তবেই না চেনা যাবে অবিস্মরণীয় এই অভিনেতাকে! 

    বুড়োদা মজার মানুষ ছিলেন, খুব মজা করতেন। সিনিয়র অভিনেতাদের যেমন শ্রদ্ধা করতেন, তেমন দুষ্টুমিও করতেন। কখনও উৎপল দত্ত, কখনও তুলসী চক্রবর্তীকে কোনও একটি বিষয় নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে, ক্ষেপিয়ে দিয়ে সরে পড়তেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ছোটো ভাই সুরকার অমল মুখোপাধ্যায় তাঁর খুব বন্ধু ছিলেন। আমি তখন একটি জনৈক সংবাদপত্রে চাকরি করি, সিনেমা বিভাগে লেখালিখি করতাম। উনি প্রায়ই আসতেন। একবার সেই সংবাদপত্রেরই পুজো সংখ্যায় ‘উত্তম কুমারের প্রিয় তারকারা’-এই বিষয়ে একটি লেখা তৈরি করতে বলা হয়েছিল। তো সেই ব্যাপারে বুড়োদার সাহায্যের দরকার পড়লো। উত্তম কুমার গত হয়েছেন খুব বেশিদিন হয়নি। অফিসের ভিতর বুড়োদার সঙ্গে উত্তম কুমারকে নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলছি। বুড়োদা বেশ লম্বা চওড়া ছিলেন, কীভাবে যেন ওঁর মাথাটা দরজায় ঠোকা খেয়ে বিশ্রী ভাবে ফুলে গেল। আমি জল-বরফ ইত্যাদি দিলাম। সেসব নিয়ে তাঁর হেলদোল নেই, আমাকে বললেন, ধুর ছাড়ো তো... যে কাজটা করতে এসছি সেটা করি আর চলো ক্যান্টিন থেকে মাংসের চপ খাই। বুড়দা এমনিতে খেতে খুব ভালোবাসতেন তার ওপর আমাদের অফিস-ক্যান্টিনের মাংসের চপ খুব বিখ্যাত ছিল। যাই হোক, যেটা বলার তা হলো অত বড়ো অভিনেতা হয়েও বিন্দুমাত্র অহমিকা ছিল না তাঁর। সবার সঙ্গে মিশতে জানতেন। অফিস বা ক্যান্টিনের আর পাঁচটা লোক যখন অবাক হয়ে তাঁকে দেখতো তিনি বলতেন, “কী এমন করেছি আমি, তোমরাও খেটে খাও, আমিও তাই।” 

    প্রেম-পরিণয়

    তরুণ কুমারের জন্মদিন অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারি দিনটি তাঁর পরিবারের কাছে যেমন আনন্দের, তেমন বেদনারও। ২০০৩ সালের ২৭ অক্টোবর তিনি প্রয়াত হন। তার ঠিক ৪ মাস পর ২৪ ফেব্রুয়ারি মারা যান তাঁর স্ত্রী সুব্রতা চটোপাধ্যায়। অদ্ভুত ব্যাপার। স্বামী-স্ত্রী’র টান ছিল মারাত্মক। তাঁদের কীভাবে শুভ পরিণয় হয়েছিল, সে বিষয়েও দু-চার কথাও বলা যাক। তখন বিশ্বরূপা-তে ‘ক্ষুদা’ নামে একটি বিখ্যাত নাটক চলছিল। কালী ব্যানার্জি, তরুণ কুমার, সুব্রতা চ্যাটার্জি অভিনয় করেছিলেন। সকলেই তখন ‘স্ট্রাগলার’। সেই সময়ই পাশের ‘রংমহল’-এ চলছিল বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের একটি নাটক। নাটক শেষে প্রায়দিনই তরুণ, সুব্রতাদের গাড়িতে তুলে নিতেন বিশ্বজিৎ। একদিন বিশ্বজিতের গাড়িতে যেতে যেতে সুব্রতার অনুপস্থিতিতে তাঁকে মনের কথা জানালেন বুড়োদা। বললেন, তিনি একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছেন, বিয়ে করতে চান তাকে। তাঁর সঙ্গেই থিয়েটার করে সে। বিশ্বজিৎ শুনে বললেন, বাড়িতে বলেছিস? বুড়োদা তখন মুখ কাঁচুমাচু বলেন, “কী করে বলবো, মা-বাবা-দাদা কী বলবে, ভয় লাগছে”। বন্ধু বিশ্বজিৎ তাঁকে ভরসা দিলেন, “আরে ভয় পাচ্ছিস কেন, আমরা তো আছিই।” পরবর্তী সময়ে সকলের মত নিয়ে শুভ পরিণয়ে আবদ্ধ হন তরুণ-সুব্রতা।

    স্নেহছায়ায়

    সুধীর মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘দাদাঠাকুর’ সিনেমার কথা। ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় ছবি বিশ্বাস ছাড়াও ছিলেন তরুণ কুমার, বিশ্বজিৎ চ্যাটার্জি, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সুলতা চৌধুরী, ছায়া দেবী। ভাগলপুরে আউটডোর শুটিং হয়েছিল। সেখানে অভিনেতাদের আলাদা আলাদা কোনও ঘর ছিল না। মহিলারা বাদে সকলে একঘরে মেঝেতে বিছানা করে মশারি খাটিয়ে শুতেন। ছবি বিশ্বাসের হাঁপানির সমস্যা ছিল, রাতে ঠিকমতো ঘুম আসতো না। বুড়োদাকে নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসতেন। হয়তো মশারির ভিতর থেকে পা বেরিয়ে গেছে, ছবিবাবু বুড়োদার পা মশারির ভিতর ঢুকিয়ে মশারিটা ভালো করে টেনে দিতেন। গায়ে আলতো করে চাদর ঢেকে দিতেন। শুধু ছবি বিশ্বাস নন, বয়োজ্যেষ্ঠ বহু অভিনেতাই তাঁকে স্নেহ করতেন।

    সুগারের প্রকোপে খুব ভুগতেন শেষ দিকে। একবার উত্তম মঞ্চেই, আমি আর বুড়োদা গল্প করছি, হঠাৎ খেয়াল হল বুড়োদা ঘুমিয়ে পড়েছেন। হাতের জলন্ত সিগারেটটা পুড়তে পুড়তে দু আঙুলের মাঝে এসে প্রায় ছ্যাঁকা দিতে যাবে, এমন সময় আমি তাঁকে ডেকে দিই।

    বাবা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিন ভাই - উত্তম, তরুণ, বরুণ (ডান দিক থেকে)

    ‘রমা’দির সঙ্গে

    উত্তম কুমার ‘ইন্দ্রাণী’ ছবির সেটে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে তাঁর আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। তখন উত্তম-সুচিত্রার ‘গৃহদাহ’ ছবির শুটিং চলছে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন সুবোধ মিত্র। বিভিন্ন জায়গায় শুটিং হয়েছিল। মধ্যমগ্রামের কাছাকাছি একটি জায়গাও শুটিং স্পট হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। সেই শুটিং স্পটে পৌঁছাতে গেলে একটি ছোটো খাল পেরোতে হতো। তরুণ কুমারের উপর দায়িত্ব পড়েছিল মিসেস সেনকে সেই জায়গা সুরক্ষিত ভাবে পৌঁছে দেওয়ার। সেই মতো প্রতিদিন সুচিত্রা সেনের গাড়ি এসে দাঁড়াতো একটা নির্দিষ্ট জায়গায়, সেইখান থেকে একটা নৌকায় করে তরুণ কুমার তাঁকে নিয়ে যেতেন শুটিং স্পটে। এই যাত্রাপথে একটি পেয়ারা গাছ পড়ত। প্রায় প্রতিদিনই লাফ দিয়ে গাছ থেকে পেয়ারা পাড়ার চেষ্টা করতেন মিসেস সেন। এহেন ছেলেমানুষী দেখে তরুণ কুমার আওয়াজ দিয়ে বলতেন, “রমাদি এভাবে লাফালাফি করো না, বেসামাল হলে কিন্তু সোজা জলে... শুধু তাই নয় চুরির অপরাধে...”

    “তুই চুপ কর তো বুড়ো, দু-একটা পেয়ারা ছিঁড়লে তাকে চুরি বলে না।” বলেই দু-চারটে পেয়ারা ছিঁড়ে নিতেন মিসেস সেন। 

    সেই ‘চুরি’র পেয়ারা কিন্তু দুজনেই ভাগ বাটোয়ারা করে খেতেন পরে। এরকমই ছিল দুজনের সম্পর্ক। বুড়োদা আমাকে রমাদির এই ছেলেমানুষী ব্যাপারগুলো নিয়ে প্রায়ই বিভিন্ন আখ্যান শোনাতেন।

    দাদার সঙ্গে

    উত্তম ছিলেন ভাই অন্তঃপ্রাণ। মেজো ভাই বরুণ আর ছোটো ভাই তরুণকে চোখে হারাতেন। ভাইরাও দাদা বলতে অজ্ঞান। ছোটো ভাইটি তো আবার তাঁর সঙ্গে অভিনয়ে ভিড়ে গেল। দুজনে একসঙ্গে অভিনয়ের পাঠ নিয়েছিলেন। ভবানীপুরে সুনীল সমাজ নামে একটি নাট্য গোষ্ঠী ছিল। দুই ভাই মিলে লুকিয়ে লুকিয়ে তাদের রিহার্সাল দেখতেন। এইভাবেই শুরু।

    নাট্য মঞ্চেই ওঁর অভিনয়ে হাতেখড়ি। ‘নতুন প্রভাত’ নাটকে ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। বিদেশের একাধিকবার নাটক করতে গিয়েছেন।

    ১৯৫৪ সালে উত্তমকুমার অভিনীত সেই ‘হ্রদ’ ছবিতেই প্রথম আত্মপ্রকাশ তরুণ কুমারের। তারপর একের পর এক ছবিতে অভিনয়ের দাপটে, সূক্ষতায়, মুন্সিয়ানায় তিনি অদ্বিতীয় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ‘দেয়া নেয়া’, ‘স্ত্রী’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘কাল তুমি আলেয়া’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ‘কমললতা’, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘সপ্তপদী’—অসংখ্য ছবিতে কাজ করেছেন, যার বেশিরভাগই দাদা উত্তমের সঙ্গে। পর্দায় দুজনের অসাধারণ রসায়ন বা ‘ম্যাজিক’-ই এর একমাত্র কারণ। ‘দাদাঠাকুর’ ছবিতে অভিনয় করে তো রাস্ট্রীয় পুরস্কারও পেয়েছিলেন। অভিনয় করার সময় এমন এমন কিছু করে ফেলতেন যে মহানায়কও বলতেন, “বুড়োর সঙ্গে অভিনয় করতে গেলে আমি ভীষণ ঘাবড়ে যেতাম। মানে, আমি আগে থেকে একটা বিষয় ভেবে রাখলাম এভাবে এভাবে করবো কিন্তু, ও তো সবটা ঘুরিয়ে দেয়”।

    তবে, অভিনয় জীবন আর ব্যক্তিগত জীবন আলাদা রাখতেন যতটা সম্ভব। শুটিং ফ্লোরের জুতো বাড়ির বাইরে খুলে রেখে ভেতরে প্রবেশ করতেন। অভিনয় নিয়ে বাড়িতে কোনও রকম আলোচনা করতেন না, কাউকে করতেও দিতেন না। ছেলেমেয়েকে নিয়ে অতিচিন্তিত থাকতেন সবসময়। পড়াশোনার দিকে কড়া নজর রাখতেন। বন্ধুদের খুব ভালোবাসতেন। দাদার নামে যে মঞ্চ, সেই উত্তম মঞ্চের দেখাশোনা করতেন একসময় একা হাতে। সুগারের প্রকোপে খুব ভুগতেন শেষ দিকে। একবার উত্তম মঞ্চেই, আমি আর বুড়োদা গল্প করছি, হঠাৎ খেয়াল হল বুড়োদা ঘুমিয়ে পড়েছেন। হাতের জলন্ত সিগারেটটা পুড়তে পুড়তে দু আঙুলের মাঝে এসে প্রায় ছ্যাঁকা দিতে যাবে, এমন সময় আমি তাঁকে ডেকে দিই। জীবনের শেষ দিকে তাঁর সঙ্গে খুব একটা দেখা হত না। বুড়োদা একজন বড়ো মাপের অভিনেতা ছিলেন শুধু তাই নয়, বড়ো মনের মানুষ ছিলেন।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @