No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    অজানা কলকাতার গল্প বোনে সেইসব কবরেরা

    অজানা কলকাতার গল্প বোনে সেইসব কবরেরা

    Story image

    ঠাকুমা গোটা হেমন্তকাল জুড়েই একটা ছোটো মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখত বারান্দায়। আকাশপ্রদীপ। এই হেমন্তকালে নাকি পূর্বপুরুষেরা আশমান থেকে মাটিতে নামে। অন্ধকার সন্ধ্যায় তাদের আলো দরকার। কলকাতারও তো পূর্বপুরুষ আছে। তারাও কি নেমে দাঁড়ায় উত্তরপুরুষের শহর দেখতে? অবশ্য, তাঁরা কি আকাশে থাকে না মাটিতে? লালমুখো সাহেবদের হাতে গড়া এই শহরের মাটিতে ঘুমিয়ে আছেন দেশ ছেড়ে আসা কত্ত মানুষ। কেউ রোগে ভুগে হুট করে, কেউ বা ভালোবেসে স্বেচ্ছায় চিরশায়িত এখানে। কেউ হয়তো দেশ ফিরবেন বলে অপেক্ষা করতে করতেই মারা গেছেন। ফেরা হয়নি। তাঁদের গুম হয়ে থাকা সাবেক কান্না, এপিটাফ, এক-এক কবরের এক এক স্থাপত্যের গল্প-- কলকাতার কবরখানারা সবাইকে আশ্রয় দিয়েছে বুকের মাটিতে। পার্কস্ট্রিটের বিখ্যাত গোরস্থানের বাইরেও এমন কত কবরখানা অজানা অতীতের কান্না চেপে দাঁড়িয়ে আজো। 

    হেমন্তের দুপুরে ভূতে পাওয়ার মতো সেইসব শুনতে সাধ হয়। বেরিয়ে পড়ি। 

    ‘ডালহৌসি, ডালহৌসি, হাওড়া স্টেশন’ হাঁকতে হাঁকতে একটা মিনিবাস সামনে এসে দাঁড়ায়। ভিড় প্রায় নেই। ছুটির দিন। হুসহুস করে বাস এগোচ্ছে। দুপুরবেলায় যেন মধ্যরাত নেমে এসেছে।লোকজন নেই, ফেরিওয়ালা নেই। খানিক আশ্চর্য যে লাগছিল না, তা নয়।

    রাজভবনের সামনে বাস থেকে নামলাম। সেন্ট জন গির্জায় যখন ঢুকলাম, তখন বাজে সাড়ে তিনটে। ঢোকার মুখে একজন গার্ড। আমায় দেখে মোটেই খুশি হননি তিনি। অযথা দুপুরের ঢুলুনিতে জলজ্যান্ত ব্যাঘাত। টিকিট কেটে ঢুকলাম। বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে হলদে রঙের গির্জা। থেকে-থেকে প্রাচীন ঘন্টার গম্ভীর ধ্বনি। কোন সময়কে সে জানান দেয়? কারা জাগে সেই ‘ঢং’ শব্দে?

    রোহিলা যুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ

    গির্জার সামনের দিকে আসতেই সেই প্রশ্নের বেশকিছু সমাধা দেখলাম। প্রথমে চোখে পড়ল রোহিলা যুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ। তার গায়ে ফলকে লেখা স্মরণীয়দের নাম। ডানদিকে একটি সরু রাস্তা। সামনে বোর্ড, ‘জব চার্নকের সমাধি’। সেদিকেই যাব। তার আগে একবার বাঁদিকটা ঘুরে নিলাম।

    অন্ধকূপ হত্যার স্মৃতিস্তম্ভ

    সার-দেওয়া মৃতের বাসভূমি নিভে-আসা আলো লেগে আছে সাদা কবরগুলোয়। অদূরেই কুখ্যাত ‘অন্ধকূপ হত্যার’ স্মৃতিসৌধ। শ্বেতপাথরের ফলকে ফলকে মৃতদের নাম। ১৭৫৬তে সিরাজের কলকাতা আগমনের চিহ্ন। বিশাল একটা চূড়া। ফলকগুলির ওপরে খোদাই করা কয়েকড়ি শিশুর মুখ। জানি না কেন মনে হল, প্রতিটি মুখই যেন ভ্রুকুটি করে আছে। যেন ভেতরে একটা  চাপা রাগ। সৌধটির চারপাশের গাছপালা বেশ ঘন।পা ডুবে যাচ্ছিল ঘাসে।

    হালকা ঠান্ডা হাওয়া বইছে তখন। ঘন্টার আওয়াজ, পায়রার বকম-বকম ডাক ছাড়া আর একটিও শব্দ নেই। লোক তো নেই-ই। সেই অবসিত বেলায়, নির্জনতায়, গাছপালায় ঘেরা কবরভূমিতে অস্বীকার করব না, গায়ে কাঁটা দিতে শুরু করল। মনে হল, মৃতদের উপত্যকায় আমি একমাত্র জীবিত এসে দাঁড়িয়েছি। অনাহূত।

    চলে যেতে চাইলেও ওই সরু রাস্তাটায় না ঢুকে পারলাম না। রাস্তাটা সোজা উঠে গেছে জব চার্নকের সমাধির সামনে। একটা আলাদা কম্পাউন্ড। দুপাশে আরো বেশ কিছু কবর। কাঠগোলাপের গাছ থেকে ফুল ঝরে পড়েছে মাটিতে। মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে চার্নক সাহেবের সমাধি। গ্রিক মন্দিরের আদলে তৈরি সাদা দেওয়াল। দুখানা গম্বুজ। আর সরু সরু খিলানপথ। আর, তার উত্তরকোণে আরেকটি কবর।তিনি ফ্রান্সিস জনসন বা বেগম জনসন। সমাধির গহনে কালো ফলকে লেখা তার পরিচিতি “...oldest British resident in Bengal, universally beloved, respected and revered.”

    আশ্চর্য চরিত্র বটে এই বেগম জনসন। ১৭২৫-১৮১২-- সুদীর্ঘ জীবন বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ঠাসা। ফেয়ারলি প্লেসের এই বেগম নাকি মোট চারবার বসেছিলেন ছাঁদনাতলায়। এডওয়ার্ড ক্রুকের দ্বিতীয় কন্যা ফ্রান্সিসের প্রথম স্বামী কলকাতার গভর্নর থমাস ব্রাডলির ভাইপো পার্পল টেম্পলার। কিন্তু স্বামী ও দুই সন্তানের মৃত্যু হয় অচিরেই। দ্বিতীয় স্বামী জেমস এলথাম। বিবাহের বারোদিনের মাথায় তাঁরও মৃত্যু গুটিবসন্তে।

    একলা ফ্রান্সিস কিন্তু থামেননি তারপরেও। ১৭৪৯-এ তিনি ফের বিয়ে করেন কাশিমবাজারের কুঠিয়াল উইলিয়াম ওয়াটসকে। জন্ম হয় তিন সন্তান এমেলিয়া, এডওয়ার্ড ও সোফিয়ার। কিছুকাল পরেই সিরাজের আক্রমণে স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ। স্বামী গ্রেপ্তার আর সন্তানসহ ফ্রান্সিসের স্থান হয় সিরাজের হারেমে। টানা ৩৭দিন পরে সেখান থেকে মুক্তি মেলে সিরাজের মাতামহীর করুণায়। তাঁর বেগম নামকরণ তখন থেকেই।এই দিনগুলির বিস্তৃত অভিজ্ঞতা নাকি রসিয়ে গল্পের মতো বলতেন তিনি ফেয়ারলি প্লেসের প্রাসাদে, অতিথিদের কাছে।

    পলাশির যুদ্ধের পর বেগম ও তাঁর স্বামী ওয়াটস চলে যায় ইংল্যান্ড। ওয়াটসের মৃত্যুর কিছুকাল পরে বেগম ফেরেন তাঁর চেনা শহরে, কলকাতায়। বেগমের এ আসলে ঘরে ফেরা। ১৭৭৪-এ ফের বিবাহ। সেন্ট জন চার্চের বিশপ রেভারেন্ড উইলিয়াম জনসনকে। ফ্রান্সিস বেগম হয়ে ওঠে বেগম জনসন। আবারও বিচ্ছেদ। তাতে অবশ্য দুঃখী ছিল না বেগম। প্রেমিক, জীবন-পিয়াসী এই নারী মৃত্যু পর্যন্ত মেতে ছিলেন গল্পে-আড্ডায়-মজলিসে। তাঁর প্রাসাদে নিত্য বসত খানাপিনার আসর। তাঁর স্বামীরা, সন্তান, দৌহিত্র— প্রত্যেকেই ছিলেন বিখ্যাত মানুষ। তাই ফ্রান্সিসও চিরকাল পেয়েছেন এ শহরের ব্রিটিশদের সম্মান ও বন্ধুতা।

    সমাধিফলকের গায়ে মৃতা এই নারীর অফুরান জীবনীশক্তির কথা খোদাই করা। নবাবি আমল, কোম্পানির সূর্যোদয় সমস্তকিছুর প্রত্যক্ষসাক্ষী।

    চার্নকের সমাধি

    বেগমজানের সমাধি ছেড়ে এবার ঢুকলাম চার্নকের সমাধিগৃহে। চার্নকের জীবনেও গল্পের শেষ নেই। পাটনায় সতী হতে চলা এক নারীকে উদ্ধার করে বিয়ে করেন চার্নক। নাম রেখেছিলেন মারিয়া। ১৬৯২-তে (মতান্তর ১৬৯৩) মৃত্যুর পর প্রেমিক চার্নককে সমাধিস্থ করা হয় স্ত্রীর পাশেই।এই সেন্ট জন গির্জার অঙ্গনে পাশাপাশি শুয়ে আছেন দুজনেই। চার্নক নাকি এমনিতে ছিলেন বেশ বদখৎ স্বভাবের লোক। নেটিভদের অত্যাচার করে জম্পেশ মজা পেতেন। বউবাজারের কাছে ঘুরতে ঘুরতে মসলিনের ঢলা জামা-পাজামা পরা চার্নক নাকি গ্রাম্য মানুষদের কাছে হুঁকো চেয়ে চেয়ে খেতেন। আদ্যন্ত ব্যবসায়ী, অত্যাচারী, কলোনিয়াল নগর কলকাতার জন্মদাতা চার্নক যে কীভাবে নতজানু প্রেমিক হলেন, তা এক রহস্য। বিয়ের পরে বউকে কাছ-ছাড়া করতেন না মোটেই। মৃত্যুর পরেও করতে চাননি।

     চার্নকের সমাধির ভিতরে

    ওখানে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, কফিনের আগল ভেঙে তাঁরা কি আজও মেতে ওঠেন না খোশগল্পে? রাস্তার শেষ পথিকটিও ঘরে ফিরে গেলে জাগে না কি তাঁরা, একবারও? চার্নকের অন্ধকার সমাধিতে কালো ফলকের ওপর সাদা দিয়ে লেখা জীবনী। ল্যাটিন ভাষায়। মোবাইলের আলো জ্বেলে দেখছি সেসব। গোটা শরীর তখন বেশ শীতল হয়ে গেছে। কিন্তু বেরোবো যে, শক্তি পাচ্ছি না। সমাধির ভেতরটা আরো চুপ।পাখির ডাকও নেই। পাতা খসার শব্দ নেই। ফুলের গন্ধ নেই।

    হঠাৎই গমগম করে উঠল সেই ঘর—"Did you find the grave...?”

    মনে হল হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে যাবে এক্ষুনি। জিভ আড়ষ্ট হয়ে গেছে। পা নড়ছে না। গির্জার ঘন্টায় ঘোর কাটিয়ে ফিরে দাঁড়ালাম।

    কবরের সারি

    নিশ্চিন্তি! জ্যান্ত মানুষ। ডিএসএলআর ঝোলানো চশমা পরা এক বুড়ো সাহেব। চার্নকের খোঁজে এসেছে সে। সঙ্গে তার মেম। নিজের বোকামিতে তখন নিজেই হাসছি। দু চারটে শব্দ বিনিময় করে গির্জাপ্রাঙ্গণ ছেড়ে বেরোলাম।

    সন্ধে নেমেছে। কিচিরমিচির শব্দ তুলে পাখির দল বাসায় ফিরছে এবার। ওয়েলেসলি প্যালেসের কাছে সিগনালে দাঁড়ানো বাসে দৌড়ে গিয়ে উঠে পড়লাম। ভিড় থাকায় বসার জায়গা পাইনি ঠিকই। কিন্তু ভিড় দেখে কী যে আনন্দ হয়েছিল তখন।

    Tags:

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @