ফটোগ্রাফির দুনিয়ায় দেখা ফ্রেম ও প্রেম – আড্ডায় চারজন আলোকচিত্রী

টুকরো আলোর মাঝে ছায়াময় পথ চেয়ে থাকা। এ এক দীর্ঘ পথ। পরতে পরতে রচনা হবে দেখার ফ্রেম। দুই বাংলা জুড়ে এমনভাবেই ছড়িয়ে আছেন অসংখ্য আলোকচিত্রী। কিন্তু শিল্পচেতনা নিয়ে ভাবেন ক’জন? ফটোগ্রাফির ঠিক এই মুহূর্তের অবস্থা কীরকম? গ্রামের মানুষ কি এখনও শিল্প থেকে ছন্নছাড়া? কীভাবে রচিত হতে পারে এক একটি ফ্রেম? এইসব নিয়েই জমেছিল আড্ডা। উদ্দেশ্য ‘ছবিমহল’-এর ৫০তম পর্ব। এই বিশেষ পর্বে সুমন সাধু’র সঙ্গে আড্ডা জমালেন চার আলোকচিত্রী। কলকাতার তীর্থেন্দু ব্যানার্জী, দঃ চব্বিশ পরগনার শুভজিৎ নস্কর ও প্রতীক দে চৌধুরী এবং বাংলাদেশ ঢাকার রাসেল রণি। আড্ডা জুড়ে রইল তাঁদেরই তোলা কয়েকটি ছবি। উঠে এল গুরুত্বপূর্ণ সব প্রশ্ন।
সুমন- আমার প্রথম প্রশ্ন প্রত্যেকের জন্য। একজন আলোকচিত্রীকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, ফটোগ্রাফি তোমাদের কোন বিশেষ জিনিসটা দিতে পারছে, যা দু-একটা লাইনে বলতে হবে। কার কী উত্তর হবে?
শুভজিৎ- ফটোগ্রাফি নিজের মনের কথা প্রকাশ করার একটা মাধ্যম। আমি রাজনীতি করি, রাজনীতির সঙ্গে শিল্পের একটি ঘনিষ্ঠ যোগ আছে বলে বিশ্বাস করি। ছবির একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকে, সেটা প্রকাশ করতে পারি এবং কোথাও গিয়ে নিজের মনের খোরাক, নিজের ভালোলাগা। আর রাজনীতির প্রথম শর্ত হল, মানুষের কাছে পৌঁছানো। ছবিরও সেই একই শর্ত। অন্তত আমি যে ধরনের ছবি করি।
রাসেল- সত্যি বলতে ফটোগ্রাফিতে যা পেয়েছি, তা আমি আমার পুরো জীবনে পাইনি। অল্প সময় ধরে ছবি তুলছি। এই অল্প সময়ে মানুষের কাছে যতটা যেতে পেরেছি, তা প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। ছোটোবেলায় ক্রিকেটার হবার ইচ্ছা ছিল। খুব খারাপ খেলতাম না। তবে ফ্যামিলি সাপোর্ট পাইনি বলে বেশি কিছু করতে পারিনি। তারপর ফটোগ্রাফি শুরু করলাম।
প্রতীক- এই উত্তরটা এক-দুই লাইনে দেওয়া মুশকিল। এই শিল্প মাধ্যমটা নিজেকে প্রকাশ করার স্বাধীনতা দিয়েছে, জীবনটাকে একটু অন্যরকম ভাবে দেখতেও শিখিয়েছে। আনন্দ দিয়েছে, দুঃখও দিয়েছে। তবে ইদানীং আমাকে বেশি ভাবাচ্ছে, আমি ফটোগ্রাফিকে কী দিতে পারছি।
শুভজিৎ- প্রতীকের শেষ কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
তীর্থেন্দু- শুভজিতের সঙ্গে একমত অনেকটাই। বিশেষ করে রাজনীতি বিষয়ে। এছাড়া ছবি আমায় একটা জগৎ দেয়, যেখানে থাকতে আমি পছন্দ করি। একটা শান্তিও দিচ্ছে আবার অশান্তিও। দাঁড়ানোর জায়গাও দিচ্ছে আবার বৃষ্টিও। সব মিলিয়েই আর কী ছবি রয়েছে৷
প্রতীক- ইংরেজিতে বহুল প্রচারিত একটা কোটেশন আছে “আর্ট ফর আর্ট’স সেক”। তবে এখন আমার মনে হয়, একটা শিল্পর মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলার, পরিবর্তন আনার ক্ষমতা থাকাটা জরুরি। এখন ছবি তুলছি না বেশ কিছুদিন হল। কারণ একটা প্রশ্ন ক্রমাগত আমাকে তাড়া করছে। আমার ছবি আশেপাশের মানুষগুলোর জীবনে কি কোনো প্রভাব ফেলেছে? যদি না ফেলে তাহলে কেন ছবি তুলব?
প্রতীক দে চৌধুরী
সুমন- দুটো প্রশ্ন একসঙ্গে করছি। এক, শহরের মানুষ তাঁদের ফটোগ্রাফিতে যেভাবে গ্রামের জীবনকে ডকুমেন্টশন করেছেন, একজন গ্রামের মানুষ (যিনি কখনও শহরে আসেননি) তাঁর নিজের জন্য বা তাঁর গ্রামের মানুষের জন্য সেটা কেন করতে পারছেন না! এখনও কেন গ্রামের মানুষের হাতে ক্যামেরা পৌঁছাচ্ছে না?
দুই, আমরা যারা তথাকথিত শহুরে মানুষ, গ্রামের ওই মানুষগুলোর জন্য, যাদের প্রবল ইচ্ছা থাকলেও কোনো উপায় নেই, তাদের জন্য কী ভাবছি? বিশেষ করে আমাদের প্রজন্ম কী ভাবছে?
তীর্থেন্দু- এখনও কেন গ্রামের মানুষের কাছে ক্যামেরা পৌঁছাচ্ছে না, সেটা আমার কাছে জরুরি নয়। সেখানে আলো, খাবার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পৌঁছচ্ছে কিনা সেটাই লক্ষ্যণীয়। গ্রামের মানুষ বললে সীমিত করে দেওয়া হবে। আমি গ্রাম থেকে উঠে আসা বিভিন্ন ঘরের ছেলেদের হাতে ক্যামেরা দেখেছি। এখনও দেখি। তবে এখানে বড়ো হওয়া বা সমাজের প্রভাব খুব গুরুত্বপূর্ণ। শহর বা গ্রাম মিলিয়ে অনেকেই শিল্পের প্রয়োজনীয়তা দৈনন্দিন জীবনে কী ইমপ্যাক্ট ফেলে তা বুঝে উঠতে পারে না বা চায় না। ফলে তারা ধরা যাক, ক্যামেরা কিনল, কিনেও সেই একই ছবিই তোলে বা তুলবে। নিজের চারপাশকে ক্যামেরায় দেখাতে নিজের একটা দর্শন থাকা জরুরি। সেটা গ্রাম হোক বা শহর।
রাসেল- গ্রামের ছেলেদের কাছে ক্যামেরা না পৌঁছানোর কারণ আমার মনে হয় ফটোগ্রাফিটা অনেক এক্সপেন্সিভ একটা মাধ্যম। সবার সাধ্য নেই। শহরের ছেলেরাই হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে।
শুভজিৎ- ধন্যবাদ সুমন, আমি এই বিষয়টা নিয়েই কথা বলতে যাচ্ছিলাম। পাতি বাংলায় বলছি, ফটোগ্রাফি একটি বড়োলোকের শিল্পমাধ্যম। সেই বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। ভারতের পরিস্থিতি বলি, ফটোগ্রাফি যে একটি শিল্পমাধ্যম হতে পারে, সেই ধারণা ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থাতে নেই। ফটোগ্রাফি সংক্রান্ত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও ভারতবর্ষে নেই। আর যদি গ্রামের প্রসঙ্গ আসে তাহলে এমন বহু গ্রাম আছে যেখানে বিদ্যুতের আলো পৌঁছায়নি, সেখানে ফটোগ্রাফি তো স্বপ্ন। শহরের মানুষের কাছে হাজারটা টুলস থাকে, তাই একটু হলেও এগোনোর সুযোগ পাচ্ছে। আমি যখন গ্রামের একটি স্কুলে পড়তাম, জানতামই না ফটোগ্রাফি একটা শিল্প হতে পারে।
ফটোগ্রাফি তো বাদ দিলাম, গ্রামে একটা লোক গোবর দিয়ে ঘুঁটে বানায়। সেই ঘুঁটে বানানোও যে একটা শিল্প, সেই বোধটুকু তৈরি করার মতো শিক্ষা কি আমাদের দেশ গ্রামগুলোতে পৌঁছে দিতে পেরেছে?
প্রতীক- ঠিক। তাছাড়া ফটোগ্রফিকে গ্রামে পৌঁছাতে হবেই এর কোনো মানে নেই। গ্রামের অন্য অনেক কমিউনিকেশন মিডিয়াম আছে। পটচিত্র আছে, ছৌ আছে, পালাগান আছে। তবে গ্রামের নতুন প্রজন্ম অল্পবিস্তর ছবি তুলছে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেও কিন্তু শহরের মানুষের প্রভাব পড়ছে। কারণ যে কাজগুলো তারা রেফারেন্স হিসাবে দেখছে, সেগুলোও কোনো শহুরে মানুষের তোলা।
তীর্থেন্দু- একেবারেই! শিল্পের ধারণা শহরাঞ্চলেও যে খুব বেশি আছে, তা কিন্তু জোর দিয়ে বলা যায় না।
তীর্থেন্দু ব্যানার্জী
রাসেল- দাদা, আমি প্রায় দশবছর ধরে ফটোগ্রাফি করছি। এর ভেতরে সাতবছর আমি ব্যবহার করেছি ক্যনন ১১০০-ডি আর ১৮-৫৫ লেন্স। আমার এক তুতো ভাইয়ের নিকন ডি-৭০০০ ছিল, সেটা ধার করে ব্যবহার করেছি। এখন সেখানে গ্রামের মানুষদের কাছে ক্যামেরা কেনা অনেক কঠিন মনে হয়।
শুভজিৎ- গ্রামের মানুষদের হাতে ক্যামেরা তুলে দিতে হবে, এই ভাবনা ভাবার সময় এখনও আসেনি সুমন। বরং গ্রামের মানুষদের মধ্যে শিল্পচেতনা তৈরি করতে হবে। গ্রামের মানুষজন তাদের প্রাত্যহিক জীবনে যে যে জিনিসগুলো ব্যবহার করেন সেইগুলো দিয়েও একটি ইন্সটলেশন, একটি স্কাল্পচার বা পেইন্টিং করা যায়। এক কথায় একটা আর্ট মুভমেন্ট-এর কথা বলছি। সেটা কিন্তু গ্রামে অবিলম্বে শুরু করা খুব প্রয়োজন। তারপর তারা ভাববেন, তারা ফটোগ্রাফি করবেন কিনা, ফটোগ্রাফিই করতে হবে এমন তো কথা নেই।
সুমন- গ্রাম বা শহর যাই হোক, এই শিল্পচেতনা তৈরি করার জন্য আমরা কী ভাবছি?
শুভজিৎ- কিচ্ছু না, একদিন একজন গ্রামের মহিলাকে এক তাল গোবর দাও, তারপর বলো, ঘুঁটে বাদে অন্য কিছু বানাও। সে সেদিন ভাবতে শুরু করবে, গোবর দিয়ে মৌচাকও বানানো যায়। আর একটা কথা বলি, আমরা কজন আগে গ্রামে প্রদর্শনী করি, শহরের গ্যালারি বাদ দিয়ে! তারপর তো এসব ভাবব। নিয়মিত গ্রামে প্রদর্শনী করতে হবে। এটা আলোকচিত্রীদের নৈতিক দায়।
প্রতীক- একদমই তাই। শিল্প কখনো মিডিয়াম স্পেসিফিক হতে পারে না। আমাদের ঐতিহ্যসূত্রে আমরা অন্য অনেক শিল্পমাধ্যম পেয়েছি, যেগুলো নিয়ে আমরা কাজ করতেই পারি, কিন্তু করি না।
রাসেল- গ্রামে আমি যাই।
শুভজিৎ- ভারতে হয় না, বাংলাদেশে হয় জানি।
তীর্থেন্দু- আমরা কে সুমন? আমরা কী? আমরাও তো সমষ্টির অঙ্গ। যারা কখনও ভিতর থেকে, কখনও ওপর থেকে পুরো বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছি যে সময়টা কীরকম। শিল্পচেতনা কেউ জোর করে দিতে পারে না। এটা সামগ্রিক প্রয়াস। আমরা তো কলকাতায় গঙ্গার ঘাট আর হাওড়া ব্রিজ বাদে ছবি তুলতেই শিখলাম না। জানলামই না এর বাইরেও ছবি হয়। শিল্পচেতনা খুব ব্যক্তিগত অনুভব। এই অনুভবটা সমস্ত কাজে রিফ্লেক্টেড হওয়া দরকার। নাহলে সবার ছবি একই হবে, সব বিয়ে বাড়িতে বউকে একইরকম দেখতে হবে।
প্রতীক- আমি গ্রামে গিয়ে প্রদর্শনী না করলেও রাস্তায় রাস্তায় করেছি। যেগুলো আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে।
রাসেল- গ্রামের পলিটিক্সটা আবার অন্যরকম। সেটা অনেক ভয়ংকর হয়।
সুমন- রাসেল ভাইকে একটা প্রশ্ন করি৷ তুমি তো ঢাকায় থাকো। বাংলাদেশে অন্যান্য পেশার মতোই ফটোগ্রাফিকে যারা বেছে নিচ্ছেন রোজগারের পথ হিসাবে, অর্থনৈতিকভাবে পুরো অবস্থাটা কীরকম?
রাসেল- আমাদের দেশে ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসাবে নেওয়া খুব কঠিন। এখানে ওয়েডিং একটা মাধ্যম আর জার্নালিস্টদের ব্যাপারটা অন্য। যারা প্রচুর অ্যাওয়ার্ড পায়, তারা ভালোই ইনকাম করে হয়তো। আমার ছবি তেমন একটা অ্যাওয়ার্ড পাবার মতো যোগ্য হয় না, তাই এদিক দিয়ে আমার তেমন কোনো ভরসা নেই। ওয়েডিং আমাকে টানে না। তাই চাকরি করছি আর পাশাপাশি ছবি তুলে যাচ্ছি।
সুমন- ভারতেও বেশিরভাগ ফটোগ্রাফার ওয়েডিং-এর দিকেই ঝোঁকেন। নাহলে না খেয়ে মরতে হবে। অবস্থাটা এক।
তীর্থেন্দু- এটা ভুল ধারণা। ওয়েডিং এখন একা আসে না, এলে বিভিন্ন ইভেন্ট নিয়ে আসে। সেই পরিমাণ তুমুল কাজ হচ্ছে ওয়েডিং-এ, সেটাও ভাবা দরকার।
প্রতীক- আমি কাজের সূত্রে ব্যাঙ্গালোরে থাকি এবং ওয়েডিং ফটোগ্রাফি করি না। তাই পেশা হিসাবে এটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। তবে যে ধরনের কাজ করতে চাই, সেটাও করতে পারছি না।
সুমন- কেন পারছিস না বলে মনে হয় প্রতীক?
প্রতীক- ব্যালেন্স করতে পারাটা জরুরি। সেটা করে উঠতে পারছি না। কমার্শিয়াল কাজের একটা আলাদা প্যাটার্ন থাকে, যেটা এখনও ঠিক আয়ত্বে আনতে পারিনি।
তীর্থেন্দু- প্রথমে আমারও এই সমস্যাটা হত। ধীরে ধীরে অনেকটাই বদলে গেছে। আমার ভিতরেও ওয়েডিং নিয়ে কিছু গা শিরশিরে ভাব ছিল।
প্রতীক- আর কমার্শিয়াল কাজের ক্ষেত্রে ক্লায়েন্টই শেষ কথা। তোমার শিল্প বা শিল্পীসত্তা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ না। আমার মনে হয় যে কাজগুলো করছি, সেগুলো আমাকে রিপ্রেজেন্ট করছে কিনা। আমিও হয়তো কাউকে কপি করছি। একজন শিল্পী হিসাবে আমার ক্যামেরার জায়গায় রং তুলি পেন্সিল হলেও চলবে।
শুভজিৎ- ঠিক ঠিক ঠিক। ফটোগ্রাফিটা ক্যামেরার বাইরে গিয়েও ভাবা যায়। ভাবার সময় আসছে।
শুভজিৎ নস্কর
প্রতীক- কিছুদিন আগেই ‘আঙ্গিক’ পত্রিকার জন্য একটা ডিজিটাল পোস্টার করেছিলাম এবং সেখানে আমি যেটা বলতে চেয়েছিলাম, সেটা পেরেছিলাম। তাই আমার ধারণাও আস্তে আস্তে পাল্টাচ্ছে। আর সবাইকে ধন্যবাদ কারণ এই কনভারসেশনটা হয়তো আমাকে এটা বুঝতে সাহায্য করবে, যে আমি ফটোগ্রাফি কেন করব...
সুমন- এই আলোচনাটার পর আমার একটা জিনিস জানতে খুব ইচ্ছা করছে। এখানে তোমরা চারজন নিজেদের কাজের প্যাটার্ন নিয়ে একটু বলবে? মানে কে কোন বিষয়টা নিয়ে বেশি ফোকাসড। একটা ছবি তোলার সময় কোন কোন বিষয়গুলো মাথায় ঘুরপাক খায়?
প্রতীক- মানুষ আর মূহুর্ত। আসলে আমার জন্য জীবনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ছবির টেকনিক্যাল এক্সিলেন্স নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাই না।
রাসেল- আমি মূলত চেষ্টা করি ইমশোনাল ব্যাপারটা রাখতে। চেষ্টা করি দর্শকদের কাছে ছবির ইমশোনটা তুলে ধরতে।
শুভজিৎ- মানুষ ও তার গল্প। প্যাটার্নে বিশ্বাসী নই। বরং প্রতি মুহূর্তে প্যাটার্ন ভাঙতে চাওয়ায় বিশ্বাসী। সঙ্গে সমসাময়িক রাজনৈতিক বিষয়।
তীর্থেন্দু- কী দেখাব বা কী দেখাব না, এইটা আমার পক্ষে বলা খুব মুশকিল। মানে ধরা যাক, এই মুহূর্তে আমি রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। সেক্ষেত্রে একটি আলো একা একাই কোত্থেকে এসে পড়েছে। ওই ছবিটি তোলার সময় মানুষ থাক বা না থাক মানুষের সমস্যার কথা মাথায় আসে। একটা একা আলো কার হতে পারে, কোন পরিস্থিতিতে হতে পারে, সেটা মনে আসে। নন-রিপ্রেসেন্টেশনাল কাজ খুব একটা করি না। ফলে কোথাও না কোথাও আমার ছবি কিছু না কিছু রিপ্রেসেন্ট করেই। প্লাস্টিক এলিমেন্টে শুধু ফোকাস রাখতে পারি না।
সুমন- তোমাদের তোলা অসংখ্য ছবির মধ্যে চারজনের চারটে ছবি দেখাচ্ছি। এই চারটে ছবি আমার খুব পছন্দের। অনেক কাজ হয়তো দেখিওনি৷ এবার প্রশ্ন হল, এই ছবিগুলো তোলার আবহে কী কী কাজ করেছিল বা লোকেশন কী যদি বিস্তারে একটু জানাও...
রাসেল- ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। প্রতিবছর ১৩ তারিখ ভোরে আমি ছবি তুলতে যাই। ১৪ তারিখের জন্য এই জায়গার সমস্ত গাছের গুঁড়িতে নতুন রং করা হয়। সেটাকেই কাজে লাগিয়েছি। তবে ছবি তোলার সময় আমি এটাকে সাদা-কালো করব ভেবেই তুলি।
শুভজিৎ- আমার ছবিটা মহরমের দিন তোলা। কলকাতার নাখোদা মসজিদ থেকে রাজাবাজার পর্যন্ত মিছিলটা হয়। প্রথমে গিয়ে দেখি, পুরুষরা নিজেদের পিঠে আঘাত করছে, গা দিয়ে রক্ত পড়ছে, সবাই সেই ছবিটাই তুলছেন। আসলে ছবি যারা তুলি, তাদের ভাবনাতেই থাকে আমার ছবি অন্যদের থেকে একটু হলেও আলাদা হবে। সকলেই ভাবে সেটা। দেখলাম যখন সকলে ওটাই তুলছে, আমি অন্য কিছু তুলব। দূরে মহিলারা দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠানটা দেখছিলেন। আর মাঝেমাঝেই বুক চাপড়াচ্ছিলেন। সুন্দর লাইট। সুন্দর লাইন। কিন্তু ওঁদের ছবি কেউ তুলছেন না। ইচ্ছে হল, তুললাম, তখনও ভাবিনি। অনেক দিন মেশিনে পড়ে ছিল। একদিন খুলে দেখছি, এই যে ওঁদের কষ্টটা ছবিতে উঠে এসেছে, সেটা কি শুধুই ধর্মাচরণ নাকি পুরুষের সঙ্গে সামিল না হতে পারার যন্ত্রণা!
প্রতীক- আমার ছবিটায় ওই ছেলেটির মধ্যে নিজেকে দেখেছিলাম। নিজের শৈশব দেখেছিলাম। আমি তথাকথিত একান্নবর্তী পরিবারে বড়ো হলেও শৈশব একা একাই কেটেছে। বারান্দায় বসে বাইরে তাকিয়ে থাকতাম, যেভাবে ছেলেটি আছে। যা দেখতাম আর মাথার মধ্যে যা চলত দুটো সম্পূর্ণ আলাদা। ছেলেটির চোখ দেখে আমার সেই মুহূর্তগুলো মনে পড়ছিল। ভাঙা কাচটা আমার ছোটোবেলার স্ট্রাগেলের রিপ্রেসেন্টেটিভ বলে মনে হয়েছিল।
তীর্থেন্দু- আমার ছবিটা দার্জিলিং-এ তোলা। সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত উঁচু পাহাড় থেকে দেখতেই ভালোলাগে, ছবি তুলতে না। সেদিন একাই দার্জিলিং স্টেশনে বসেছিলাম এবং অনেকক্ষণ এই বাচ্চাটাকে খুব ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছিলাম। দেখলাম সবাই ওকে ছুঁয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ও অবিচল। ওকে কিছুই এফেক্ট করছে না। বাচ্চাটা আসলে করছে কিছুই না, ভাবছে। বা ভাবছে না। অদ্ভুত রঙিনভাবে ওর অবস্থান। তখনই ভাবছিলাম কেমন করে দেখাব ওকে! কীভাবে দেখাব! শুধু মনে হচ্ছিল নিজেই নিজেকে স্বপ্নে দেখছি। তখনই এরকমভাবে ছবিটা তুললাম।
সুমন- সবার এই দেখাগুলো সত্যিই খুব ইন্টারেস্টিং। আচ্ছা, নিজেদের ছবি প্রচারের জন্য কে কী ভাবছ? আদৌ কি প্রচারের কথা ভাবছ? দর্শক আর ফটোগ্রাফারের মধ্যে দূরত্ব কমাবার জন্য কী কী করা যেতে পারে?
রাসেল- এটা খুব কঠিন একটা প্রশ্ন। ফটোগ্রাফিতে স্টাইলটাই আসল। আমি চেষ্টা করছি সেটাকে দাঁড় করাতে।
প্রতীক- প্রচারের কথা কোনোদিন ভাবিনি, এখন তো আরোই ভাবছি না। কিছু কাজ করার আছে, যেগুলো নির্দিষ্ট একটা বর্গের মানুষকে ঘিরে। তাঁদের সঙ্গে থাকব। কাজ করব। যাদের নিয়ে কাজ করব, তাঁদের সঙ্গে দূরত্ব কমানো আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের ছবি আমি তাঁদেরই দেখাব। আসলে ছবিকে আর কন্টেন্ট হিসাবে দেখতে ইচ্ছা করছে না। তাই বিক্রির কোনো দায়ও অনুভব করছি না।
শুভজিৎ- সত্যিই ভাবিনি কিছু। বিপণনের দিকে আমারও কোনো আগ্রহ নেই। তবে মানুষ কীভাবে ছবি দেখতে পারবে, সেই ব্যাপারে ভাবনা-চিন্তা করছি। মানুষের কাছে ছবি পৌঁছে দেওয়ার চিন্তাটা সবসময় থাকে।
তীর্থেন্দু- ওটা না এমনিই হয়ে যায়। আলাদা করে বলতে হয় না। যেটা ভাবছি সেটা হল কন্টেন্ট। হ্যাঁ, আমার কাছে কন্টেন্টটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ এখনও। কীভাবে থট প্রসেসকে নানারকম এক্সপেরিমেন্টের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, কোন পেইন্টিং দেখব, কী পড়ব ইত্যাদি।
সুমন- এই যে ফটোগ্রাফারদের অনেকে ক্যামেরাম্যান বলে ডাকে। এটা কি গায়ে লাগার মতো কথা?
শুভজিৎ- না, আমার গায়ে লাগে না। যে দেশে শিল্পচেতনা বিরল বস্তু, সেই দেশে এমন ঘটবেই। গ্রহণ করতে হবে।
প্রতীক- আমারও এসব গায়ে লাগে না।
তীর্থেন্দু- সত্যিই কিছু যায় আসে না। মানুষ এরকম বলেন তাঁদের ধারণা থেকে। আমায় অপমান করার উদ্দেশ্যে নয়। এটা পাল্টানো দরকার তো বটেই। তবে এটাই কিন্তু প্রাথমিক সমস্যা নয়।
সুমন- তা নয়৷ আবার সিনেমা বা চলচ্চিত্রকেও ছবি বলা হয়। বই-ও বলেন অনেকে।
তীর্থেন্দু- হ্যাঁ এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
শুভজিৎ- ‘রামের সুমতি’ বই পড়ে লোকে ‘রামের সুমতি’ সিনেমা দেখছে। বই সেই জন্য।
প্রতীক- মোশন পিকচার কিন্তু ইংরেজিতে একটা জনপ্রিয় শব্দবন্ধ।
আরও পড়ুন
বাংলা চলচ্চিত্রে ‘বৃষ্টি’র জলছবি
সুমন- হ্যাঁ নিশ্চয়। শেষ প্রশ্নটা করি। যেকোনো শিল্পমাধ্যম মূলত সিনেমা বা থিয়েটার - যেখানে টিকিট মূল্য গড়ে ১০০ টাকা। আবার কোনো একটি কবিতা বা উপন্যাসের বইয়ের দাম গড়ে ১৫০ টাকা। সেখানে একটা ফটোগ্রাফি বা একটা পেইন্টিং কেন এবং কীভাবে ২৫,০০০ টাকা দিয়ে কিনবে! যে দেশে লোকের নুন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছে। বিভিন্ন এক্সজিবিশনে নিজেদের কাজের মুদ্রিত মূল্য নিয়ে ভেবেছ? বা অন্য কোনো ফরম্যাট আছে কি এর?
শুভজিৎ- তার একটা কারণ হল ফটোগ্রাফ বা পেইন্টিং-এ যে ট্যুলস লাগে, সেগুলো বড্ড দামি। আর কন্টেন্টটাও ওয়ান টাইম অর ম্যাক্সিমাম ৫/১০ টাইমস সোল্ড আউট হয়। সেখানে বই বা সিনেমা তো ওই ফরম্যাটে চলে না। তবে হ্যাঁ, ফটোবুক কন্সেপ্ট বলে বাজারে যেটা চলে, দ্যাটস টু মাচ এক্সপেন্সিভ। আমি নিজে যদি বই বের করি, ৩০০-৫০০ টাকার মতো দাম রাখার চেষ্টা করব। সেই বুঝে কন্টেন্টও দেব।
রাসেল- আসলে আমাদের মানসিকতাটা এমন হয়েছে যে, চাইলে যে কেউ ফটোগ্রাফার হয়ে যেতে পারে। ক্যামেরাই যেন ছবিটা তৈরি করে দিচ্ছে, অনেকের এমন ধারণা। তাই তো ছবি কেনার ব্যাপারে মানুষের আগ্রহও কমে যাচ্ছে।
রাসেল রণি
তীর্থেন্দু- প্রথমত পেইন্টিং-এর রিপ্রিন্ট বলে কিছু হয় না। একটাই কপি হয়, ওরিজিনাল। তার দাম স্বভাবতই বেশি হওয়ার কথা। ফটোগ্রাফের ক্ষেত্রে রিপ্রিন্ট হয়, কিন্তু সেটারও ওরিজিনালের দাম বেশি হয়। ভিস্যুয়াল আর্ট ফরম্যাটটাই সেরকম। বইয়ের ক্ষেত্রে সেরম নয়, কারণ হাজার হাজার বই একসঙ্গে বেরোতে পারে। সেক্ষেত্রে ওরিজিনাল পাণ্ডুলিপিও হয়তো অনেকে কিনতে পারবেন না, সেটির দামও আকাশছোঁয়া হবে।
সুমন- সবটাই বুঝতে পারছি৷ ফটোগ্রাফি বা পেইন্টিং তাহলে একটা অংশের মানুষের জন্যই। তাই তো নাকি? অন্য কোনো উপায় খুঁজে বের না করলে এটা শিল্পের ক্ষেত্রে একটা সীমাবদ্ধতাও বটে।
শুভজিৎ- হ্যাঁ, ভীষণভাবে।
তীর্থেন্দু- সুমনের সঙ্গে আমি একমত।