No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    মাত্র তিনদিনে গোচালা ট্রেক আর ভূতবাংলোর সত্যি গল্প

    মাত্র তিনদিনে গোচালা ট্রেক আর ভূতবাংলোর সত্যি গল্প

    Story image

    ‘Time like an ever rolling stream’—লেখা ছিল বাইবেলে। সময় বইবেই, জীবন থেকে সরে সরে যাবেই প্রতিটি মুহূর্ত। সময় আমাদের কাছে অভিশাপ, আবার আশীর্বাদও। নির্ভর করছে প্রতিটি মুহূর্তকে কীভাবে ব্যবহার করছি। 

    অন্নপূর্ণা সার্কিট দৌড়ে এসেই চলে গিয়েছিলাম কাঞ্চনজংঘা জাতীয় উদ্যানে দৌড়তে। যখনই যতটুকু সময় পাই দিয়ে দিই পাহাড়কে। এবারে লক্ষ স্থির করলাম, তিনদিনে গোচালা এবং রাথোংলা সার্কিট সম্পূর্ণ করব। যাদের গোচালা ট্রেকের অভিজ্ঞতা আছে, তারা সবাই বুঝবেন এটা একটা অবিশ্বাস্য ও অবান্তর টার্গেট। খুব কষ্টকরও। কিন্তু, এটাই ঠিক করলাম আমরা। আমরা মানে পাহাড়-পাগলদের একটা গ্রুপ।

    অন্নপূর্ণা সার্কিট শেষ করার পরেই বুঝেছিলাম, আমার একার পক্ষে দিনের পর দিন এই ধরণের ঝুঁকিপূর্ণ আর ব্যয়বহুল অভিযান চালিয়ে যাওয়া বেশ অসুবিধেজনক। তাই চেষ্টা করলাম একটা গ্রুপ তৈরি করার। নাম দিলাম ‘দ্য আল্ট্রা হিমালয়ানস’। কোনো সংগঠিত গ্রুপ নয়। নানা ফিল্ডের এন্ডুরেন্স স্পোর্টসের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন পাহাড়প্রেমীদের জড়ো হওয়া বলা যায়। সেই গ্রুপ থেকেই ঠিক করা হল গোচালা রাথোংলা তিনদিনে করার চেষ্টা করা হবে। টেন্ট, স্লিপিং ব্যাগ, খাবার-দাবার সব কিছু নিজেরা বইব। একজন কমবয়সী কর্মঠ গাইড শুধু সঙ্গে থাকবে।

    টিমে ছিল আমি ছাড়া অর্পিতা মৈত্র, অভীক লাহা, ছোট্টু রায় আর আমাদের গাইড সুমন। প্রথম দিন অনুমতিপত্র বানিয়ে কাঞ্চনজংঘা জাতীয় উদ্যানে ঢুকে পড়লাম সকাল ১০টার দিকে। ইয়ুকসাম ছাড়তেই ঘন জঙ্গল শুরু হয়ে গেল। অনেক নিচু দিয়ে বয়ে চলেছে প্রেকচু। ডানদিকে খাড়াই দেওয়াল, মাঝে সরু রাস্তা দিয়ে ট্রেকার্সরা এবং ঘোড়া-ইয়াক যাচ্ছে আসছে। পিঠে জিনিসপত্রের ওজন যথেষ্ট ছিল, তাই দৌড়নোর বদলে যত সম্ভব দ্রুত হাঁটছিলাম সবাই মিলে।

    চারদিকে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। জঙ্গলের মধ্যে প্রথম ক্যাম্পিং-এর জায়গা সাচেন। তিনটি ব্রিজ পেরিয়ে, সাচেন পৌঁছতেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। দেখি, একটি লোককে শুইয়ে ভালো করে বাঁধা-ছাঁদা চলছে। ভাবলাম মারা গেলো নাকি! কাছে গিয়ে বুঝলাম জ্বর হয়েছে, তাই নামানোর তোড়জোড় চলছে। এরপর, চারনম্বর ব্রিজ পেরিয়ে রাস্তা সোজা উঠে গিয়েছে। আমাদের গন্তব্য ছিল বাকহিম পেরিয়ে শোকা। ইয়ুকসাম থেকে ১৪ কিমি। উচ্চতা প্রায় ৩০০০ মিটার। পৌছে গেলাম মাত্র ৪ ঘণ্টাতেই। এবার পালা ভালো করে রেস্ট নেওয়ার এবং ঠিকমতো এক্লামাইটাইজেশন সেরে নেওয়ার। 

    পরেরদিন ভোররাতে বিউটেনে রান্নাবান্না করে রওনা দিলাম সোজা কোকচুরাং হয়ে গোচালার দিকে। আমি আর অর্পিতাদি প্রায় দৌড়চ্ছি। রাস্তা ফেদাং অবধি সোজা উঠে গিয়েছে। তারপর, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সমানে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পৌঁছলাম কোকচুরাং-এ। এখানে আমাদের ভারী স্যাকগুলো রেখে থান্সিং হয়ে রওনা দিলাম গোচালার উদ্দেশ্যে। আমরা ভেবেছিলাম, থাংসিং-এর ট্রেকার্স হাটে কিছু ব্রেকফাস্ট সেরে নেব। কিন্তু ১১টার দিকে থান্সিং পৌঁছে দেখলাম পুরো ক্যাম্পসাইট খাঁ খাঁ করছে, কোথাও কেউ নেই। অর্পিতাদি তখনও পৌঁছয়নি। আবহাওয়া তখনো ঠিক ছিল, তবে যে কোনো সময় বিগড়ে যেতে পারে। তাই ঠিক করলাম চৌকিদারকে খুজে সময় নষ্ট করব না, যত দ্রুত সম্ভব এগিয়ে যাব। পকেট হাতড়ে একটা এনার্জি বার পেলাম। তারই ভরসায় এগিয়ে চললাম। 

    খানিক পেছনে দেখলাম অর্পিতাদিও আসছে। ভদ্রমহিলার বয়স প্রায় ৪০ বছর, অথচ মানসিক আর শারীরিক ক্ষমতার কোনো তুলনা হয়না! তখন রীতিমতো দৌড়চ্ছি, মাঝে মাঝে উকি দিচ্ছে কাঞ্চনজংঘা। সমিতি লেক পেরিয়ে অবশেষে বেলা ১টার দিকে গিয়ে দাঁড়ালাম ভিউ পয়েন্ট ১-এ। আপাতত এই দূর অবধিই যাওয়া যায়। জায়গাটি ঠিক পান্ডিম পর্বতের নিচে, সামনে ঝকমক করছে কাব্রু-সহ আরো নানা শৃঙ্গ। ঠিক ১০-১৫ মিনিটের মধ্যেই পুরো মেঘে ঢেকে গেল! শোকা থেকে সোজা গোচালা, আমরাই প্রথম করলাম।

    এবার ফেরার পালা। পরিকল্পনা ছিল কোকচুরাং হয়ে জোংরি উঠে যাব। পরেরদিন রাথোংলা হয়ে ইয়ুকসাম ফিরে যাব। কিন্তু কোকচুরাং পৌঁছে আর কেউ জোংরি উঠতে চাইল না। বাধ্য হয়ে বাকি পরিকল্পনা বাতিল করতে হল। সেদিন আবার ছিল ভূত চতুর্দশী। রাতটা কাটল কোকচুরাং-এর নিঝুম ভুতুড়ে বাংলোতেই। হাড়হিম করা রাত, দু’পাশে হিমালয় আর ভূতবাংলো। ভয় হচ্ছিল, সকালে উঠে নিজেদের জীবিত দেখব তো!

    সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখছি সকলেই বেঁচে আছি। সেই আনন্দে লাফাতে লাফাতে সবাই মিলে ইয়ুকসাম ফিরে এলাম। মাত্র তিনদিনেই গোচালা ট্রেক সম্পূর্ণ হল!

    অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে! তিনদিনে গোচালা ট্রেক! 

    হ্যাঁ, সম্ভব।

    Tags:

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @