‘সাহেবদের ঠাকুর’ ও বিলিতি পুরোহিত

সালটা ১৭৯৮। মশা-মাছি-ভ্যাপসা গরম-দেদার আম-লিচু-মাঠ উপচোনো ধান আর কালো কালো মানুষে ভর্তি বঙ্গদেশে লালমুখো সাহেবদের ভিড় তখনও বেড়েই চলেছে। কলকাতাকে ঢেলে সাজানো চলছে। কোম্পানির অধীনে থাকা বাংলাকে ‘সুশাসন’ দেওয়ার জন্য আইনি বই লেখা হয়ে গেছে। কলকাতায় বিলিতি থিয়েটারের রূপকথার খবর উজিয়ে আসছে ‘নেটিভ’দের কানে। অথচ ভিতরে ঢোকা মানা। লেবেদফ নামের এক রুশ এসে অবশ্য সেই থিয়েটার আধা বাংলায়, আধা ইংরেজিতে চাখিয়ে গেছেন দেশি কয়েকজনকে। তার ঘোর তখনও কাটেনি। এমনই কোনও এক সময়খণ্ডে ধর্মযাজক উইলিয়াম কেরির কাছে একটা কাঠের বাক্স এসে পৌঁছোল। কেরি তখন থাকেন মদনাবাটীতে। বেহদ্দ গ্রাম, কিন্তু সম্পন্ন। নদীর পাড়ে গ্রাম হওয়ার সুবিধে ঢের। ফলে, সেই বাক্সও এল নদীপথে, নৌকোয় চেপে। যে সে বাক্স নয়, ছাপার কল। বিলিতি মুদ্রাযন্ত্র। সেটা কী, খায় না মাথায় দেয়, গাঁয়ের মানুষ বোঝে না। কিন্তু অবাক হয়ে দেখে, এই যন্তর পেয়ে কেরি সাহেব ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা আনন্দে প্রায় নাচছে। সামান্য যন্তরের কী এমন গুণ যে যাজককেও নাচায়! গাঁয়ের মানুষরা সেই আশ্চর্য যন্ত্রের নাম দিলেন ‘সাহেবদের ঠাকুর’।
সাহেবদের এই ঠাকুরের ‘আশীর্বাদেই’ এরপর বাংলা গদ্যের খাতেখড়ি থেকে আদল গড়ে ওঠার বিচিত্র ইতিহাস জন্ম নেবে। তদ্দিনে অবশ্য এই ঠাকুর প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন শ্রীরামপুর মিশনের ছাপাখানায়। ১৮০০ সালের কনকনে ঠান্ডা পেরিয়ে বসন্ত আসতে না আসতেই ছাপা হয়ে যাচ্ছে রামরাম বসু ও টমাস অনূদিত সেন্ট ম্যাথুজ গসপেল। ডিমাই ৮ পেজি ১২৫ পৃষ্ঠার বই ‘মঙ্গল সমাচার মতিয়ের রচিত।’ তারপর অবিরাম ধারা। ১৮০১ থেকে ১৮৩২ সালের মধ্যে চল্লিশটি ভাষায় দুই লক্ষ বারো হাজার বই প্রসব করেছে এই মুদ্রাযন্ত্র। বাংলা ভাষাতেই ছাপা হয়েছে দেদার বই। বাইবেলের অনুবাদ থেকে শুরু করে ধর্মমূলক পদ্য-গদ্য কিংবা পাঠ্যপুস্তক, সাহিত্য, ইতিহাস, আইনের বই ও আরও কত কী। বাংলা সাহিত্যে একটা নতুন সময়ের দরজা খুলে গেছে হাট করে। রামরাম বসু, চণ্ডীচরণ, রাজীবলোচন ও মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কার মিলে বাংলা গদ্যরীতির একটা ছাঁদ গড়েপিটে নিচ্ছেন। এখান থেকে ছাপা বাংলা গদ্যসাহিত্য পৌঁছে যাচ্ছে অসংখ্য গৃহস্থের চারদেওয়ালের ভিতরে, এমনকি ক্লাসঘরেও। আর, এসবের কেন্দ্রেই রয়েছে গঙ্গাতীরবর্তী একটা অখ্যাত গ্রামের সরল মানুষদের বানিয়ে তোলা সেই ‘সাহেবদের ঠাকুর’।
বাংলাদেশে ছাপাখানা যে এই প্রথম স্থাপিত হল, তা কিন্তু নয়। বাংলা ছাপাও এই প্রথম নয়। বাংলা হরফ প্রথম ছাপা হয়েছিল পর্তুগালে, তারপরে লন্ডনে। আর, এই বাংলাদেশেই ১৭৭৮ সালে হুগলিতে অ্যান্ড্রুজ সাহেবের ছাপাখানা থেকে বেরিয়েছিল নাথানিয়েল হ্যালহেডের ‘গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গোয়েজ’। বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ বই। তাতে পাতায় পাতায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসী মহাভারত, ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর থেকে উদ্ধৃতি। সব বাংলা হরফে। যে বাংলার ছাঁদ গড়ে দিয়েছিলেন উইলকিন্স সাহেব। তাঁকে সাহায্য করেছিলেন জোসেফ শেফার্ড নামের সাহেব যুবা এবং এক বঙ্গসন্তান—পঞ্চানন কর্মকার। এই পঞ্চাননই এরপরে কোলব্রুক সাহেবের ছাপাখানা ঘুরে এসে পৌঁছেছিলেন কেরির শ্রীরামপুর মিশনে। বাংলা হরফের কাঠামো পেয়েছিল তাঁরই ছেনির স্পর্শ। এই অ্যান্ড্রুজ সাহেবের ছাপাখানার পরেও কলকাতায় ও তার চারপাশে একাধিক ছাপাখানা গড়ে উঠেছে। প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলাগ্রন্থ হিসেবে জোনাথন ডানকানের অনূদিত আইনের বইও সূর্যের আলোমুখ দেখে ফেলেছে। কিন্তু, শ্রীরামপুর মিশনের ছাপাখানার গুরুত্ব ও ভূমিকা এইসবকিছুর মোট যোগফলের থেকেও হয়ত বেশি। শুধু মোট মুদ্রণের সংখ্যার বিচারেই নয়, এমনকি বাংলা গদ্যসাহিত্য জন্ম দেওয়ার জন্যও নয়। এই ছাপাখানার অন্যতম অবদান সেনাবাহিনীর ইউনিফর্মের মতো ছাঁচে ঢালা সুশৃঙ্খলভাবে সার বেঁধে দাঁড়ানো বাংলা অক্ষরসজ্জার স্থায়ী রূপের জন্ম দেওয়া। যে হরফসজ্জা কাঠের ব্লকের ছাড়াছাড়া ছাপাতে সম্ভবই নয়।
আরও পড়ুন
জব চার্নকের স্ত্রী
উইলিয়াম কেরি
নর্থ হ্যামটনের এক গ্রাম্য মুচির ছেলে উইলিয়াম কেরি বেআইনিভাবে বাংলাদেশে এসেছিলেন ১৭৯৩ সালে। প্রধান উদ্দেশ্য খ্রিস্টধর্ম প্রচার করা। সাতবছর ধরে বাংলা শিখেছেন, বাইবেল অনুবাদ শেষ করেছেন। কিন্তু ছাপানোর উপায় পাচ্ছিলেন না। প্রথমে ভাবলেন বিলেত থেকে বই ছাপিয়ে আনবেন। কিন্তু দেদার খরচ। এক-একটা হরফ ঢালাই করতেই খসে যাবে ১৮ শিলিং। হিসেব করে যা দেখলেন তাতে মাথায় হাত। দশ হাজার বই ছাপিয়ে আনতেই খরচ পড়বে প্রায় চুয়াল্লিশ হাজার টাকা। এমন সময়েই সত্যিকারের ঠাকুরের মতোই আবির্ভাব ওই বিলিতি কাঠের মুদ্রাযন্ত্রের। কেরির জিগরি দোস্ত নীলকর উডনি সাহেব খিদিরপুর থেকে নিলামে মাত্র চল্লিশ না ছেচল্লিশ পাউন্ডে কিনে ফেললেন এই পুরোনো ছাপার যন্ত্র। যাকে বলে ‘সেকেন্ড হ্যান্ড’। তাতে কী! বন্ধু বই ছাপার জন্য মাথা কুটে মরছে, তাই তার কাছে সেই যন্ত্র দ্রুত নৌকোতে চাপিয়ে পাঠিয়ে দিলেন জর্জ উডনি। যা দেখে কেরির আনন্দ ধরে না। এ যে ঈশ্বরেরই আশীর্বাদ। গাঁয়ের মানুষ কী বুঝে সে নাম দিয়েছিলেন জানা নেই, কিন্তু সময়ের নিরিখে দেখলে নামটা ঘোর সার্থক। আর, গাঁয়ের লোকেদের নিয়ে মজা করেও লাভ নেই। খিদিরপুরের আজন্ম রহস্যজনক বাজার থেকে কেনা বেজায় সস্তা একটা সেকেন্ড হ্যান্ড কিম্ভূতকিমাকার যন্ত্রের যে এত মহিমা তা বোঝা তৎকালীন পুঁথিতে সাহিত্য পড়া বঙ্গদেশের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
সে যাহোক, ‘ঠাকুর’ তো প্রতিষ্ঠে পেলেন, পুরোহিত সাহেব কেরিও তৃপ্ত। কিন্তু তার পুজোর উপাচার এনে দেবে কে? উপাচার মানে হরফ গড়ে দেওয়া। সেও তো বিপুল খরচাসাপেক্ষ ব্যাপার। ইতিমধ্যে উইলকিন্স সাহেব নিজের ছাপাখানা খুলে ফেলেছেন। মালদহ ঘুরে সেই ‘প্রেস’ উঠে এসেছে খোদ কলকাতায়। তাঁকে পাওয়া সম্ভব না। কে তাহলে গড়ে দেবে বাংলা হরফের ছাঁদ? এবং কম খরচে? কেরির দুশ্চিন্তায় চুল ছেঁড়ার দিনেই প্রায় দেবদূতের মতো হাজির হয়েছিলেন পঞ্চানন কর্মকার। হরফ পিছু দর দিয়েছিলেন মাত্র এক টাকা চার আনা। কেরি হাতে চাঁদ পেলেন, তার ঠাকুরও সোনা উগড়োতে লাগলেন দক্ষ লিপিকর পেয়ে। কিন্তু এই পঞ্চাননকে নিয়েও দড়ি টানাটানি কম হয়নি। সে গল্প নাহয় পরের কিস্তিতে।