No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    কোরানের প্রথম বাংলা অনুবাদ করেন একজন ব্রাহ্ম

    কোরানের প্রথম বাংলা অনুবাদ করেন একজন ব্রাহ্ম

    Story image

    বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি। বাউল-ফকির-সত্যপিরের আপন ভূমি। সাম্প্রদায়িকতা এখানে খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। হাজার হাজার বছর ধরে নানা ধর্ম, নানা বিশ্বাসের মানুষ বাস করেন। একে অপরের পাশে দাঁড়ান। আনন্দ-উৎসবে যোগ দেন সবাই মিলে। মুসলমান শাসক পরাগল খানের আদেশে কবীন্দ্র পরমেশ্বর প্রথম বাংলা ভাষায় মহাভারত অনুবাদ করেন। গৌড়েশ্বরের নির্দেশে বাংলায় প্রথম রামায়ণ অনুবাদ করেন কৃত্তিবাস ওঝা। ইতিহাসবেত্তাদের একাংশ বলেন, গৌড়েশ্বর মানে রুকনউদ্দিন বরবক শাহ। আবার কেউ বলেছেন, বাংলার সুলতান জালালউদ্দিন মুহম্মদ শাহ ছিলেন কৃত্তিবাসের পৃষ্ঠপোষক। এরকম মতও প্রচলিত আছে যে এই গৌড়েশ্বর আসলে রাজা গণেশ।

    বাংলার প্রথম যিনি পূর্ণাঙ্গ কোরান অনুবাদ এবং প্রকাশ করেন, তিনি ইসলাম ধর্মের অনুগামী ছিলেন না। যদিও হয়ে উঠেছিলেন মুসলিম সমাজের নয়নমণি। বাংলা কোরানের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হলে একদল মৌলবি চিঠিতে লেখেন, “As we are Mahommedans by faith and birth, our best and hearty thanks are due to the author for his disinterested and patriotic effort and the great troubles he has taken to diffuse the deep meaning of our Holy and Sacred religious book The Koran, to the public.” সঙ্গে ছিল অনুবাদকের নাম প্রকাশের অনুরোধ। অমুসলমানের কাজ গোঁড়া মুসলমানরা কীভাবে নেবেন, সেইকথা ভেবে অনুবাদক নিজের নাম রাখেননি। কিন্তু এই চিঠির পর উচ্ছ্বসিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করলেন গিরিশচন্দ্র সেন।

    ১৮৩৫ সালে নবাব আলিবর্দি খাঁর দেওয়ান দর্পনারায়ণ রায়ের বংশে গিরিশচন্দ্রের জন্ম হয় তখনকার ঢাকা জেলার পাঁচদোনা গ্রামে। ফার্সি ভাষার চর্চা ছিল পরিবারে। গিরিশচন্দ্র ৭ বছর বয়সে পিসেমশাইয়ের থেকে ফার্সি শেখা শুরু করেন। আরেকটু বয়স বাড়লে তাঁকে বড়ো দাদা নিয়ে যান ঢাকা শহরে। পোগোজ স্কুলে ভর্তি করে দেন। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষায় গিরিশের আগ্রহ ছিল না। স্কুল ছেড়ে ফার্সির পাঠ নিতে থাকেন কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের কাছে। তারপর ময়মনসিংহে গিয়ে এক মৌলবির কাছে ফার্সির সাহিত্যের আরও গভীরে মনোনিবেশ করেন। ছোটোদাদা এক কাছারিতে নকলনবিশের কাজ জুটিয়ে দিলেন। তাতেও মন বসল না। পাঠশালায় সংস্কৃত শিখতে লাগলেন। এরপর হার্ডিঞ্জ স্কুলে ভর্তি হলেন। নর্মাল শিক্ষার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন সফলভাবে।

    গিরিশচন্দ্র সেনের কর্মজীবন শুরু হয় হার্ডিঞ্জ বঙ্গ বিদ্যালয়। পরে ময়মনসিংহ স্কুলে দ্বিতীয় পণ্ডিতের দায়িত্ব পান। সঙ্গে চলতে থাকে সাহিত্যচর্চা। ‘ঢাকাপ্রকাশ’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতে থাকেন। প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতার বই। ফার্সি ভাষায় শেখ শাদির লেখা ‘গোলোস্তান’ বাংলায় অনুবাদ করেন। এক ধনী ব্যক্তির সাহায্যে কলেজ প্রতিষ্ঠা করে মহিলাদের পড়াতে থাকেন বিনা বেতনে। এরই মধ্যে ব্রহ্মময়ী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।

    ময়মনসিংহ জেলা স্কুলের এক ব্রাহ্ম শিক্ষক ছিলেন গিরিশচন্দ্রের বন্ধু। তাঁর প্রভাবে ব্রাহ্মধর্মে আগ্রহী হয়ে ওঠেন গিরিশ। ব্রাহ্মদের সভায় যাতায়াত শুরু করেন। ১৮৬৭ সালে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ময়মনসিংহ গেলে তাঁর কাছে সাধনা শিখতে থাকেন। এদিকে তাঁর একটি কন্যাসন্তান জন্ম নিল। যদিও কয়েক দিনের মধ্যেই সে মারা যায়। ব্রহ্মময়ী দেবীও প্রয়াত হন কলেরা রোগে।

    ১৮৭১ সালে অঘোরনাথ গুপ্তের কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নিলেন গিরিশচন্দ্র। ময়মনসিংহে মন টিকছিল না। কলকাতায় চলে আসেন ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের কাছে। সাধনা, শাস্ত্রপাঠ, সাহিত্যচর্চায় মেতে থাকতেন। ছাত্রীদের বাংলা সাহিত্য এবং ব্যাকরণ পড়াতেন। যে বেতন নির্ধারিত ছিল, তা গ্রহণ না করে প্রচারের কাজে দিয়ে দিতেন। কর্তব্যনিষ্ঠার জন্য ব্রাহ্মসমাজ তাঁকে ‘ভাই’ উপাধিতে ভূষিত করে।

    ১৮৭৬ সালে গিরিশচন্দ্র আরবি শেখার জন্য গেলেন লখনৌ। এক মৌলবীর কাছে ওই ভাষা আয়ত্ত করে আরবদের ইতিহাস এবং ইসলামি সাহিত্য চর্চা করতে লাগলেন। আগেই ফার্সি এবং উর্দু শিখেছিলেন। ১৮৭৯ সালে কেশবচন্দ্র হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অধ্যয়নের জন্য ৪ জনকে নির্বাচন করেন। গিরিশচন্দ্রকে বেছে নেওয়া হয় ইসলামের জন্য। ১৮৮১ সালের শেষ দিকে ময়মনসিংহে গিয়ে কোরান শরিফ অনুবাদ শুরু করেন গিরিশচন্দ্র। ৬ বছর সময় লাগে শেষ করতে। বাংলা কোরান প্রকাশিত হল ১২ খণ্ডে। ততদিনে কেশবচন্দ্র প্রয়াত হয়েছেন। গিরিশ লিখলেন, “আজ কোরআনের অনুবাদ সমাপ্ত দেখিয়া আমার মনে যুগপৎ-হর্ষ বিষাদ উপস্থিত। হর্ষ এই যে, এতকালের পরিশ্রম সার্থক হইল। বিষাদ এই যে, ইহার প্রথমাংশ শ্রীমদাচার্য কেশবচন্দ্র সেনের করকমলে অর্পণ করিয়াছিলাম; তিনি তা পাইয়া পরমাহ্লাদিত হইয়াছিলেন এবং ও তাহার সমাপ্তি প্রতীক্ষা করিতেছিলেন; শেষাংশ আর তাঁহার চক্ষুর গোচর করিতে পারিলাম না। ঈশ্বর তাঁহাকে আমাদের চক্ষুর অগোচর করিলেন।”

    কোরান ছাড়াও বেশ কিছু বই তিনি অনুবাদ করেছেন। রচনা করেছেন মৌলিক গ্রন্থ। তার মধ্যে উল্লেখ করা যায় ‘প্রবচনাবলী’ (আরবি থেকে অনূদিত), ‘তাপসমালা’ (ফার্সি বই থেকে সংকলিত), ‘শ্রীমদ্‌ রামকৃষ্ণ পরমহংসের উক্তি ও সংক্ষিপ্ত জীবনী’, ‘তত্ত্বসন্দর্ভমালা’, ‘ভারতে ইংরেজ শাসন’। কেশবচন্দ্র তাঁকে নারীশিক্ষার বিস্তারে নিয়োগ করেছিলেন। যে দায়িত্ব আজীবন পালন করেছেন তিনি। ‘মহিলা’ পত্রিকার সম্পাদনা করতেন। ১৯১০ সালে গিরিশচন্দ্র সেনের মৃত্যু হয় ঢাকায়। হিন্দু-মুসলমান সবাই মিলে তাঁর নশ্বর দেহ সৎকার করেন।

    আজ চারদিকে সাম্প্রদায়িকতার বিষ প্রবল। ধর্মের নামে ভোট চায় গুন্ডা লুম্পেনরা। বাংলার সংস্কৃতি কিন্তু এমন ঘৃণার রাজনীতি সমর্থন করে না। তাই গিরিশচন্দ্র সেনের মতো প্রণম্য ব্যক্তিরাই আমাদের আদর্শ হয়ে থাকবেন। দাঙ্গাবাজ ধর্মব্যবসায়ীরা নয়।

     

    তথ্যঋণ – সতীকুমার চট্টোপাধ্যায়, সবুজ মুখোপাধ্যায়, আবদুল্লাহ আল মোহন

     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @