কবি নীতিশিক্ষক নন, সত্য-শিব-সুন্দরের প্রচারক

আমি বললাম – আচ্ছা, মশায়, মানব-চরিত্র সৃষ্টির রহস্যটা কি? জগতে আমরা হাজার হাজার মানুষ দেখ্চি তাই ফুটিয়ে তোলা কবি ঔপন্যাসিক নাট্যকারের বিশেষ বাহাদুরী – প্রতিভার পরিচায়ক?
গিরিশচন্দ্র – আর্ট মানে কি তাই? কবি – সত্য প্রচার কর্ব্বেন। সত্যের আকার শিবসুন্দর। যাতে – সকলের মঙ্গল হয় আর যেটা সুন্দর – চির সুন্দর আর যা নিত্য সত্যে প্রতিষ্ঠিত – সেই সত্য-শিব সুন্দর কলাবিদের উপাস্য। আলোকে, আঁধারে, ঘাত-প্রতিঘাতে সেই সত্যশিবসুন্দরকে যে মানব চরিত্রগুলির সাহায্যে কবি দেখান – সেগুলি কবি-প্রতিভার। সৃষ্টি – শুধু প্রাণহীন ফটোগ্রাফ নয় – শুধু আকারে মানুষের ছবি নয়, এক-একটী মানব-চরিত্র যেন living – জীবন্ত সজীব। কি জান, জগতে যেন সে রকম মানুষ দেখ্তে পাওয়া যায় – শুধু হাজার হাজার কেন – লক্ষ লক্ষ! কিন্তু তবুও সে মানব-চরিত্র জগতের নয় – কবি-কল্পনার। কবি তার অন্তরের বস্তু স্তরে স্তরে শুধু বিশ্লেষণ করে দেখান না – ভাব-জগতে তার বিকাশ দেখান।
প্রত্যেক মানুষ একটা ভাবের আকার। শুধু তাহার অঙ্কনই কবিত্ব বা art নয়। অতি সাধারণ দুটো স্ত্রী-পুরুষকে নায়ক-নায়িকা ক’রে কবি একটা ভাব-জগতের সৃষ্টি করেন। নায়ক-নায়িকার অনুরাগ, মান অভিমান যা নিত্য সংসারে ঘট্চে – তাই নিয়ে কবি প্রেমের বিকাশ করেন, ঘাত-প্রতিঘাতে প্রেমের মহিমা বিস্তার করেন – আর সঙ্গে সঙ্গে যেগুলো তার ছায়া – সেগুলোর অসাড়তা বুঝিয়ে দেন। সকলে নিত্য নিত্য কত প্রেম-কলহ দেখ্তে পায়, কিন্তু সে গুলি কি কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করে? কবি যখন কল্পনায় ভাব-জগতের সেই মানব-চরিত্রের সৃষ্টি করেন তখন মানুষ অবাক হ’য়ে দেখে আর ভাবে।
দেখ, ম্যাকবেথের মত উচ্চাশা অনেকের ভিতর দেখ্তে পাবে – উচ্চাশায় ম্যাকবেথের মতন উত্থান-পতন অনেকের ভিতর দেখ্বে – কিন্তু সে গুলি কি প্রতিনিয়ত তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে? কিন্তু কবি যখন কল্পনালোকে ভাব-জগতের সৃষ্টি ক’রে ম্যাকবেথের চরিত্র স্তরে স্তরে দেখান যে কি অন্তঃসংগ্রামের জয়-পরাজয়ে ম্যকবেথের উত্থান-পতন হ’চ্চে – তখন সেই ভিতরের জিনিষ দেখ্তে পেয়ে তুমি অবাক্ হ’য়ে কবির সৃষ্টি-মাধুর্য্য বুঝতে পার। বাইরের লড়াই ভিতরের লড়াইতে, পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বিপর্য্যয়ে জয়-পরাজয়ে যে মানুষটী গঠিত হয় তাই কবির সৃষ্টি। সৃষ্টিকর্ত্তার সৃষ্টিও তাই। সৃষ্টিকর্ত্তা তাঁর অনন্ত জগতে অনন্তভাবে অনন্ত জীবের সৃষ্টি মুহূর্ত্তে কর্ছেন। কবি সেই ভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে কল্পনায় সৃষ্ট জগতে কয়েকটী মানুষ চরিত্রে সেই অনন্ত ভাবের লহরী ইঙ্গিত ক’রে দেখান। - এটাই কবির সৃষ্টি। নাট্যকারের এই সৃষ্টি-শক্তি থাকা চাই।
আমি বলিলাম – আপনিতো আর্টকে সত্য-শিব-সুন্দরের বিকাশ বল্লেন – কিন্তু এটা তো সকলে স্বীকার করে না। তাঁরা – অশিব, অসুন্দর ও অসত্য যা জগতে ঘট্চে তাকেও আর্টের উপাদান ব’লে প্রচার করেন। তাঁরা বলেন যে সত্যের শুধু শিব সুন্দর রূপ নয়, অশিব ও অসুন্দর রূপও আছে।
গিরিশচন্দ্র – যাঁরা বলেন – তাঁরা art জানেন না – সত্যকেও জানেন না। সত্য – চিরন্তন, সত্যের মূর্ত্তি শিব, সত্যের রূপ সুন্দর। যা অসত্য – তা অস্থায়ী – চিরন্তন হ’তে পারে না; - যা অসত্য তা অশিব – অসুন্দর – তা কখনও আর্টের লক্ষ্য হ’তে পারে না। অবশ্য সত্য-শিব-সুন্দরকে দেখাতে হ’লে অশিব, অসুন্দর ও অসত্যকেও দেখিয়ে দিতে হয়। মিথ্যার লুকোচুরী সংগ্রাম চলচে – মানুষ প্রতিনিয়ত প্রতিমুহূর্ত্তে তার ভিতর দিয়ে চ’লে সত্যকে আঁকড়াবার চেষ্টা কর্চে। সুন্দর ভেবে অসুন্দরকে আলিঙ্গন কর্চে, শিব মনে ক’রে অশিবকে ইষ্ট ভাব্চে – এই ভুল ভ্রান্তি প্রতিনিয়ত হ’চ্ছে, তাই ব’লে এই ভুল-ভ্রান্তি চরম সত্য নয় – প্রকৃত কলাবিদের লক্ষ্য নয়। জেনো – কবি সত্যের পথপ্রদর্শক।
আমি বলিলাম – আমার দুয়েকটী বন্ধুর সঙ্গে কথা হয়েছিল – তাঁরা শিক্ষিত, পণ্ডিত ও চরিত্রবান, - তাঁরা বলেন কবি তো স্কুল-মাষ্টার নন, কিংবা নীতিশিক্ষক নন যে কবি শুধু নীতি প্রচার কর্বেন। কবি আর্টের উপাসক – সংসারে মানবের প্রকৃত ছবি তাঁরা আঁকবেন – কল্পনার লীলা দেখাবার জন্য – কবি আঁকবেন তাঁর কল্পনা মত – art for art’s sake.
গিরিশচন্দ্র – তাঁদের বল্লে না কেন – কবি স্কুলমাষ্টার বা নীতিশিক্ষক নন, কিন্তু তিনি সত্য-শিব-সুন্দরের প্রচারক। ব্যাস বাল্মীকির চেয়ে কোন্ স্কুলমাষ্টার বা নীতিশিক্ষক বেশী শিখায়? কবি যে লোকশিক্ষক – সত্য-প্রচারক। কবি তো সত্যি আবর্জ্জনার স্তূপ দেখাতে আসে নি? নগ্ন সৌন্দর্য্যের একটা খ্যাতি আছে তাই ব’লে সৌন্দর্য্য দেখাবার জন্য মেয়ে পুরুষ নগ্ন হয়ে কি চলাফেরা করে? যদি কেহ করে তবে তৎক্ষণাৎ তাকে পাগ্লাগারদের ব্যবস্থা করবে। বাল্মীকি, রাবণ সূর্পণখা দেখিয়েছেন, আবার রাম সীতাও দেখিয়েছেন। কবি শুধু অসুন্দর অশিব আঁকবেন – আর শিবসুন্দরের ধার দিয়ে যাবেন না, আর্টের মাথার দিব্যি তা নয়। কবি মন্দ ছবি আঁকবেন, কিন্তু ভালকে অধিকতর পরিস্ফুট কর্বার জন্য – সয়তান থাক্বে কিন্তু খ্রীষ্টের মহত্ত্ব দেখাবার জন্য। শুধু সয়তান আঁকাই আর্ট নয় যদি খ্রীষ্ট না থাকে। Art for art’s sake অতি নীচু কথা – art for truth’s sake সত্য কথা।
আমি বলিলাম – কিন্তু ম’শায় দুনিয়াতে কদাকার বীভৎস ছবি – উৎকট রকমের ব্যভিচার – সব তো আছে – তবে আপনি শুধু সত্য-শিব-সুন্দর আর্টের লক্ষ্য বল্ছেন কেন?
গিরিশচন্দ্র – সত্যসুন্দর-শিব যে আর্টের রূপ। কিন্তু তুমি একটী বিষয় বুঝ্চো না। কদাকার বীভৎস ছবি দেখাতে পার, সত্যের উজ্জ্বল মূর্ত্তি দেখাবার জন্য। শুধু কদাকার বীভৎস ছবি আঁকাই কোনও কলাবিদের উদ্দেশ্য হ’তে পারে না। দান্তে নরকের ছবি এঁকেছেন – অতি বীভৎস দৃশ্য – কিন্তু তা শুধু স্বর্গের জ্যোতির্ম্ময়ী মূর্ত্তির সহিত পার্থক্য দেখাতে। কবিশক্তির তারতম্য অনুসারে কেহ ভাল ছবি আঁক্তে দক্ষতা দেখান, আবার কেহ মন্দ ছবি আঁক্তে দক্ষতা দেখান – সকলের শক্তি সমান নয়। কিন্তু আর্টের চরম সত্য শিব সুন্দর রূপ মিছে হ’তে পারে না। প্রকৃত কবি জীবনে কিছু না দেখে কিছু অনুভূতি না ক’রে লেখেন না! অভিজ্ঞতা না থাক্লে নাট্যকার হওয়া যায় না।
আমি বলিলাম – কিন্তু আপনি যে কল্পনার কথা বলেন তা তো মিছে। কল্পনা কখনও সত্য হ’তে পারে না।
গিরিশচন্দ্র – কল্পনা মিছে কে বলে? কল্পনা – বাস্তব – সত্য। বাস্তব জগৎ থেকে কল্পনার উদয় হয় – কল্পনার অনুভূতি হয় প্রাণে। অধ্যাত্মরাজ্যে সাধক প্রথম কল্পনার সহায়তায় মনস্থির ক’রে ইষ্টের চিন্তা করেন। কল্পনা সত্যরাজ্যের পথ। কে বলে কল্পনা মিথ্যা? কবে যে সত্যের সাধক তাই কল্পনা দিয়ে সত্যের সন্ধানে যান।
আমি বলিলাম – এটা বুঝতে পারছি না। কল্পনা – imajination – যেটার আদৌ অস্তিত্ব নেই – সেটা কি ক’রে বাস্তব সত্য হ’বে? গল্প রচনা আমার মন থেকে তৈরী হ’ল – বাস্তব-জগতে তার অস্তিত্ব ছিল না – তা কি ক’রে বল্বো বাস্তব সত্য!
গিরিশচন্দ্র – বেশ কথা। মনে মনে তুমি একটা গল্প রচনা করলে – কেমন? বাস্তব-জগতে যা দেখ্চ শুন্চ সে সব নিয়ে তো গল্প রচনা করেছ – না? বাস্তব-জগতে কখনও দেখনি শুননি এমন কিছু মনে মনে ভাব্তে পার? মানুষ দেখচো, পশুপক্ষী দেখচো, পাহাড়, পর্ব্বত, অরণ্য, শ্যামল প্রান্তর, নদ-নদী সমুদ্র দেখচো – তাই ভাবচো – তাই লিখচো। মানুষের রাগ-অনুরাগ, কলহ-বিবাদ, চক্রান্ত, ষড়্যন্ত্র, উদারতা, কৃপণতা, ত্যাগ, আসক্তি, প্রেম ও প্রতিশোধ দেখচো – তাই ভাবচো – তাই দেখাতে গিয়ে মানুষ দিয়ে ঘটনার সন্নিবেশ করভো – যে ঘটনা সংসারে ঘ’টে থাকে – তবে সেটা মিছে কোথায়? বল্বে যে আমার রচনাটা তো আমি গড়েচি। কিন্তু কি দিয়ে গড়েছ? বাস্তব জগতের সব নিয়ে সাজিয়েছ – এই কল্পনা! সেটা মিছে হ’বে কেন? ভাব – মিছে নয়, প্রতিনিয়ত প্রতি পদে সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ চলেছে মানুষের ভিতর দিয়ে তা মিছে নয়, তা ভাবা মিছে নয়, - তা আঁকা মিছে নয়। বুঝলে কল্পনা বাস্তব কিনা?
এই যে সৃষ্টি এটা তো পরমপুরুষের কল্পনা থেকেই হ’য়েছে। ‘আমি এক, বহু হ’ব।’ এই তো শাস্ত্রে বল্চে। শুধু আমাদের কেন – বাইবেলে দেখ, ভগবানের বহু হবার ইচ্ছে হ’ল – তাই বহু হলেন। কবির সৃষ্টির মূলেও এই কল্পনা। কল্পনা মিছে হ’তে যাবে কেন? এই কল্পনা মহতী শক্তির বিকাশ। এই কল্পনার বলে তুমি অসীম সৌন্দর্য্যের রাজ্যে যেতে পারচো, এই কল্পনার বলে তুমি বিদ্যুৎ অপেক্ষা দ্রুতগতিতে স্বর্গ-মর্ত্ত্য-রসাতলে যেখানে ইচ্ছে যেতে পার। এই কল্পনার বলে তুমি অপার অপার্থিব আনন্দ ভোগ করতে পার – সেই কল্পনা মিছে? কল্পনায় সত্য প্রতিভাত হয়, কল্পনা সত্যরাজ্যের পথ। কল্পনা বাস্তব সত্য! বুঝেছ?
আমি বলিলাম – আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার একটা বিষম ভুল ভেঙ্গে গেল। অবশ্য সাধুদের নিকট কল্পনা সম্বন্ধে যা ধারণা হয়েছিল – তাই আপনার কাছে শুন্লাম। তবে কবির কল্পনা ও সাধকের কল্পনা যে এক তা আদৌ বুদ্ধিতে আসেনি। নাট্যকারের সৃষ্টি-শক্তিই প্রকৃত প্রতিভার পরিচয় তাও বুঝতে পারলেম।
গিরিশচন্দ্র – বিলেতে নাটকের উৎপত্তির মূল ধর্ম্ম। যীশুখ্রীষ্টের জন্মদিনে লোকে আনন্দে উৎসবে মত্ত হ’ত। সেই আনন্দোৎসব থেকে প্রথম অভিনয় কথোপকথন দৃশ্য-পটের আমদানী হ’ল – লোকে এই তামাসায় বিশেষ আকৃষ্ট হ’ল – শেষে পাদরীরা ধীরে ধীরে খৃষ্টীয় পর্ব্বদিনে নাটক রচনা ক’রে অভিনয় কর্তে লাগল। ইউরোপের সমস্ত দেশে পাদরীরা নাটক রচনা ক’রে অভিনয়ের দ্বারা যীশুর জীবনলীলা ও বাইবেলের ঘটনাবলী প্রচার করতে লাগ্লো। এইরূপে ইউরোপে নাটকের উৎপত্তি হ’তে লাগ্লো। দেখ, প্রথমেই একটা সত্য বস্তুকে প্রচার কর্বার জন্য নাটকের উৎপত্তি। আর আমাদের দেশেই কি? ভরত ঋষি নাট্যকলার প্রচার কর্লেন। এই দেশে ঋষিদের দ্বারাই নাটকের প্রথম প্রচার হয়।
(কুমুদবন্ধু সেন রচিত ‘গিরিশচন্দ্র ঘোষের সাক্ষাৎকার’ বই থেকে সংকলিত। প্রকাশক-তালপাতা)