No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বঙ্গবাসী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা কৃষিবিজ্ঞানী গিরিশচন্দ্র বসু 

    বঙ্গবাসী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা কৃষিবিজ্ঞানী গিরিশচন্দ্র বসু 

    Story image

    শিয়ালদা স্টেশন থেকে একটু এগিয়ে গেলেই বঙ্গবাসী কলেজ। শতাব্দী প্রাচীন এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা একজন বাঙালি শিক্ষাবিদ। কে ছিলেন এই শিক্ষাবিদ? ঊনবিংশ শতাব্দীতে পরাধীন ভারতে যে সকল কৃতী শিক্ষাবিদের আবির্ভাবে বাংলা ধন্য হয়েছিল তাঁদের মধ্যে অন্যতম এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা কৃষিবিজ্ঞানী গিরিশচন্দ্র বসু। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি তাঁকে আজও আমাদের কাছে স্মরণীয় ও বরণীয় করে রেখেছে। বাংলার এই কৃতি সন্তান শুধুমাত্র যে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তা নয়, তিনি ছিলেন বিজ্ঞান লেখক, বিজ্ঞান অধ্যাপক, কৃষিবিজ্ঞানী, দেশপ্রেমিক ইত্যাদি। অর্থাৎ, একাধিক গুণ সম্পন্ন একজন মানুষ।  

    গিরিশচন্দ্র বসুর জন্ম ১৮৫৩ সালের ২৯ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার বেড়ুগ্রামে। পিতা জানকীপ্রসাদ বসু ছিলেন উদার প্রকৃতির ও বিদ্যানুরাগী। তাঁর ইচ্ছা, ছেলে উচ্চশিক্ষিত হোক। সেই ইচ্ছা পূরণে তিনি ছেলেকে গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি করে দেন। ছোট্ট গিরিশচন্দ্রের পড়াশোনায় গভীর আগ্রহ দেখে সেখানকার পাঠ শেষ হলে জানকীপ্রসাদ উচ্চশিক্ষার জন্য তাঁর জেষ্ঠ্য ভ্রাতা রাজবল্লভ বসুর কাছে ছেলেকে পাঠিয়ে দেন। জ্যাঠামশাই ভ্রাতুষ্পুত্রকে হুগলি কলেজিয়েট ব্রাঞ্চ স্কুলে ভর্তি করে দেন। দশ বছর বয়সে গিরিশচন্দ্র মাকে হারান। মাতৃহারা এই শিশুকে জ্যেঠিমা মাতৃস্নেহে কাছে টেনে নেন। ফলে তিনি কোনো দিনই মায়ের অভাব অনুভব করেননি।

    ১৮৭০ সালে এন্ট্রান্স, ১৮৭৩ সালে হুগলি কলেজ থেকে এফ এ এবং ১৮৭৬ সালে প্রথম বিভাগে ১১তম স্থান নিয়ে গিরিশচন্দ্র বি এ পাশ করেন। ঐ সময়ে শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর ছিলেন উড্রো সাহেব। গিরিশচন্দ্রের মেধার পরিচয় পেয়ে তিনি তাঁকে কটকের র‍্যাভেন্‌শ কলেজে বিজ্ঞান অধ্যাপকের পদে নিয়োগ করেন। অধ্যাপক থাকাকালীন ১৮৭৮ সালে তিনি এম এ পাশ করেন। তার আগেই ১৮৭৭ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে বর্ধমান নিবাসী প্যারীচরণ মিত্রের কনিষ্ঠা কন্যা নীরদ মোহিনীর সঙ্গে তিনি পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। এই বৈবাহিক সূত্র ধরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, ভূপাল বসু, ব্যোমকেশ চক্রবর্তী, লর্ড এস. পি. সিং, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রমুখ মনীষীদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সে সময়ে কৃষিবিদ্যায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য বাংলা থেকে দু’জন ছাত্রকে বৃত্তি দিয়ে বিলেতে পাঠানো হত। সে বছর নির্বাচিত দুই ছাত্রের একজন ছিলেন গিরিশচন্দ্র বসু।    

    সরকারি বৃত্তি নিয়ে গিরিশচন্দ্র ১৮৮১ সালের ২১ ডিসেম্বর লন্ডনে পৌঁছোন এবং সাইরেনসেস্টার রয়্যাল এগ্রিক্যালচারাল্‌ কলেজে কৃষি বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হন। পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে এবং ৫০ পাউন্ড মূল্যের পুরস্কার লাভ করে তিনি সসম্মানে এই ডিপ্লোমা কোর্সে উত্তীর্ণ হন। কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ইংল্যান্ডের রয়্যাল এগ্রিক্যালচারাল্‌ সোসাইটি ১৮৮২ সালে তাঁকে সোসাইটির আজীবন সদস্য পদ প্রদান করেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৮৮৩ সালে তিনি কেমিক্যাল সোসাইটি অব ইংল্যান্ডের ফেলো নির্বাচিত হন। লন্ডনে অধ্যয়ন শেষ করে তিনি স্কটল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইতালি হয়ে ১৮৮৪ সালে দেশে ফিরে আসেন। 

    কৃষিবিজ্ঞানে বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্য ছিল তাঁর নিজের জন্মভূমির শিক্ষার উন্নতি ঘটানো। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন সেখানকার জীবনযাপন দ্বারা প্রভাবিত হলেও তিনি তাঁর উদ্দেশ্যের কথা কখনো ভোলেননি। তাই দেশে ফিরে উচ্চপদে সরকারি চাকরি বা হায়দ্রাবাদের নিজামের দেওয়া লোভনীয় চাকরি উপেক্ষা করে বাংলায় শিক্ষাবিস্তারের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বাংলার প্রতি তাঁর ভালোবাসা কতটা গভীর ছিল তা এই ঘটনা থেকে সহজেই অনুমান করা যায়। ১৮৮৫ সালে সরকারের সাহায্য ছাড়াই তিনি বউবাজার স্ট্রিট এর একটি ভাড়া বাড়িতে ৬ জন শিক্ষক এবং ১২ জন ছাত্র নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবাসী স্কুল। দু’বছর পর অর্থাৎ ১৮৮৭ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অনুপ্রেরণায় ও পরামর্শে বঙ্গবাসী কলেজ রূপে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৩০ সালে এই কলেজ তার বর্তমান ঠিকানা ১৯ স্কট লেন (বর্তমান নাম, রাজকুমার চক্রবর্তী সরণি), শিয়ালদহে নতুন ভবনে স্থানান্তরিত হয়। এই কলেজ স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিল বাংলায় কৃষি শিক্ষা প্রচার ও প্রসার। বঙ্গবাসী কলেজ সারা বাংলায় প্রথম স্বদেশী কলেজ রূপে প্রতিষ্ঠা পায়। কৃষিশিক্ষা ছাড়াও এই কলেজে জীববিদ্যাও পড়ানো হত। প্রতিষ্ঠার পর থেকে গিরিশচন্দ্র বসু কলেজের অধ্যক্ষের পদে আসীন ছিলেন। ১৯৩৫ সালে তিনি রেক্টরের পদে মনোনীত হন এবং বোটানিক্যাল সোসাইটি অফ বেঙ্গল-এর প্রথম সভাপতি হন। ঐ বছরেই কলেজে জীববিদ্যা বিভাগ খোলা হয়। এছাড়াও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলেন।     

    শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী গিরিশচন্দ্র বসু

    বাংলায় কৃষিবিজ্ঞানের প্রসারকল্পে গিরিশচন্দ্র কলেজ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ‘কৃষি গেজেট’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বাংলা ও ইংরাজি উভয় ভাষাতেই প্রকাশ করতেন। বাংলা ভাষায় কৃষিবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যা বিষয়ে গ্রন্থ রচনায় তিনি ছিলেন অন্যতম পথিকৃত। তাঁর রচিত কয়েকটি গ্রন্থ হল- ‘কৃষি পরিচয়’, ‘কৃষি সোপান’, ‘গাছের কথা’, ‘উদ্ভিদতত্ত্ব’ ইত্যাদি। বাংলা ভাষায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ ভূবিদ্যা বিষয়ক গ্রন্থ ‘ভূ-তত্ত্ব’ তাঁর সৃষ্টির অন্যতম কীর্তি।

    অধ্যক্ষ গিরিশচন্দ্র বসু ছিলেন একজন বিজ্ঞান সাধক, উদারচেতা ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ। রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ না করলেও তাঁর জাতীয়তাবাদী চেতনা ও স্বদেশ প্রীতি এতটাই প্রবল ছিল যে নির্যাতিত দেশকর্মীদের শিক্ষাদানের জন্য বঙ্গবাসী কলেজের দ্বার সর্বদা উন্মুক্ত রেখেছিলেন।

    ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় বহু কৃতি মনীষীর আবির্ভাব ঘটেছিল। তাদের হাত ধরে এসেছিল  সমাজ সংস্কার আন্দোলনের জোয়ার যা বঙ্গ রেঁনেসা নামে চিহ্নিত হয়ে আছে। মূলত রাজা রামমোহন রায়ের সময়ে এই নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল। পরবর্তীকালে বহু জ্ঞানীগুণী মানুষ এই সৃজনশীলতা ও শিক্ষাদীক্ষার জোয়ারের বিভিন্ন ধারার ধারক ও বাহক হিসাবে পরিচিত হয়েছেন। যে সব কৃতি মানুষেরা মধ্যযুগের অন্ত ঘটিয়ে বাংলায় আধুনিক যুগের সূচনা করেছিলেন। তাদেরই একজন হলেন আচার্য গিরিশচন্দ্র বসু।  

    ১৯৩৯ সালের ১ জানুয়ারি ছাত্রদরদী এই মহান শিক্ষাগুরুর জীবনাবসান হয়। প্রতি বছর আমরা বিশেষত বাঙালিরা ১ জানুয়ারি ধূমধাম করে ইংরাজি নববর্ষ পালন করি, কিন্তু ক’জন স্মরণ করি এই মহান ব্যক্তির তিরোধান দিবস ও বাংলায় কৃষি ও বিজ্ঞান শিক্ষায় তাঁর অবদানকে?

    তথ্য সূত্রঃ
    ১) গুরু-ঋণ – জগদীশচন্দ্র ভট্টাচার্য, Bangabasi College Centenary Souvenir, 1986
    ২) সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান (১ম খণ্ড), ২০১০ 
    ৩) কৃষিবিজ্ঞানী গিরিশচন্দ্র বসু – চিত্তব্রত পালিত, যুগের ডাক, শারদীয়া ১৪১৮ 

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @